কেবল জুলাই–আগস্ট মাসে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদেই কি লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিলেন? আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ জুলুমের ইতিহাস থেকে মানুষের মনে যে ক্ষত জন্ম নিয়েছিল, সেখান থেকেও অনেকে পথে নেমেছেন। একের পর এক আন্দোলন দমন, গুম, খুন, আয়নাঘর ইত্যাদি মানুষের মনে দাগ কেটেছে। জুলুমের ফলাফল হিসেবে যেভাবে জুলাই অভ্যুত্থান হয়েছে, তা নিয়ে লিখেছেন অনুপম দেবাশীষ রায়
একটি বুলেট যখন বন্দুকের নল থেকে বের হয়, সেটার ওপর কারও নাম লেখা থাকে না। কিন্তু যখন সেটা একজন ন্যায্য দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রের বুক ভেদ করে, সেই বুলেটই লিখে ফেলে ইতিহাস, রচনা করে একটা অন্যায্য রাষ্ট্রযন্ত্রের ‘ডেথ ওয়ারেন্ট’।
যখন রাষ্ট্র কাউকে খুন করে, সেটাকে সব সময় জুলুম, বিশেষত অসহনীয় জুলুম হিসেবে আমরা দেখি না। অপরায়িত কোনো জনগোষ্ঠীর কাউকে মারলে অনেক সময় সেটা আমাদের মানসপটেও ধরা দেয় না।
কিন্তু যখন একজন নিরস্ত্র সাধারণ ছাত্রকে ঠান্ডা মাথায় খোলা রাজপথে হত্যা করা হয় আর সেটা মানুষ ক্যামেরাবন্দী করে ফেলেন, তখন সেই রাষ্ট্রের জুলুমকে আর অন্য কোনো নাম দেওয়া যায় না; যতই ‘ড্রাগ তত্ত্ব’ রাষ্ট্র হাজির করুক না কেন, হত্যার চেয়ে স্পষ্টতর জুলুম আর হয় না।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ডিফিল (পিএইচডি) গবেষণা মূলত জুলাই অভ্যুত্থান নিয়েই। আমার বিশ্লেষণ বিস্তৃত হলেও আমার কিছু তত্ত্ব আজ পাঠকের কাছে তুলে ধরতে চাই। আশাকরি এর মাধ্যমে কিছু প্রতিক্রিয়া পাব, যা আমার গবেষণা আরও ঋদ্ধ করবে। প্রাথমিকভাবে শুরু করি ইতিমধ্যে হাজির করা কিছু তত্ত্বকে।
‘ছাত্র’ পরিচয়টি জুলাইয়ের গতিপ্রকৃতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ‘ছাত্র’ পরিচয়টি একপ্রকার পবিত্রতার শামিল। একই সঙ্গে ঐতিহাসিক বাস্তবতার কারণে ছাত্রদের সংগ্রামের বাহক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেই ছাত্রদের বুকে গুলি চালিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো সরকারই বেশি দিন টিকতে পারেনি।
‘ছাত্রখুনি’ তকমা লেগে গেলে সেটি কাজ করে একটি অমোচনীয় কলঙ্ক হিসেবে। শ্রমিক হত্যা আমাদের দেশে হরেদরে হয়। এমনকি অভ্যুত্থানের পরও পোশাকশ্রমিককে হত্যা করেছে পুলিশ। কিন্তু সমশ্রেণির না হওয়ায় আর শ্রেণি বিভাজনের তীব্রতায় শহুরে মধ্যবিত্ত তা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায়নি।
জুলাইয়েও বহু শ্রমিক বা ছিন্নমূল মানুষ জীবন দিয়েছেন। কিন্তু এখনো শহীদ বলতে মানুষ সবচেয়ে বেশি আবু সাঈদ আর মুগ্ধের নাম নেন। কেননা, তাঁরাই রূপান্তরকারী ঘটনা তৈরি করার জন্য মধ্যবিত্ত জনমানসে একেকজন ‘যোগ্য’ শহীদ, যে জায়গায় দলীয় রাজনীতি করা ওয়াসিমরাও পৌঁছাতে পারেননি। জুলাই আন্দোলনটি সফল হওয়ার একটি অন্যতম কারণ ছিল এর কৌশলগত ‘অরাজনৈতিকতা’; অর্থাৎ আন্দোলনকে দলীয় রাজনীতির কলুষমুক্ত হিসেবে উপস্থিত করা।
প্রাথমিক ধারণা থেকে বলা যায় যে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়াটি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। কেননা তৎকালীন সরকারের এই মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্তই লাখো মানুষকে পথে নিয়ে এসেছিল। যাঁরা হয়তো কেবল অনলাইনেই তাঁদের প্রতিবাদ সীমিত রাখতেন।
সরকারের বাসনা ছিল ইন্টারনেট বন্ধ করে আন্দোলনকে স্তিমিত করা। কিন্তু আদতে তা আন্দোলনকে আরও শক্তিশালীই করেছে। যদিও এটি একমাত্র কারণ নয়, ইন্টারনেট শাটডাউন আন্দোলনকে অফলাইনে রূপান্তরের অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিল, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণির জন্য।
৪. কিন্তু লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে আসা কি কেবল ইন্টারনেট বন্ধ বা ছাত্রহত্যার জন্য? আমার ধারণা, আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ জুলুমের ইতিহাস থেকে মানুষের মনে যে ক্ষত জন্মেছিল, সেখান থেকেও অনেকে পথে নেমেছেন। একের পর এক আন্দোলন দমন, গুম, খুন, আয়নাঘর ইত্যাদি মানুষের মনে দাগ কেটেছে। অনেকেই একেবারে সরাসরি আওয়ামী লীগের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
গবেষণার কাজে নেমে আমি এমন ১০০টির বেশি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বিবরণের একটি ডেটাবেজ পেয়েছি, যেখানে স্পষ্টত ছাত্রলীগের নির্যাতনে মানুষের ভুক্তভোগী হওয়ার বর্ণনা রয়েছে। এখন যদি তাঁদের সার্ভে করা হয়, আমার ধারণা, এ রকম দেখা যাবে যে এঁদের একটি বড় অংশই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কোনো না কোনো আন্দোলনে গেছে।
এসব গল্পের বাইরে আরও হাজার হাজার গল্প রয়েছে। এসব ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এসেছে। আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর সবচেয়ে পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হয়েছে যে আওয়ামী লীগ আমলের শুরু থেকেই ছাত্রলীগ একটি সন্ত্রাসী সংগঠন ছিল; হাল আমলের সরকারি ঘোষণার বহু আগে থেকেই।
কেবল ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডের কারণেই বহু ছাত্রছাত্রীর চোখে আওয়ামী লীগ ধরা দেয় একটা ‘দানব’ হিসেবে; এমন এক দানব, যাকে বধ করা একটি নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে প্রতীয়মান হয়। সেই আবেগ থেকেই অনেকে আন্দোলনে এসেছেন বলে আমার বিশ্বাস, যেটি শিগগিরই আমি উপাত্ত সংগ্রহের মাধ্যমে যাচাই করব।
৫. এ ছাড়া বড় বড় জুলুমের ঘটনা, যেমন গুম, খুন, আয়নাঘর, দুর্নীতি, অর্থ পাচার—এগুলোও শিক্ষার্থীদের ছাড়াও সাধারণ মানুষকে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে তাতিয়ে তুলেছে। তাঁদের চোখেও আওয়ামী লীগ সরকার অন্যায্য বলে ধরা দিয়েছে। এই কারণেই ১৮ জুলাইয়ের পর ছাত্রসমাজের বাইরেও লাখ লাখ সাধারণ মানুষ কোটা আন্দোলনকে শেখ হাসিনার পতনের আন্দোলনের দিকে ধাবিত করেছেন।
আবু সাঈদের হত্যাকাণ্ডের খবর জনগণের কাছে পৌঁছানোর পরই এই আন্দোলনের এক দফায় যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না। যদিও অনেকে দাবি করছেন যে হাসিনাকে উৎখাত করা একটা দীর্ঘ পরিকল্পনার ফসল, আমার মনে হয় যে এই আন্দোলনের নিজস্ব একটি গতি ছিল, একটি ভরবেগ ছিল।
এই ভরবেগ তৈরি হয়েছে একের পর এক রূপান্তরকারী ঘটনা আর শাহাদাতের কারণে। সেই মুহূর্তের ভরবেগে আন্দোলন স্বাভাবিকভাবেই চূড়ান্ত পর্যায়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। কোনো তরফ থেকে এক দফার ঘোষণা না এলেও, মানুষই এক দফার আন্দোলনের দিকেই যেতেন। আর সেই সময়ে এক দফার ঘোষণা দেওয়া ছাড়া নেতৃত্বের কাছে আর কোনো উপায়ও ছিল না।
আমার উপাত্ত বলছে, একই বিভাগে যেদিন হত্যা হয়েছে, তার সঙ্গে পরবর্তী দিনের আন্দোলনের সংখ্যার একটি পরিসংখ্যানগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে একই উপাত্তের আরও কিছু বিশ্লেষণ বলছে যে অপরাপর দমন বা জুলুমও বিশেষভাবে আন্দোলনকে বেগবান করেছে। যেমন আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ হয়ে দাঁড়িয়েছে পরবর্তী দিনে আন্দোলনের ঘটনা সংখ্যার বিশেষ এক পূর্বাভাসদানকারী।
অতএব, কেবল আন্দোলনের আগে ঘটে যাওয়া দীর্ঘ দেড় দশকের জুলুমই নয়; বরং চলমান জুলাইয়ের প্রত্যক্ষ জুলুম প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করেছে।
এই ফলাফল সামাজিক আন্দোলন তত্ত্বের একটি বড় ধারণার বিরুদ্ধে যায়, যেটি বলে যে আন্দোলন চূড়ান্ত তীব্র হলে আন্দোলন কেবল বেগবান হয় না, বরং দমেও যায়। কিন্তু আমাদের জুলাই জুলুমে দমে যায়নি। সে জুলুমের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলেছে যে সে এই জুলুমকে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত করবে।
৭. এ বছরের বইমেলায় প্রকাশিত বিদ্রোহ থেকে বিপ্লব বইয়ে আমি দাবি করেছি যে জুলাইয়ের নাড়ি পোঁতা আছে ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মধ্যে। তবে এখন আমি বিশ্বাস করি যে জুলাইয়ের শুরু হয়েছে আরও অনেক আগেই, যা অনেকেই এখন বলছেন বা অন্তর্বর্তী সরকারের ফেসবুক পেজও তা দাবি করছে।
এসব জুলুমের একটি খতিয়ান ও মানুষের দৃষ্টিতে তার প্রভাব যাচাই করা গবেষকদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হতে পারে। কোন জুলুম মানুষ মনে রাখে আর কোন জুলুম তাঁকে জীবন বাজি রেখে রাজপথে নিয়ে আসে, তার একটা সুলুক সন্ধান করতে পারলে সামাজিক আন্দোলন গবেষণার ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত শক্তিশালী একটি ভূমিকা রাখতে পারে।
কেবল এ কারণেই নয়, বরং ভবিষ্যতের রাজনীতির জন্যও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ; যেন ভবিষ্যতের কোনো সরকারও আওয়ামী কায়দার জুলুম ফিরিয়ে আনার কথা ভাবতে না পারে। কারণ, আওয়ামী জুলুম যেমন জুলাইকে জ্বালিয়েছে, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, যাঁরা কখনো কোনো জুলুমের অপমান ভোলেন না, তাঁরাও অন্য কোনো জুলুমবাজকে আবারও উৎখাত করতে পিছপা হবেন না।
৮. জুলাই কেবল শিক্ষায়তনিক গবেষণার বিষয় নয়, এটি একটি জাতিগত উপলব্ধি ও মর্মবোধের সময়। এই আন্দোলনের মূল আকাঙ্ক্ষা ছিল রাষ্ট্রযন্ত্রসহ সমগ্র ব্যবস্থাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে নতুন একটি ন্যায্য সমাজ গড়ে তোলা।
সেই লক্ষ্য থেকে আমরা আজও অনেক দূরে। জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তির এই সময়ে আমাদের সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়ার শপথ নেওয়ার একটি মোক্ষম সময় এসে উপস্থিত হয়েছে।
আমাদের নিশ্চিত করতে হবে, যেন পূর্ববর্তী আন্দোলনগুলোর মতো জুলাইও পরিপূর্ণভাবে একটি ‘বেহাত বিপ্লব’ না হয়ে যায়। সে জন্য আন্দোলনকারী ছাত্র–জনতাসহ সাধারণ মানুষকে কাজ করতে হবে, যেন অন্তর্বর্তী সরকার বা তার পরবর্তী নির্বাচিত সরকার মৌলিক সংস্কারের লক্ষ্যে কাজ করে আর একটি ন্যায্য রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে তোলার কাজে নিয়োজিত হয়। তা না হলে মানুষকে আবার পথে নামতে হবে, আবারও রক্ত দিতে হবে, জীবন দিতে হবে।
তবে আমি আশা করব যে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমরা সক্রিয় করতে পারব, যাতে আর আমাদের সাধারণ মানুষকে রক্ত দিতে না হয়। সেই লক্ষ্যে কাজ করাই হোক আমাদের জুলাইয়ের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে গণশপথ।
Leave a Reply