যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েই অভিবাসীদের নিয়ে নির্বাহী আদেশ জারি করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। জন্মসূত্রে দেশটির নাগরিকত্ব বাতিল থেকে শুরু করে সীমান্তে জরুরি অবস্থা জারি, প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসাসহ বেশ কিছু আদেশ দিয়েছেন তিনি। তার এসব নির্বাহী আদেশে সারা বিশ্ব নড়েচড়ে বসেছে। হিসাব কষতে শুরু করেছে দেশগুলো বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্টের এসব আদেশে কোন দেশে কী ধরনের সুবিধা বা অসুবিধা হবে। এর মধ্যে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রথম দিনেই ট্রাম্পের জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়ে ইতিমধ্যে সমালোচনা শুরু হয়েছে।
এমনিতেই বাইডেন প্রশাসনের সময়ে বাংলাদেশের গত আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে বড় ধরনের টানাপড়েন চলছিল। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর সম্পর্ক নতুন মোড় নেয়। বাইডেন সরকার ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেয়। বাইডেন-ইউনূসের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে প্রকাশ দেখেছে সারা বিশ্ব। কিন্তু ট্রাম্পের সঙ্গে ইউনূসের ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা নেই। এর মধ্যে নির্বাচনের আগেই ট্রাম্প বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে নিজের এক্স হ্যান্ডে। আবার এই মুহূর্তে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের এক ধরনের টানাপড়েন চলছে। অন্যদিকে ট্রাম্প ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কও স্পষ্ট করেছে উভয়ই। ফলে ধারণা করা হচ্ছে, ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশ ইস্যুতে কিছু পরিবর্তন আনবে।
তবে ট্রাম্পের অভিবাসন নীতি, জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিল ও প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে বেরিয়া আসার আদেশে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বাংলাদেশ। তবে উদ্বেগের কিছু নেই। বাংলাদেশ ভূরাজনৈতিক কারণেই এখন ওয়াশিংটনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ফলে সম্পর্কে ভারসাম্য থাকবে। তবে ট্রাম্প প্রশাসন দ্রুত নির্বাচন চাইবে বলে মনে হচ্ছে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, অভিবাসী ইস্যুতে বাংলাদেশের চেয়ে অন্যান্য দেশ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে বাংলাদেশও এর মধ্যে পড়বে। কারণ দেশটিতে বাংলাদেশের লক্ষাধিক মানুষ অভিবাসনপ্রত্যাশী। একইভাবে জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের বিষয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ।
এসব বিষয়ে কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত, ট্রাম্প ফেরায় অভিবাসন প্রসঙ্গে বোধহয় বেশি আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। এতে খুব আতঙ্কের কিছু নেই বাংলাদেশের। ট্রাম্পের প্রধান লক্ষ্য দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আসা হিস্পানিক অভিবাসন ঠেকানো। হিস্পানিক অভিবাসন বেড়েছে আমেরিকায়। এ পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি অভিবাসন বন্ধ করতে চাচ্ছেন। বৈধ অভিবাসন বন্ধ করার কথা তিনি বলছেন না। আমেরিকা অভিবাসন ছাড়া টিকতে পারবে না। ফলে এ জায়গা থেকে বাংলাদেশের উদ্বেগের কিছু নেই। তাদের মতে, বাংলাদেশের বেশিরভাগই বৈধ অভিবাসন। বৈধ অভিবাসন পদ্ধতি থাকলে অবৈধ অভিবাসন কোনো দেশ ঠেকাতে চাইতেই পারে।
জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের অধিকার বাতিলের বিষয়ে বিশ্লেষকদের অভিমত হলো, এটা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেই সমালোচনা হচ্ছে। কারণ তাদের সংবিধানেই রয়েছে, আমেরিকায় যারা জন্মগ্রহণ করে, তারা আমেরিকান নাগরিক। ফলে এটা বাতিল করে দেওয়ার মতো আইনগত অধিকার কি তার আছে? অন্তত এ ইস্যুতে তিনি আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন। আর যদি এটি বাস্তবায়ন হয়, তবে সব দেশের মতো বাংলাদেশও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশ থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভারত।
কূটনীতিকদের মতে, ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশে দ্রুত নির্বাচন চাইবে। এখানে ডেমোক্রেটিক পার্টি ক্ষমতায় থাকলে হয়তো নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময়ের বিষয়ে কিছুটা নমনীয় হতে পারত তারা। তবে আমেরিকার নতুন প্রশাসন বাংলাদেশে দ্রুত নির্বাচন চাইবে। এ বিষয়ে ইতিমধ্যে দিল্লিতে মার্কিন প্রতিনিধিরা কথা বলা শুরু করেছেন।
কূটনৈতিক বিশ্লেষক মুন্সী ফয়েজ আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে খুব পরিবর্তন আসে না। এর মধ্যে সাম্প্রতিক সময়গুলোয় বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে চীনের আগ্রহ যুক্তরাষ্ট্র বিশেষভাবে দেখবে। তিনি বলেন, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পৃক্তির বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিকে গুরুত্ব দেবে ট্রাম্প প্রশাসন। ফলে সম্পর্ক ভালো যাবে বলেই মনে হয়।
তবে অর্থনৈতিক সম্পর্কের ঢাকা-ওয়াশিংটনের সম্পর্ক ইতিবাচক দেখেছেন সংশ্লিষ্টরা। এখন বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বিনিয়োগ যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট বৈদেশিক বিনিয়োগের ২০ শতাংশই আসছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ১৯৮৯ সালে দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক সম্পর্ক শুরুর পর থেকে অব্যাহতভাবে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে রপ্তানি ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।
বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ১৭ থেকে ২০ শতাংশের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রে। সেদিক বিবেচনায় আমদানি এবং রপ্তানির মধ্যকার ভারসাম্য বজায় রাখা, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকে নিরাপদ রাখা ইত্যাকার বিষয়ের সঙ্গে তাদের গণতান্ত্রিক ধারণা সম্পর্কিত।
কূটনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ দেশ রূপান্তেরকে বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনকালীন প্রতিশ্রুতির মধ্যে বাংলাদেশ বিষয়টি উঠে আসার কারণে এবারের ট্রাম্প প্রশাসনের দিক থেকে বাংলাদেশ নিয়ে কী ধরনের ভূমিকা থাকবে সেটি আলোচনা হচ্ছে। তবে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু বিষয়টি ট্রাম্প প্রশাসনের আগের মেয়াদেও উঠে এসেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ নিয়ে উদ্বেগ প্রদর্শিত হয়েছিল।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, এবারও ক্ষমতায় আসার আগেই ট্রাম্প সংখ্যালঘু বিষয়ে কথা বলেছেন। আবার এর মধ্যে ভারতের সঙ্গে একত্রে কাজ করার কথা বলেছেন। সেদিক বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাধান্য দিতে পারেন এটা মনে হলো। ভারত যেহেতু বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকারের বিষয়ে আগ্রহী, গণতান্ত্রিক বিষয়টি ট্রাম্পের অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকার কারণে বাংলাদেশে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক সরকার দেখতে অধিক আগ্রহী থাকবে মার্কিন প্রশাসন।
নাগরিকত্ব আইন নিয়ে কী প্রভাব পড়বে : ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া সেসব শিশুকে নাগরিকত্ব না দেওয়ার; যাদের মা অবৈধভাবে বা পর্যটনসহ বিভিন্ন ভিসায় দেশটিতে অবস্থান করছেন, শিশুটির বাবা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক নন বা আইনসংগতভাবে স্থায়ী বাসিন্দা নন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম পলিটিকোর এক প্রতিবেদনেও এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে।
এ আদেশের ফলে, এখন থেকে ৩০ দিন পর যেসব শিশু জন্ম নেবে, তাদের মধ্যে কারও বাবা-মা দুজনের কোনো একজন যদি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক না হন বা গ্রিন কার্ডধারী না হন, তাহলে সেই শিশুকে যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্ট ও ভিসা দেওয়া হবে না।
এক শতব্দীরও আগে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের এক আদেশে বলা হয়েছিল যে, সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর আলোকে যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া বিদেশি বাবা-মায়ের সন্তানরা দেশটির নাগরিকত্ব পাবে। এর ব্যতিক্রম হবে শুধু বাবা-মা যদি বিদেশি কূটনীতিক হন এবং যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী তারা কূটনৈতিক দায়মুক্তি পেয়ে থাকেন।
অবশ্য অভিবাসনে কড়াকড়ি আরোপের পক্ষের অনেক আইনজীবী সুপ্রিম কোর্টের ১৮৯৮ সালের ওই আদেশকে আরও বৃহত্তর পরিসরে দেখছেন। বর্তমান সুপ্রিম কোর্টও যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নিয়ে আরও কড়াকড়ি আরোপের বিষয়টি অনুমোদন করতে পারে। আবার কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়া ট্রাম্পের এই নির্বাহী আদেশ দেওয়ার এখতিয়ার আছে কি না, বিষয়টি আদালতে মীমাংসা হবে কি না—তাও এখনো নিশ্চিত নয়।
Leave a Reply