অতীতের সব অপরাধের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনেরা যেভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে থাকেন, এবারেও তার ব্যতিক্রম কিছু করেননি। দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানমের ওপর নৃশংস হামলার পর আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীরা সমস্বরে বলে উঠলেন, ‘অপরাধী যেই হোক ছাড় দেওয়া হবে না। অপরাধী যেই দলেরই হোক না কেন তাঁকে বিচারের আওতায় আসতেই হবে।’
এর আগে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ নিহত হওয়ার ঘটনায়ও তাঁরা বললেন, অপরাধী যেই হোক না কেন ছাড় দেওয়া হবে না। এটি অবশ্য আওয়ামী লীগের কোনো নেতা-কর্মী ঘটাননি। এই ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশ, কক্সবাজারের টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার ও এএসআই লিয়াকত হোসেন।
মাস দুই আগে ফরিদপুরে আওয়ামী লীগ পরিবারের ‘দুই ভাই’ ও তাঁদের অনুসারীদের চাঁদাবাজি, দখলবাজির ঘটনা ফাঁস হওয়ার পরও আওয়ামী লীগ নেতারা জাতিকে অনুরূপ বয়ান দিয়েছিলেন।
গত বছর ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ আনলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফারজানা ইসলাম। এরপর ছাত্রলীগের দুই নেতা পদ হারালেও তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাঁরা যদি সত্যি সত্যি চাঁদাবাজি করে থাকেন, তাহলে পদ হারানোই যথেষ্ট শাস্তি হতে পারে না। তাঁদের বিরুদ্ধে কেন আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে না? আর যদি চাঁদাবাজি করে না থাকেন, তাহলে কেন পদ হারালেন? এই প্রশ্নের জবাব কি আওয়ামী লীগ নেতারা দিতে পারবেন?
দেশে যেখানেই অঘটন বা অপরাধ ঘটুক না কেন তার সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের নাম আসবেই। এত দিন সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দখলবাজিতে তাঁরা ব্যস্ত ছিলেন। ইউএনওর বাসায় হামলার ঘটনার মূল আসামি আসাদুল হকের দাবি অনুযায়ী এবার তাঁরা চুরিতেও নেমেছেন। সাধারণ মানুষ মনে করে সরকার ছাড় দিচ্ছে বলেই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছে। হ্যাঁ, ব্যবস্থা নিচ্ছে। সেটি পছন্দসই। একজনকে ধরলে নয়জন ধরার বাইরেই থেকে যান। সম্প্রতি নানা মহলের সমালোচনার মুখে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কমিটিগুলোর কাছে বহিরাগতদের তালিকা দেওয়ার জন্য কেন্দ্রের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নেতারা বোঝাতে চাইছেন যে খাঁটি আওয়ামী লীগার, যুবলীগার, ছাত্রলীগারেরা খুবই সজ্জন। যাঁরা বিভিন্ন দল থেকে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ করেছেন, তাঁরাই অপরাধের হোতা।
কিন্তু বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে যেসব নেতা-কর্মীর নাম আসছে, তাঁদের বেশির ভাগ খাঁটি আওয়ামী লীগার। কেউ বা পুরুষানুক্রমে আওয়ামী লীগ করেন। আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ, ছাত্রলীগে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং এখনো দিচ্ছেন, তাঁরা খাঁটি আওয়ামী লীগারই।
ইউএনও ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলার ঘটনায় স্থানীয় যুবলীগ কর্মী ও নেতার নাম আসার সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় যুবলীগ তাঁদের বহিষ্কার করে। তাদের ত্বরিত সিদ্ধান্তে মনে হচ্ছে, বহিষ্কারের প্রেস বিজ্ঞপ্তির খসড়া আগেই তৈরি থাকে। অপরাধ সংঘটনের সঙ্গে কারও নাম এলেই তাঁকে বহিষ্কার করার সুসংবাদটি দেশবাসীকে জানিয়ে দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে সংগঠনটি নিজেকে সাফ সুতরো প্রমাণের চেষ্টা করে। কেননা ব্যক্তির অপরাধের জন্য সংগঠনকে দায়ী করা যায় না। আওয়ামী লীগ নেতারা অপরাধ বিজ্ঞানের এই সংজ্ঞা অন্য দলের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন না। সেখানে অপরাধের সঙ্গে বিরোধী দলের কারও নাম এলে আওয়ামী লীগ নেতারা পুরো দলকে নাশকতাকারী ও স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন।
পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্ষমতাসীনদের স্থানীয় রাজনীতিতে বিবদমান একাধিক পক্ষের চক্ষুশূল ছিলেন ইউএনও ওয়াহিদা খানম। স্থানীয় সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, যুবলীগ নেতাসহ অনেকের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কাজে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। এঁদেরই কোনো পক্ষ ওয়াহিদার ওপর হামলার নেপথ্যে থাকতে পারে। (কালের কণ্ঠ, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২০)
শনিবার অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. হেলালুদ্দীন আহমদও সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, এটি কোনো চুরির ঘটনা নয়। এটি একটি পরিকল্পিত আক্রমণের ঘটনা। এর সঙ্গে আরও অনেক ব্যক্তি জড়িত থাকতে পারেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াহিদা খানম একজন সৎ, নির্ভীক কর্মকর্তা। তিনি কোনো দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেননি বলে স্বার্থান্বেষী মহল প্রতিহিংসা চরিতার্থের জন্য এ ঘটনা ঘটাতে পারেন বলেও মনে করেন এই জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা।
এর আগেও দিনাজপুর-৬ আসনে আরেক ইউএনওর ওপর হামলা হয়েছিল। ২০১৪ সালের ১ অক্টোবর দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জের ইউএনও সৈয়দ ফরহাদ হোসেনকে বেধড়ক পেটানো হয়। নবাবগঞ্জের ৩৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নৈশপ্রহরী নিয়োগের ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা ওই ঘটনা ঘটান। হামলাকারীরা সংসদ সদস্য শিবলী সাদিকের অনুসারী বলে পরিচিত।
ঘোড়াঘাট উপজেলায় কোনো সরকারি বালুমহাল নেই। দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ ঘাট তৈরি করে প্রায় ১০টি জায়গা থেকে লোহার পাইপ বসিয়ে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করা হলে ইউএনও বাধা দেন। তিনি ড্রেজার মেশিন পুড়িয়ে দেওয়া ছাড়াও অবৈধ বালুমহাল বন্ধ করে দেন। এ কারণেও তাঁর ওপর হামলা হতে পারে বলে ধারণা করেন স্থানীয় ব্যক্তিরা।
ইউএনওর ওপর হামলার পর যুবলীগ কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব উপজেলা যুবলীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলম ও যুবলীগ কর্মী আসাদুল হকসহ তিনজনকে বহিষ্কার করেছে। কিন্তু পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে মূল আসামি আসাদুল হক ও দুই রংমিস্ত্রিকে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য জাহাঙ্গীর আলমকে আটক করলেও পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওই ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
যে যুবলীগ নেতা একাধিক হামলা ও মাস্তানির সঙ্গে জড়িত, তাঁকে কেন ছেড়ে দেওয়া হলো? গত ১২ মে বিকেলে ইফতারি বিতরণের সময় ঘোড়াঘাট উপজেলা চত্বরে পৌরসভার মেয়র বিএনপি নেতা আবদুস ছাত্তার মিলনের ওপর হামলা চালিয়েছিলেন এই যুবলীগ নেতা। সে সময়ও জাহাঙ্গীর আলমসহ চার যুবলীগ নেতাকে পুলিশ আটক করেছিল। পরে তাঁরা ছাড়া পেয়ে যান। কীভাবে ছাড়া পেলেন, কারা তাঁকে ছাড়িয়ে নিলেন, সেই প্রশ্নের জবাবও খুঁজে বের করা প্রয়োজন।
ক্ষমতাসীন দলের নেতা-মন্ত্রীরা যতই বলুন না কেন অপরাধ করে কেউ পার পাবে না, সবাইকে ধরা হবে, আসলে তাঁরা সবাইকে ধরছেন না বলেই দেশে এত অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। আর কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না, এই মুখস্থ কথা না বলে যদি তাঁরা অপরাধীদের জন্য দলে প্রবেশাধিকার, দলের নাম ভাঙিয়ে অপকর্ম করার পথ রহিত করতেন, তাহলে ইউএনওর ওপর হামলার মতো নৃশংস হামলার ঘটনা এড়ানো যেত।
*সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
Leave a Reply