দেশের স্বাস্থ্য খাতের চিকিৎসকদের চার ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়। এগুলো হলো- সম্পদের অপ্রতুলতা, ব্যবস্থাপনার সংকট, আইনের সীমাবদ্ধতা এবং সামগ্রিকভাবে অবকাঠামোগত দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকা। গত শনিবার রাতে স্বাস্থ্যব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম আয়োজিত ‘বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবায় আইনের সীমাবদ্ধতা’ শীর্ষক ওয়েবিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।
বক্তারা বলেন, গোটা স্বাস্থ্য খাতই ঢেলে সাজাতে হবে। এ ছাড়া ফরেনসিক চিকিৎসকদের জন্য বিশেষ সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ খুবই জরুরি বলে মনে করেন তারা। এতে আইনজীবী এবং গণস্বাস্থ্য গবেষক লুবনা ইয়াসমিনের পরিচালনায় বক্তব্য রাখেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. সুমন নাজমুল হোসেন ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট অমি রহমান পিয়াল।
অমি রহমান পিয়াল তার বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবায় মূল সমস্যা ব্যবস্থাপনায়। সব জায়গায় সমন্বয়হীনতা। করোনা মোকাবিলায় চিকিৎসকদের পিপিই না দিয়ে চিকিৎসাক্ষেত্রে পাঠানো, অস্ত্র না দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানোর মতো। এগুলো গুরুতর অপরাধ। সরকারি হাসপাতালগুলোর জরুরি বিভাগের অবস্থা নাজুক। পর্যাপ্ত চিকিৎসা উপকরণ নেই, আবার অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতির কারণে অপ্রয়োজনীয় উপকরণ সাজিয়ে রাখার মতো বিষয়ও আছে। এ থেকে উত্তরণে রোগীদের স্বাস্থ্যবীমার আওতায় আনার পাশাপাশি চিকিৎসক এবং হাসপাতালগুলোর জন্য একটা বিধিমালা থাকা জরুরি। গোটা স্বাস্থ্য খাতকেই ঢেলে সাজাতে হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, আইন ঠিকই আছে, অভাবটা সমন্বয়ের।
ব্যারিস্টার রাশনা বলেন, সংবিধানে স্বাস্থ্যকে এখনো মৌলিক নাগরিক অধিকারের মর্যাদা দেওয়া না হলেও, উচ্চ আদালত বারবার তার ব্যাখ্যায় একে মানুষের জীবনের যে মৌলিক অধিকার তাতে অন্তর্ভুক্ত করতে বলেছেন। সংবিধানের ১৫তম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নাগরিকদের মৌলিক চাহিদাগুলো নিশ্চিত করতে হবে যার মধ্যে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষার সাথে স্বাস্থ্যও রয়েছে; যা রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির মধ্যে পড়ে। এর অর্থ এগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গেলে মাথায় রাখতেই হবে। অন্যদিকে ১৮তম অনুচ্ছেদেও বলা হয়েছে, জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের কথা মাথায় রেখেই রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে।
তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট অনেক আইন থাকলেও মূলত দুটি আইন আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাতকে নিয়ন্ত্রণ করছে। একটি হলো বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল আইন-২০১০, যা মেডিক্যাল এবং ডেন্টাল চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রণ করছে। আর মেডিক্যাল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিস রেগুলেশন্স অর্ডিন্যান্স-১৯৮৫; যা নিয়ন্ত্রণ করছে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ল্যাবরেটরি ইত্যাদিকে। কিন্তু এসব আইনের অনেক অপর্যাপ্ততা এবং ফাঁকফোকর রয়েছে যেগুলোতে সংশোধনী আনতেই হবে। আমাদের লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কে অনেক ঘাটতি রয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে আইনগত দুর্বলতার পাশাপাশি প্রায়োগিক দুর্বলতা যেমন মনিটরিংও নেই। আর তাই চিকিৎসক বা হাসপাতালগুলোর জবাবদিহিতাও নেই। তবে সম্পদের অপ্রতুলতাই সবচেয়ে বড় কারণ। স্বাস্থ্য খাতে পর্যাপ্ত খরচ করা হয় না। যে কোনো আইনের খসড়া করার আগে সংশ্লিষ্ট মহলকে সম্পৃক্ত করে সংলাপের আয়োজন করা উচিত বলেও মত দেন রাশনা।
ডা. সুমন মনে করেন, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ সবচেয়ে কম। এটা বৃদ্ধি না করলে কখনই যথোপযুক্ত অবকাঠামো তৈরি সম্ভব হবে না। দেশে প্রায় সব ধরনের চিকিৎসা থাকলেও অনেকে অকারণেই বিদেশে চিকিৎসার জন্য যান। জনসাধারণের মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। তিনি বলেন, করোনা উপসর্গ থাকালে তা লুকানো উচিত নয়। কারণ এতে চিকিৎসকসহ সবার জন্য ঝুঁকি বয়ে আনে। অনেকেই এখন আর মুখে মাস্ক পরছেন না উল্লেখ করে তিনি এর জন্য আইনগত বিধিমালা তৈরির ওপর জোর দেন।
রোগীদের কাছ থেকে বিভিন্ন সেবা বাবদ অতিরিক্ত অন্যায্য এবং অতিরিক্ত চার্জ আরোপের প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার রাশনা বলেন, ১৯৮৫ সালের অর্ডিন্যান্সে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং প্রাইভেট চেম্বারে ‘সার্ভিস চার্জ’ নির্ধারণে কিছু নিয়ম বেঁধে দেওয়া হলেও সেগুলো সময়ের প্রয়োজনে এখন পরিবর্তন করা জরুরি।
ফরেনসিক মেডিসিনের চিকিৎসকরা প্রায়ই স্থানীয় সন্ত্রাসীদের হুমকির শিকার হন উল্লেখ করে তাদের জন্য সরকারের ‘বিশেষ সুরক্ষা’র ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত বলেও মনে করেন ডা. সুমন। তিনি বলেন, নইলে তাদের কাছ থেকে ময়নাতদন্তের প্রকৃত সুরতহাল প্রতিবেদন আশা করা ঠিক হবে না। আর সেক্ষেত্রে সঠিক বিচারও পাওয়া যাবে না। ব্যারিস্টার রাশনা সহমত পোষণ করে বলেন, দেশে প্রত্যক্ষদর্শী এবং নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের সুরক্ষায় কোনো আইন নেই।
Leave a Reply