দেশের পুরোনো চারটি বিভাগকে চারটি প্রদেশ করার সুপারিশের কথা ভাবছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছাড়া অন্যান্য বিষয়ের ব্যবস্থাপনা প্রদেশের হাতে দেওয়ার পক্ষে এ কমিশন।
গত বুধবার (১৫ জানুয়ারি) প্রধান উপদেষ্টার কাছে সংবিধান, নির্বাচন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন কমিশনসংক্রান্ত সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা না দিলেও ওই অনুষ্ঠানে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান ও সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। তারা তাদের সম্ভাব্য কিছু সুপারিশের কথা তুলে ধরেন। এর মধ্যে চারটি প্রদেশ করার বিষয়টিও রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সম্ভাব্য সুপারিশগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বিকেন্দ্রীকরণের অংশ হিসেবে চারটি প্রদেশ করা। এই চার প্রদেশ হলো ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা। তবে এসব প্রদেশের পরিচালনা কাঠামো কেমন হবে, কাজ কী কী হবে, সেই ভাবনা এখনো জানা যায়নি।
কমিশনের একটি সূত্র বলেছে, বিষয়টি আলোচনার পর্যায়ে আছে। এখনো কমিশনের সুপারিশ চূড়ান্ত হয়নি। বিষয়টি মূলত সংবিধানসংক্রান্ত বিষয়। তাই কাঠামোর বিষয়ে তাদের পক্ষে এখনই বলা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশে একাধিক প্রদেশ করার আলোচনা নতুন নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস পূর্তি উপলক্ষে উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন ‘রাষ্ট্র মেরামতের এখনই সময়’ শীর্ষক লেখায় পাঁচটি প্রদেশ করার প্রস্তাব করেন। দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত ওই লেখায় পাঁচ প্রদেশের কাজ কী হবে, সেই ধারণাও দেন তিনি। বিকেন্দ্রীকরণের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে অষ্টম বৃহত্তম দেশ। জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৭ কোটি। ছোট দেশ হলেও এত বিরাট জনগোষ্ঠীর কাছে সরকারকে নিয়ে যেতে হলে বাংলাদেশকে ন্যূনতম পাঁচটি প্রদেশে ভাগ করে একটি ফেডারেল কাঠামোর রাষ্ট্র করা যেতে পারে। পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলে দুটি করে চারটি প্রদেশ ও বৃহত্তর ঢাকা নিয়ে আরেকটি প্রদেশ। মেট্রোপলিটন ঢাকা কেন্দ্রশাসিত থাকবে। কেন্দ্রের হাতে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, সীমান্ত ও সমুদ্রনিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা, যোগাযোগ ও বৈদেশিক সাহায্য-সহযোগিতার মতো বিষয়গুলো থাকবে। বাকি বিষয়গুলোতে কেন্দ্রের তত্ত্বাবধান থাকলেও প্রদেশগুলো ব্যবস্থাপনায় থাকবে।
তবে প্রদেশ গঠনের চিন্তাকে নানা কারণে বাংলাদেশের জন্য সঠিক মনে করেন না স্থানীয় শাসনবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ। এম সাখাওয়াত হোসেনের লেখার প্রতিক্রিয়ায় প্রথম আলোতে তিনিও একটি কলাম লিখেছিলেন।
তোফায়েল আহমেদ এখন স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি সাধারণভাবে আমার লেখায় যেটা বলার চেষ্টা করেছি এবং এখনো মনে করি, সেটা হচ্ছে ভৌগোলিকভাবে এই দেশটা একটা ছোট দেশ। মানুষ হয়তো বেশি। তবে ভাষাগত, ভৌগোলিক অবস্থাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বড় ধরনের কোনো বিভাজন নেই। আমি মনে করি, বর্তমানে যেসব বিভাগ আছে এবং স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করলে এবং এখানে ভালো কাজ করার ক্ষমতা দিলে প্রদেশের ঝামেলায় না গেলেও চলে। প্রদেশ সমস্যা সমাধানের চেয়ে নতুন করে কিছু সমস্যার সৃষ্টি করবে।’
বর্তমানে সারা দেশে আটটি প্রশাসনিক বিভাগ রয়েছে। এগুলো হলো ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, রংপুর ও ময়মনসিংহ। এর বাইরে কুমিল্লা ও ফরিদপুরকে বিভাগ করার আলোচনা আছে। এর আগে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনও তাদের সম্ভাব্য সুপারিশে কুমিল্লা ও ফরিদপুরকে বিভাগ করার কথা বলেছে।
১৫ জানুয়ারি সংবিধান সংস্কার কমিশনের জমা দেওয়া প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ এসেছে, তার মধ্যে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের স্বায়ত্তশাসনের ওপর জোর দেওয়া হয়। এ ছাড়া সংবিধান সংস্কার কমিশন উচ্চ আদালতের বিকেন্দ্রীকরণ করে দেশের সব বিভাগে হাইকোর্ট বিভাগের সমান এখতিয়ারসম্পন্ন হাইকোর্টের স্থায়ী আসন চালুর সুপারিশ করেছে।
উপসচিব পদে কোটার বিষয়ে আলোচনা
গত অক্টোবরে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনসহ ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সাবেক সচিব আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে এ কমিশনের প্রতিবেদন দেওয়ার কথা থাকলেও সময় এক মাস বাড়ানো হয়।
এর আগে গত ডিসেম্বরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় সম্ভাব্য কিছু সুপারিশের কথা জানিয়েছিলেন কমিশন প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী এবং সদস্যসচিব ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মোখলেস উর রহমান।
সেদিনের বক্তব্য অনুযায়ী, সম্ভাব্য সুপারিশের মধ্যে ছিল উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য ৫০ শতাংশ এবং অন্য ক্যাডারের জন্য ৫০ শতাংশ কোটা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত না রেখে আলাদা কমিশনে রাখা। তবে এ নিয়ে বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে করা সম্ভাব্য এই সুপারিশ নিয়ে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে তীব্র আপত্তি উঠেছে। তারা বলছেন, এ সুপারিশ তারা মানবেন না। এ ক্ষেত্রে তারা এ নিয়ে থাকা আপিল বিভাগেরও একটি রায়ের কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
অন্যদিকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত না রেখে আলাদা কমিশনে রাখার যে সুপারিশ করা হচ্ছে, তা নিয়ে এই দুই ক্যাডারের কর্মকর্তারাও আপত্তি জানাচ্ছেন। এ রকম অবস্থায় চূড়ান্ত পর্যায়ে এসব সুপারিশ থাকছে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
কমিশনের একটি সূত্র বলেছে, এখনো এ নিয়ে তারা আলোচনা করছে। কোটা থাকলে বা না থাকলে কার কী সুবিধা–অসুবিধা, সেগুলো আলোচনা করছে। আজ রোববারও তারা এ বিষয়ে আলোচনা করবে। জানতে চাইলে এ বিষয়ে কিছু বলতে চাননি কমিশনপ্রধান মুয়ীদ চৌধুরী।
কমিশনের সম্ভাব্য সুপারিশের ভাবনায় আরও আছে নিয়োগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশন (পরিচয়-ঠিকানা ও রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ইত্যাদি যাচাই) প্রথা উঠিয়ে দেওয়া, তথ্য অধিকার আইনের আওতায় প্রতিটি জেলায় একজন কর্মকর্তা রাখা ইত্যাদি।
সূত্র: প্রথম আলো
Leave a Reply