দেশ ও জাতি হিসেবে আমরা অন্যান্য দেশের মতোই চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি। দুঃখ-কষ্ট, দুশ্চিন্তা চারদিকে। মানুষের চাকরি-রোজগার নেই, কর্মচ্যুত অনেকে, অনেকে ব্যবসাচ্যুত। ‘করোনাই’ প্রধান কারণ যার তাণ্ডব শুরু হয়েছে ছয় মাস আগে। তখন থেকেই মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত- কার প্রাণ কখন যায়। এরই মধ্যে এসে গেল ভয়াবহ বন্যা। বলা যায় তিন দফা বন্যা।
হাজার হাজার হেক্টর জমি পানির তলায়। প্রচুর আউশ ধান নষ্ট হয়েছে। আমন ক্ষতিগ্রস্ত। বীজতলা গেছে। চাষের মাছ গেছে। হাঁস-মুরগি-গবাদিপশু গেছে। শীতের ফসল অনিশ্চিত হয়ে রয়েছে। শাকসবজির ফলন বিঘ্নিত। কথা উঠেছে চাল আমদানি, যা আমরা বহুদিন ধরে করছি না। করোনার আঘাত, বন্যার আঘাতের সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে মূল্যস্ফীতি।
চালের দাম বেড়েছে, সয়াবিনের দাম বেড়েছে। অনিশ্চিত জীবনের ধাক্কা থেকে বাঁচার জন্য মানুষ ঢাকা শহর ছাড়ছে। বাড়িঘর খালি পড়ে রয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ও উদ্যোগ লাটে উঠেছে। মালিকরা পুঁজি খেয়ে সব শেষ করেছে। শত ধরনের স্বনিয়োজিত ব্যক্তি, খেটে খাওয়া মানুষ, রিকশাচালক, নির্মাণ কর্মী, সেলুন কর্মী, পলিশওয়ালা, ওস্তাগার, হেলপার, কাঠমিস্ত্রি থেকে শুরু করে অগণিত শ্রমজীবী, পেশাজীবীর হাতে ‘ক্যাশ’ নেই।
অফিস-আদালত অনিয়মিত। শিক্ষাব্যবস্থা বিপর্যস্ত, বিচার-আচার বিঘ্নিত। উন্নয়নের কাজ বিঘ্নিত। খুলনা অঞ্চলের মাছের ঘের বন্যার জলে ভেসে গেছে। প্রচুর সংখ্যক শহর ও গ্রাম পানির তলে। এসব অনিশ্চয়তা, দুঃখ-কষ্ট, উদ্বেগ, ভয়-ভীতি, আর্থিক অনটনের মধ্যেই পবিত্র ঈদ গেছে দুটি।
বাংলা নববর্ষ গেছে। স্বাধীনতা দিবস গেছে। শোকের মাস গেছে। কোনোটাই যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে পালন করা যায়নি। এই যে পরিস্থিতি, এর মধ্যে আমাদের ব্যক্তিগত জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন, অর্থনৈতিক জীবন কেমন হওয়া উচিত? ব্যয়ের প্রশ্নে, খরচের প্রশ্নে আমাদের কেমন হওয়া উচিত?
মানুষ দুর্দিনে, দুঃসময়ে, অনিশ্চয়তার জীবনে সাবধানী হয়। খরচের বেলায় মিতব্যয়ী হয়, অপচয় বন্ধ করে, ভোগ কমায়। সাবধানী হয় সবকিছুতে। সরকারের কী করা উচিত? সরকারেরও তাই করা উচিত। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি উল্টোটি চলছে সরকারি বিভাগগুলোতে। খরচের ক্ষেত্রে, উন্নয়ন প্রকল্পের ক্ষেত্রে চলছে আগের মতোই যথেচ্ছাচার। এর প্রমাণ কী? প্রমাণ হিসেবে যুগান্তরের ১৯ তারিখের একটি খবরের আশ্রয় নিচ্ছি। এর শিরোনাম : ‘করোনায় কৃচ্ছ্রসাধন উপেক্ষিত পুনর্মূল্যায়ন ছাড়াই চলছে প্রকল্প অনুমোদন’।
এ খবরের ভেতরে বলা হয়েছে নতুন পরিস্থিতি বিবেচনায় না নিয়ে প্রকল্প অনুমোদন দিচ্ছে পরিকল্পনা কমিশন। বলাই বাহুল্য, করোনা-পূর্ববর্তী সময়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেক প্রকল্প অনুমোদন প্রক্রিয়ায় ছিল। এখন সম্পূর্ণ পরিবর্তিত সময়। টাকা-পয়সার অভাব। এমন দিনে তো দরকার এমন প্রকল্প অনুমোদন করা, যা রাজনৈতিক বিবেচনাপ্রসূত নয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তা তো হচ্ছেই, সঙ্গে সঙ্গে চলছে : ‘পণ্য কেনায় অতিরিক্ত দর, শিক্ষা সফরের নামে বিদেশ ভ্রমণ, আপ্যায়ন, পরিদর্শন বাংলো নির্মাণ, চলচ্চিত্র, অডিও-ভিডিও নির্মাণ, অতিরিক্ত পরামর্শকসহ নানা ধরনের ব্যয় প্রস্তাব’ পাস। যুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে এগুলো আগের প্রকল্প।
পুনর্মূল্যায়ন করতে গেলে অনেক সময় নষ্ট হবে। এ যুক্তির বিরুদ্ধে কোনো জবাব নেই। কিন্তু প্রশ্ন বিলম্ব ঘটা নয়। প্রশ্ন অন্যত্র। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন কঠোরভাবে অগ্রাধিকার নির্মাণের প্রশ্ন। খরচ করার মতো টাকা আছে কিনা তা দেখার প্রশ্ন। কারণ প্রকল্প পাস করলেই তো হবে না, তাতে টাকা জোগান দিতে হবে। টাকা বরাদ্দ দেবে অর্থ মন্ত্রণালয়। তাদের অবস্থা কী? তাদের হাতে রাজস্ব টাকা আছে কি? ২০২০-২১ অর্থবছরের কথা জানি না।
অর্থমন্ত্রীর তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি তো দূরের কথা, এর পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় তা ৫ হাজার কোটি টাকা কম হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের রাজস্ব আয়ের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১৮ হাজার ৪০১ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরের অবস্থা কী? এ অর্থবছরের দুই মাস যাচ্ছে। আগামী নভেম্বরে করদাতারা কর-রিটার্ন জমা দেবেন। কোম্পানিগুলো দেবে। কী অবস্থা দাঁড়াতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
লোকের আয় কমেছে। সবচেয়ে বেশি কর দেয় সিগারেট কোম্পানি এবং ব্যাংকগুলো। তারা কি গেল বছরের মতো কর দিতে পারবে? ভ্যাট, আমদানি শুল্ক কি আগের পর্যায়ে থাকবে? নতুন নতুন ক্ষেত্র কি আবিষ্কৃত হবে যেখান থেকে অধিকতর রাজস্ব আসবে? এ সবই এখন অনিশ্চিত। দেখা যাচ্ছে সরকার যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছে তা ব্যাংক ঋণনির্ভর। রাজস্ব বাজেটের টাকা এখানে খুবই কম।
এর থেকেই বোঝা যায়, সরকারের রাজস্ব পরিস্থিতি কী। হতে পারত এ দুর্দিনে দেশের ধনীরা সরকারকে সাহায্য করছে, মানুষকে দান-দক্ষিণা দিচ্ছে যেমন দিচ্ছে ভারতীয় ধনীরা। ভারতের দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ ধনী ‘আইটি জায়েন্ট’ আজিম প্রেমজি হাজার কোটি টাকা করোনার সময় সাহায্য হিসেবে খরচ করবেন। এ তালিকায় বড় বড় ধনীরা রয়েছেন। আমাদের অবস্থা কী তা আমরা জানি। ধনীদের কাছ থেকে সাহায্য আসছে না।
এমন কী একজন ধনী দিনে ২-৩ হাজার অসহায় মানুষকে খাওয়াচ্ছে এমন খবরও পাচ্ছি না। এমতাবস্থায় সরকারই ভরসা। মানুষ কর না দিতে পারলে, বেচাকেনা না বাড়লে, আমদানি-রফতানি না বাড়লে সরকার টাকা পাবে কোথায়? নোট ছাপিয়ে কাজ চালাবে? এটা হলে তো তা হবে ভয়াবহ খবর। সরকারের ঘাটতি অর্থায়নেরও সীমা আছে। এমতাবস্থায় করণীয় কী?
করতে চাইলে, ইচ্ছা থাকলে কিছু করণীয় আছে। আমরা জানি উন্নয়ন প্রকল্পের ক্ষেত্রে এক টাকার কাজ দুই-তিন টাকায় হয়। এটা নতুন ঘটনা নয়। এ কথা আকারে-ইঙ্গিতে স্বয়ং পরিকল্পনামন্ত্রী পর্যন্ত স্বীকার করেছেন। এ মাসের ১৪ তারিখের একটি খবরের শিরোনাম : ‘সরকারি ক্রয় নিয়ে উদ্বিগ্ন পরিকল্পনামন্ত্রী’। তিনি বলছেন, ‘ক্রয় প্রক্রিয়া ও কিছু ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিয়ে আমি বেশ উদ্বেগে আছি।’ সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বলছেন, ‘জনগণের অর্থ ব্যয়ে কোনোভাবেই নয়ছয় হতে দেয়া হবে না।’
বোঝা যাচ্ছে তিনি কঠোর অবস্থানে। কিন্তু বাস্তবে কতটুকু তিনি করতে পারবেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথায় বলতে হয় চারদিকে ‘উইপোকা’। কাকে ধরবেন, কাকে ছাড়বেন। অবস্থা এমন হওয়াতেই আমাদের এক টাকার কাজ দুই-তিন টাকায় করতে হয়। এর জন্য বাজেট প্রতিবছরই বড় হচ্ছে। আর বলা হচ্ছে এযাবতকালের সর্বোচ্চ বাজেট। এটা আত্মপ্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।
সত্যিকার কাজ হলে, খরচের গুণগত মান বৃদ্ধি হলে বর্তমান উন্নয়ন প্রকল্পের টাকাতেই কমপক্ষে দ্বিগুণ কাজ করা সম্ভব হতো। অবশ্য একশ্রেণির লোকে বলেন, খরচের ব্যাপারে বেশি কড়াকড়ি করা হলে সব কাজের গতি শ্লথ হয়ে পড়বে। বেশি বেশি দরে সরকারি ক্রয় মানেই হচ্ছে তা ‘মটিভেশন’। সর্বত্রই তা পরিচিত ‘টেবিল মানি’ হিসেবে। মহামুশকিল, যদি এ অবস্থাই হয় তাহলে উন্নয়ন প্রকল্পের খরচ কমানো কি সম্ভব? কৃচ্ছ্রসাধন কি সম্ভব? এটা না হয় উন্নয়ন প্রকল্পের কথা। রাজস্ব বাজেটের অবস্থা কী?
যুগান্তরে একটি খবর ছাপা হয়েছে গত মাসের ২০ তারিখে। শিরোনাম : ‘গরিবের চালে ধনীর থাবা, সাড়ে চার লাখ ভুয়া কার্ড বাতিল’। এটি খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির খবর। খবরে দেখা যাচ্ছে, এখন পর্যন্ত সারা দেশে ৪ লাখ ৫১ হাজার ১২৪টি ভুয়া কার্ডের সন্ধান পাওয়া গেছে। বলাই বাহুল্য, এসব চাল গরিবের জন্য। প্রধানমন্ত্রী ২০১৬ সালে এ কর্মসূচি উদ্বোধন করেন। এর মাধ্যমে দেশের দরিদ্র ৫০ লাখ পরিবারকে ১০ টাকা কেজিতে চাল দেয়া হয়।
ভাবা যায় এ দরিদ্রদের চালে পর্যন্ত ধনীদের থাবা বসেছে! শুধু এ কর্মসূচি নয়, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অধীনস্থ তালিকাতেও তাই। স্কুল নেই, শিক্ষক নেই- বেতন দেয়া হচ্ছে। হাসপাতালের খাবার বিক্রি হচ্ছে বাইরে। জেলখানার কয়েদিরা খাবার পায় না। একটা বাল্ব, বালিশ, ড্রামের দাম নিয়ে কত স্টোরি আমরা কাগজে পড়ি। এক কথায় রাজস্ব বাজেটেও একই ঘটনা। অথচ কী উন্নয়ন বাজেট, কী রাজস্ব বাজেট- এ সবের খরচে গুণগত মান বৃদ্ধি করতে পারলে বাজেটের এক-তৃতীয়াংশ টাকার সাশ্রয় হয়। এটা তো করার সময় এখনই। দুর্দিনে না করলে আমরা তা কবে করব?
২০২০-২১ অর্থবছরটি আমাদের জন্য কঠিন বছর। অবশ্য অনেক দেশের জন্যই কঠিন বছর এটা। শুধু ২০২০-২১ অর্থবছর নয়, আমরা কবে বর্তমান ধস থেকে উঠে দাঁড়াতে পারব তা কেউ জানি না। অনেকের মতে, দুই-তিন বছর লাগবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে। ইতোমধ্যেই আমরা দ্বিতীয় ধনী দেশ চীনের অবস্থা জেনেছি। ‘করোনা’ ও বন্যায় তাদের প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। তাদের রফতানি ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাচ্ছে। আমেরিকা-চীন বাণিজ্যিক দ্বন্দ্ব চলছে। ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে চীনের বাণিজ্যিক-আর্থিক সম্পর্ক খারাপ হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব চীন সাগরে প্রায় যুদ্ধ পরিস্থিতি। হংকংয়ে সংকট, তাইওয়ানে সংকট।
শ্রীলংকার হামবান টোটায় চীনারা যে বন্দর ‘লিজ’ নিয়েছে তাকে শ্রীলংকা এখন বলছে ‘ভুল-সিদ্ধান্ত’। মালদ্বীপে চীনা বড় বড় প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হচ্ছে। একদিকে করোনাজনিত ধস, অন্যদিকে বাণিজ্যিক ও আর্থিক সংঘর্ষ। এরই মধ্যে চীনের প্রেসিডেন্ট সতর্ক করেছেন দেশবাসীকে। সামনে কঠিন দিন আসছে। খাদ্য অপচয় বন্ধ করার জন্য তিনি আহ্বান জানিয়েছেন। অভ্যন্তরীণ বাজার সৃষ্টির কথা বলেছেন।
ভারত বলছে আত্মনির্ভর ভারতের কথা। এটা কিন্তু সম্পূর্ণ নতুন পরিস্থিতি। বাজার অর্থনীতি যায় যায়। বাণিজ্যিক দ্বন্দ্ব তুঙ্গে। স্বাদেশিকতার আবির্ভাব ঘটছে। তার মানে করোনা-পরবর্তী পৃথিবী হবে সম্পূর্ণ নতুন পৃথিবী। সব কিছুই অপরিচিত লাগবে। অনিশ্চয়তা চলবে অনেকদিন। এ অবস্থায় অপচয় বন্ধ করা দরকার নয় কি? নয় কি কৃচ্ছ্রসাধন করা?
ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Leave a Reply