আমাদের দেশে কোনো একটা বিশেষ ইস্যু বা সমস্যা সামনে চলে এলে অন্য সব সমস্যা আড়ালে চলে যায়। এ বছর যেমন চাপা পড়ে গেছে ডেঙ্গু ইস্যু। বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়লেও বিষয়টি নিয়ে তেমন একটা আলোচনা হয়নি। সবাই করোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ডেঙ্গুজ্বর আলাদা করে গুরুত্বও পায়নি। কিন্তু ধারাবাহিক উপেক্ষা ও অবহেলায় কয়েকদিন ধরে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। চলতি মাসেই আক্রান্ত হয়েছে অন্তত পাঁচশ জন। অনেকের মৃত্যুও হয়েছে। তার পরও বিষয়টি যথাযথ গুরুত্ব পাচ্ছে না।
কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত মানুষের রোগভোগ ও অনেকের অকালমৃত্যু এক নিয়মিত দৃশ্যে পরিণত হয়েছে। বলা যায়, এটা একটা বার্ষিক আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। গত বছর সরকারি হিসাবে লক্ষাধিক ব্যক্তি আক্রান্ত এবং ১৭৯ জনের মৃত্যুর পর এ নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা হয়েছে, কিন্তু কার্যকর ও স্থায়ী ব্যবস্থা তেমন নেওয়া হয়নি।
ডেঙ্গু ছড়ায় এডিস মশার কারণে। ডেঙ্গুজ্বরের জীবাণুবাহী মশা কোনো ব্যক্তিকে কামড়ালে সেই ব্যক্তি চার থেকে ছয় দিনের মধ্যে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হন। এবার এ আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোনো জীবাণুবিহীন এডিস মশা কামড়ালে সেই মশাটিও ডেঙ্গুজ্বরের জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয়। এভাবে একজন থেকে অন্যজনে মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়িয়ে থাকে।
ডেঙ্গুতে সাধারণত তীব্র জ্বর এবং সেই সঙ্গে শরীরে প্রচ- ব্যথা হয়। জ্বর ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়। শরীরে বিশেষ করে হাড়, কোমর, পিঠসহ অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশিতে তীব্র ব্যথা হয়। এ ছাড়া মাথাব্যথা ও চোখের পেছনে ব্যথা হয়। গায়ে রেশ হতে পারে। এর সঙ্গে বমি বমি ভাব হতে পারে।
ডেঙ্গু ভাইরাস থেকে মূলত দুই ধরনের সংক্রমণ হয়- সাধারণ ডেঙ্গুজ্বর ও মরণাত্মক ডেঙ্গু হেমারেজিক ফিভার বা ডেঙ্গু সিনড্রোম শক। যদিও চটজলদি রোগ নির্ণয় এবং হাসপাতালে আপৎকালীন শুশ্রুষার মাধ্যমে দ্বিতীয় ক্ষেত্রে মৃত্যুর ঝুঁকি অনেকটাই এড়ানো যাচ্ছে, তবুও মৃত্যু ঘটছে। কারণ আজ পর্যন্ত এই ধরনের জ্বরের সঠিক চিকিৎসা বেরোয়নি।
মানবদেহে ডেঙ্গুর সংক্রমণ পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল। এপিডেমিয়োলজির তত্ত্ব বলছে, অনুকূল পরিবেশে (ঠিক বর্ষা-পরবর্তী সময়ে) এই রোগের ভাইরাস মশা দ্বারা মানবদেহে বসতি বিস্তার ও সংক্রমণ ঘটায়। যেহেতু ডেঙ্গু রোগের সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি বা প্রতিষেধক টিকা এখনো উদ্ভাবন হয়নি, তাই মশা নিধনযজ্ঞ বিনা আর কোনো উপায় নেই। আর ঠিক এখানেই চিকিৎসাশাস্ত্র মুখ থুবড়ে পড়েছে। কারণ মশাকে প্রতিষেধক দিয়ে প্রি-প্রোগ্রামও করা যায় না বা ওষুধ দিয়ে রি-ফিক্সও করা যায় না।
ডেঙ্গুকে জনস্বাস্থ্যের প্রেক্ষাপটে বুঝতে হবে, যার ব্যাপ্তি চিকিৎসাশাস্ত্র থেকে বহুগুণ বেশি। জনস্বাস্থ্যের প্রেক্ষিতে দেখলে, ডেঙ্গুর অন্যতম কারণ হলো অপরিকল্পিত নগরায়ণ। মশা নিধনে ক্রমাগত ব্যর্থতা, ক্রমবর্ধমান বিশ্বায়ন এবং অবশ্যই রোগ নিরাময়ে চিকিৎসাশাস্ত্রের আশানুরূপ অগ্রগতি না হওয়া। প্রতিষেধক টিকা উদ্ভাবনের বিষয়টি যেহেতু আমাদের নাগালের বাইরে, তাই অন্য সব প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়েই আমাদের ভাবতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে ইস্যুটি সব সময়ই কম গুরুত্ব পেয়ে এসেছে।
অথচ ডেঙ্গু কিন্তু করোনার চেয়ে কম ভয়াবহ নয়। ডেঙ্গু পরিচিত ‘নেগলেক্টেড ট্রপিকাল ডিজিস’ নামে। কীটতত্ত্ববিদদের মতে, ডেঙ্গুর প্রাণভোমরা একটি পজিটিভ সেন্স ‘আরএনএ’ সরাসরি তিনটা ‘স্ট্রাকচারাল’ ও সাতটা ‘নন-স্ট্রাকচারাল’ অর্থাৎ ১০টি প্রোটিন সংশ্লেষণে সক্ষম। সাধারণ ডেঙ্গুজ্বর থেকে ভয়াবহ ডেঙ্গু হেমারেজিক ফিভার বা ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে পৌঁছে দেওয়ার মূল আসামিও সাতটি নন-স্ট্রাকচারাল প্রোটিন। ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপের ৬৫ শতাংশ জিনোম হুবহু সদৃশ, বাকি ৩৫% আলাদা। ডেঙ্গু ভাইরাসের সংক্রমণে প্রথম পাঁচ-সাত দিনের (ইনকিউবেশন পিরিয়ড) জ্বর, গা ব্যথা সাধারণ প্যারাসিটামলেই সেরে যাবে। কিন্তু যাবতীয় প্রাণঘাতী ডেঙ্গুর সূচনাও হয় ডেঙ্গুর জ্বর নেমে যাওয়ার পরই।
ডেঙ্গু ভাইরাস শরীরে ঢোকার পর অ্যান্টিবডির সঙ্গে যুদ্ধে তার প্রাণভোমরা আরএনএ ভেঙেচুরে ছত্রখান হয়ে যায়। প্রথমদিন প্রবল জ্বর, তিন চার দিনের মাথায় গা-হাত-পায়ে ব্যথা তার পর বেশ ফুরফুরে শরীর। এই ‘ডিফারভেসেন্স’ পর্যায়ে ঘরের শত্রু বিভীষণ, শরীরের ‘পিএলসিই ওয়ান’ বা ক্রোমোজোমের ‘এমআইসিবি জিন’ উল্টো পথে হেঁটে সশরীরের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ভাইরাসের পক্ষে শরীরকে কাবু করে দেওয়ার কাজটা তখন সহজ হয়ে ওঠে। এই পর্যায়টি ‘ডেঙ্গু ভা¯ু‹লার পারমিয়েবিলিটি সিনড্রোম’ বা ডিভিপিএস নামে পরিচিত। যারা দ্বিতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন বা যারা অতিরিক্ত মোটা বা যারা উচ্চ রক্তচাপ-ডায়াবেটিস-হৃদরোগে ভুগছেন তাদের ক্ষেত্রে ডেঙ্গু যে কোনো সময় মৃত্যুর কারণ হতে পারে ‘ডিভিপিএসের’ সৌজন্যেই।
গবেষণা বলছে, পরিষ্কার পানির তুলনায় ‘সেপটিক ট্যাঙ্কে’ বহুগুণ বেশি ডেঙ্গুর মশা জন্মায়। নিদাঘ-তপ্ত গ্রীষ্ম থেকে বর্ষার অঝোর বারিধারা সেপটিক ট্যাঙ্কে মশার জন্মহার বিরামহীন। ভেক্টরের ঘনত্ব নির্ধারিত হয় পিউপার জন্মের হারেই। ভেক্টর অর্থাৎ মশার সংখ্যা যত বাড়বে ততই মহামারীর আশঙ্কা বাড়বে। ভাঙা, অনাচ্ছাদিত ও সেপটিক ট্যাঙ্কের ‘পিএইচের’ সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে পিউপার গগনচুম্বী বৃদ্ধির। সেপটিক ট্যাঙ্কের পিউপা আকারে বিভিন্ন পাত্রের জমা পরিষ্কার পানির পিউপার তুলনায় ৩৯ গুণ বড় হয়। সেপটিক ট্যাঙ্কের পরিপোষক পদার্থেই পিউপার দৈহিক বৃদ্ধি ৩৯ গুণ বেশি হয়। সংখ্যা এবং আয়তনে ৩৯ গুণ বেশি পূর্ণাঙ্গ মশা কী পরিমাণ ‘ভাইরাল লোড’ বহনে সক্ষম তা সহজেই অনুমেয়।
বড় গাছের ছায়াঘেরা পরিত্যক্ত আবর্জনা ফেলার জায়গায় সামান্য ছেঁড়া প্লাস্টিকের ক্যারি-ব্যাগে বা জমা জলেও ডেঙ্গুর মশা সহজে জন্মায়, বড় হয়। ডেঙ্গু মশা ৪০০ মিটার ব্যাসার্ধে উড়তে পারে, সুতরাং অন্দরমহলে প্রবেশের পর বাইরে বেরোনোর খুব একটা প্রয়োজন পড়ে না। তাই পরিবেশের তারতম্যে ডেঙ্গু মশার খুব একটা কিছু যায় আসে না। নর্দমা বা জলাধার ঢাকা থাকলে ডেঙ্গুর মশার বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়। যেহেতু বাড়ির মধ্যে বা বাড়ির কাছাকাছি ডেঙ্গু মশার অধিষ্ঠান তাই দিন-রাত যে কোনো সময়ই ডেঙ্গুর মশা কামড়াতে পারে। কামড়ের সংখ্যা বাড়লে প্রাণঘাতী ডেঙ্গু-জিকা-চিকুনগুনিয়া একই সঙ্গে ছড়াতে পারে। সেপটিক ট্যাঙ্ক, ঢাকা জলাধার বা নর্দমার মশার বংশ নাশ ও পরিবেশ পরিচ্ছন্ন না হলে ডেঙ্গুর মৃত্যু মিছিল আটকানো অসম্ভব। সুতরাং মানুষ ও সরকার- দুজনেরই সমান সচেতনতা জরুরি।
সিটি করপোরেশন বা সরকার মশা মারতে সচেষ্ট, সেটা ঠিক। কিন্তু মশা নিধন যদি ঠিকভাবেই হয়, তা হলে ডেঙ্গুর রমরমা বজায় থাকছে কী করে? এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য দপ্তরের বা ঢাকা সিটি করপোরেশন বা অন্যান্য পৌরসভার স্বাস্থ্যকর্মীদের মশা নিধনে অদক্ষতা নয়, বরং অপরিকল্পিত নগরায়ণ দায়ী। নগরায়ণের নীতি ও রূপরেখায় এবং নগর পরিচালনায় জনস্বাস্থ্যের দিকটি রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই অত্যন্ত অবহেলিত। যে কোনো মশাবাহিত রোগের উৎপত্তি সাধারণত শহরকেন্দ্রিক, কারণ শহরের জনবহুল, ঘিঞ্জি, অপরিষ্কার পরিবেশ মশা জন্মানো এবং দ্রুত রোগ সংক্রমণের জন্য আদর্শ।
গবেষণায় দেখা গেছে, মশা জন্মানোর সঙ্গে সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার পরিষেবা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শহরের বর্জ্য নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় কিনা, বর্জ্যরে পরিবহন ব্যবস্থা কেমন; সব সময় নলবাহিত পানি পাওয়া যায়, নাকি রান্না ও পানের জন্য পানি ধরে রাখতে হয়, যে জমা পানিতে মশা জন্মায়; নির্মাণকাজগুলো বর্ষার সময় অসমাপ্ত না রেখে সময়মতো শেষ করা হয় কিনা; জলাশয়গুলো নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় কিনা; খাল-বিল-নর্দমা নিয়মিত সংস্কার হয় কিনা- সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার পরিষেবাসংক্রান্ত এই প্রশ্নগুলো মশাবাহিত রোগের ক্ষেত্রে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এই বিষয়গুলো মশা জন্মানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
আমাদের সিটি করপোরেশনের মশা মারার কাজে গাফিলতি সুবিদিত। শহরের সব ড্রেন, নির্মাণাধীন স্থাপনা, বিল্ডিংয়ের ভেতরে যত্রতত্র জমে থাকা পানি ও আগাছার সন্ধান পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যকর্মীরা পান না। মশা নিধন তো দূর অস্ত। আছে বিভিন্ন দপ্তর ও বিভাগের মধ্যে সমন্বয়ের সমস্যা।
আমাদের দেশের স্বাস্থ্যনীতি ক্রমেই অভিমুখ পাল্টেছে। এখন তা চিকিৎসাকেন্দ্রিক। জনস্বাস্থ্য সেখানে উপেক্ষিত। অনেক উদ্যোগ-আয়োজনের পর এখনো করোনার চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা যায়নি। করোনা পরীক্ষা নিয়ে ভোগান্তি এখনো কমেনি। এ পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু প্রতিরোধের কথার উল্লেখ করার ভাবনাটাই মনে আসে না। অথচ জনস্বাস্থ্য হলো জননীতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। জনস্বাস্থ্যকে বাদ দিয়ে জননীতির পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন হলে তা জনস্বার্থের পরিপন্থী হয়। আমাদের দেশে হচ্ছেও তাই।
করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণেও সরকারকে ব্যাপক কর্মসূচি নিতে হবে। তা না হলে বসে বসে মৃত্যুর মিছিল দেখা কিংবা সেই মিছিলে যোগ দেওয়া ছাড়া নাগরিকদের আর কোনো কিছুই করার থাকবে না।
চিররঞ্জন সরকার : কলাম লেখক
Leave a Reply