মরুর প্রচণ্ড গরমের মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ১০ লাখের বেশি মুসলিম এবার হজ পালনের উদ্দেশ্যে পবিত্র মক্কা নগরীতে জড়ো হচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে হজ ব্যবস্থাপনা আরও নিরাপদ করতে এবং অবৈধ হজযাত্রী ঠেকাতে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ।
গত বছর ৫১ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে হজ পালনকালে ১ হাজার ৩০১ জন হজযাত্রীর মৃত্যু হয়েছিল। এবারের হজে এমন পরিস্থিতি এড়াতে অতিরিক্ত সতর্কতা নেওয়া হয়েছে।
চলতি সপ্তাহেই হজ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে, তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যেতে পারে।
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম হজ পালন প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলিমের ওপর ফরজ। সৌদি কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, শুক্রবার পর্যন্ত ১৩ লাখের বেশি হজযাত্রী দেশটিতে পৌঁছেছেন।
তীব্র গরম মোকাবিলায় এবার ৪০টিরও বেশি সরকারি সংস্থা ও ২ কোটি ৫ লাখ কর্মী নিয়োজিত রয়েছে। সৌদি হজমন্ত্রী তাওফিক আল-রাবিয়া জানান, অতিরিক্ত ৫০ হাজার বর্গমিটার ছায়াবৃত এলাকা তৈরি করা হয়েছে, হাজার হাজার চিকিৎসাকর্মী প্রস্তুত রাখা হয়েছে, এবং ৪০০টির বেশি শীতলীকরণ ইউনিট মোতায়েন করা হয়েছে।
সোমবার তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়ালে সৌদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, অন্তত ৪৪ জন হজযাত্রী হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন।
এবারের হজে ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তি, বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহৃত হচ্ছে। ড্রোনের মাধ্যমে তোলা ভিডিও ও তথ্য বিশ্লেষণ করে জনসমাগম নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করা হচ্ছে।
তীব্র তাপদাহ সত্ত্বেও হজযাত্রীরা মক্কায় পৌঁছে আবেগে আপ্লুত। ‘এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে এক আশীর্বাদ,’ বলেন গ্র্যান্ড মসজিদের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ফিলিপাইনের আইনজীবী ও শরিয়া পরামর্শক আব্দুল মাজিদ আতী। তিনি বলেন, ‘আমরা এখানে খুব শান্তি ও নিরাপত্তা অনুভব করছি।’
নাইজেরিয়ার ২৭ বছর বয়সী আবদুলহামিদ বলেন, ‘আমি কখনোই রোদচশমা ছাড়া বের হই না। এখানে আবহাওয়া খুবই, খুবই, খুবই গরম।’ তিনি দ্বিতীয়বার হজ পালনে এসে অত্যন্ত আনন্দিত।
চাঁদের হিসাব অনুযায়ী ইসলামি বর্ষপঞ্জিতে হজের আনুষ্ঠানিকতা এবারও জুন মাসে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
গত বছর যেসব হজযাত্রী বৈধ অনুমতি ছাড়া হজ করেছিলেন, তাদের জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত তাঁবু বা বাসের ব্যবস্থা ছিল না, ফলে তাঁদের মধ্যে অনেকেই তাপদাহে প্রাণ হারান।
জার্মানভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্লাইমেট অ্যানালিটিকস-এর ফাহাদ সাঈদ বলেন, ‘অনেকেই গরমের তীব্রতায় দিশেহারা হয়ে পড়েন, তাদের দেহের অভিযোজন ক্ষমতা কাজ করেনি।’
এ বছর সৌদি কর্তৃপক্ষ অননুমোদিত হজযাত্রীদের বিরুদ্ধে কড়া অভিযান চালিয়েছে। নজরদারি জোরদারে মোবাইলে সতর্কবার্তা, নিয়মিত তল্লাশি এবং ড্রোন ব্যবহার করা হচ্ছে।
আটক ও শাস্তি
সৌদি সরকার প্রতিটি দেশকে নির্দিষ্ট কোটায় হজ পারমিট দিয়ে থাকে। ব্যক্তিপর্যায়ে এই পারমিট সাধারণত লটারির মাধ্যমে দেওয়া হয়। কিন্তু অনেকেই পারমিট না পেয়ে চোরাপথে হজ পালনের চেষ্টা করেন, যা দণ্ডনীয়।
অনুমতি ছাড়া মক্কায় প্রবেশ করলে বড় অঙ্কের জরিমানা, গ্রেপ্তার ও সৌদি আরবে ১০ বছরের নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে হয়।
২০১৫ সালে মিনায় ‘শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ’ অনুষ্ঠানে পদদলিত হয়ে প্রায় ২ হাজার ৩০০ হজযাত্রী মারা যান, যা হজের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা।
মক্কা ও মদিনার পবিত্র দুই মসজিদের কারণে সৌদি আরব হজ ও উমরাহ থেকে প্রতিবছর বিপুল অর্থ আয় করে। একইসঙ্গে সৌদি বাদশাহর ধর্মীয় মর্যাদাও বৃদ্ধি পায়, যিনি নিজেকে ‘দুই পবিত্র মসজিদের খাদেম’ বলে অভিহিত করেন।
৫২ বছর বয়সী সেনেগালির হজযাত্রী মারিয়ামা বলেন, ‘আমি সারাজীবন এই স্বপ্ন দেখেছি। সবসময় ভাবতাম, কবে মক্কায় গিয়ে হজ করতে পারব।’
Leave a Reply