১ জানুয়ারি বুধবার ২০২৫ আমরা ঈসাই নতুন বছরকে সম্ভাষণ করেছি। এর আগে ৩১ জানুয়ারি রাতে পুরোনো বছরকে বিদায় জানিয়েছি এবং রাত ১২টা ১ মিনিটে নতুন বছরের শুভ সূচনা প্রত্যক্ষ করেছি। আমাদের জীবন থেকে একটি বছর হারিয়ে গেল, আলিঙ্গন করলাম একটি নতুন বছরকে। যে বছরটি চলে গেল, সেটা ছিল অনেক দুঃখ-বেদনা এবং আনন্দেরও বটে। বিদায়ি বছরের ৭ জানুয়ারি এদেশে ডামি নির্বাচন হয়েছিল। ভোটাররা ভোট দিতে পারেনি। এই অভিজ্ঞতা শুধু বিগত বছরের ৭ জানুয়ারিতে সীমাবদ্ধ নয়, এর আগেও যে দুটি সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল, সেসব নির্বাচনেও জনগণ ভোট দিতে পারেনি। বহুবার কাটাছেঁড়া করা আমাদের সংবিধানে লেখা আছে রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। কিন্তু ২০২৪-এর ৫ আগস্টের পূর্ববর্তী সাড়ে ১৫ বছর জনগণ এ মালিকানা ভোগ করতে পারেনি। জনগণ হয়েছিল ভোটাধিকারবঞ্চিত, রাষ্ট্রের ওপর মালিকানাবঞ্চিত এবং সর্বোপরি সভ্যসমাজের নাগরিকরা যেসব মানবিক অধিকার ভোগ করে, সেসব অধিকার থেকে বঞ্চিত। বঞ্চিত জনগোষ্ঠী চরম নির্যাতন নিষ্পেষণে আশাহীন, ভাষাহীন হয়ে পড়েছিল। একটির পর একটি আন্দোলন-সংগ্রাম নিষ্ঠুর দমনাভিযানে পণ্ড করে দেওয়া হয়েছে। জনগণ চরম হতাশার তিমিরে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল। মনে হয়েছিল এ রাত পোহাবে না, নেই কোনো আশা-ভরসা।
জুলাইয়ের প্রথম থেকে একঝাঁক প্রতিশ্রুতিশীল তরুণের নেতৃত্বে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সূচনা হয়। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে একটি সহজ-সরল আন্দোলন পরিণত হয়েছিল একদফার আন্দোলনে। একদফার আন্দোলন মানে শেখ হাসিনার পতন এবং শেষ পর্যন্ত দেশ ছেড়ে প্রাণ রক্ষার জন্য তার ভারতে পলায়ন। বহু প্রতীক্ষার পর ৫ আগস্ট ২০২৪ আমরা জানতে পারলাম শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। অথচ এ শেখ হাসিনাই বলতেন, শেখ হাসিনা পালায় না। পলায়নকালে শেখ হাসিনা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন তার বোন শেখ রেহানাকে এবং শোনা যায় তার আত্মীয় এবং পরম সুহৃদ মেজর জেনারেল (অব.) তারিক সিদ্দিকীকেও। দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর পর বাংলাদেশ রাহুমুক্ত হলো। এ মুক্তির জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে শত-সহস্র তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী, মেহনতি মানুষ, এমনকি কয়েকজন শিশুকে। কয়েক হাজার মানুষ আহত হয়েছে। কেউ চোখ হারিয়েছেন, হাত হারিয়েছেন, পা হারিয়েছেন, শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেও গুরুতর আঘাত পেয়েছেন। এদেশে অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে। ব্রিটিশ শাসনামলে মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড হয়েছিল জালিয়ানওয়ালাবাগে। জেনারেল ডায়ারের নেতৃত্বে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী জালিয়ানওয়ালাবাগের স্টেডিয়ামে শত শত মানুষকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলিতে হত্যা করেছিল। অজস্র হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল ১৮৫৭-এ ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধে। সৈয়দ আহমদ বেরলভীর নেতৃত্বে যে ব্রিটিশবিরোধী জেহাদ আন্দোলন হয়েছিল, সেই আন্দোলনেও শত শত মুসলমানকে শহিদ হতে হয়েছে। যুগে যুগে, কালে কালে মানুষের ন্যায়ের সংগ্রামকে স্তব্ধ করে দিতে ব্যবহৃত হয়েছে গরম সিসার বুলেট। এই বুলেট ব্যবহার করা হয়েছে ১৯৫০, ১৯৫২, ১৯৬২, ১৯৬৯, ১৯৭১-এর অসহযোগ আন্দোলনে এবং একই বছর আমাদের এ অঞ্চলে পাকিস্তানের মৃত্যুঘণ্টা বাজানো মুক্তিযুদ্ধে। কিন্তু কোনো পর্যায়ে হেলিকপ্টার গানশিপ ব্যবহার করা হয়নি। জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থান দমনে হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে বহু মানুষ হত্যা করা হয়েছে। শোনা যায়, এই হত্যাকাণ্ড ঘটাতে স্নাইপার রাইফেল ব্যবহার করা হয়েছে হেলিকপ্টার থেকে। গণহত্যায় লিপ্ত পুলিশের সঙ্গে আওয়ামী হেলমেট বাহিনীও নেমেছিল।
৫ আগস্ট ২০২৪ শেখ হাসিনা যখন পালিয়ে গেলেন, তখন পুলিশ বাহিনীর বহু সদস্য কর্মস্থল ত্যাগ করে গা ঢাকা দিয়েছিল। বড় ধরনের পাপাচার করার ফলেই এসব পুলিশ ভীষণ অপরাধবোধে ভুগছিল। এটাও এদেশের আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। আওয়ামী লীগের তাবৎ সদস্য-সদস্যা আত্মগোপনে কিংবা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে যায়।
আন্দোলন শেষ হলে দেশব্যাপী আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়। মানুষ একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করেছে, ক্ষুব্ধ মানুষ প্রধানমন্ত্রীর বাসস্থান, গণভবন তছনছ করেছে। কিছুক্ষণের জন্য দখলে নিয়েছিল জাতীয় সংসদ ভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। মানুষের বুকের ওপর থেকে দম কেড়ে নেওয়া পাথরগুলো সরে গেল। মানুষ শান্তিতে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে শুরু করল।
৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর বেশ কিছু অঘটন ঘটেছে। এর মধ্যে রয়েছে সচিবালয়ে আনসারদের বিক্ষোভ, রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় ডাকাতির চেষ্টা এবং গণ-প্রতিরোধ, বিনা পরীক্ষায় পাশের জন্য একশ্রেণির ছাত্রের বিক্ষোভ, ঢাকার ৭ কলেজের শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে আন্দোলন-বিক্ষোভ, সচিবালয়ে আমলাদের বিক্ষোভ ও ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম, সড়ক অবরোধ এবং সচিবালয়ে রহস্যজনক অগ্নিকাণ্ডের মাধ্যমে বহু মূল্যবান নথিপত্র, কম্পিউটার ও আসবাবপত্র ভস্মীভূত করা-এসবসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আইনশৃঙ্খলাজনিত বহুবিধ ঘটনায় গণতন্ত্র অর্জনের সংগ্রামে যে সাফল্য অর্জিত হয়েছিল, তা হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। দেশে অস্থিরতার নানা লক্ষণ ফুটে উঠছে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জনমনে হতাশার মেঘ গাঢ় হতে শুরু করেছে। জনগণ ভাবছে নতুন বছরটি কেমন হবে?
আমাদের দেশে যতরকম সমস্যা হয়, তার মূলে রয়েছে রাজনীতি। রাজনীতির গুরুত্ব সব সমাজেই বিশেষ বিবেচনায় রাখা হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেশটি অতিমাত্রায় রাজনীতিমগ্ন হওয়ার ফলে রাজনৈতিক সমস্যা আমাদের চিন্তায় ফেলে।
জুলাই-আগস্টের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছিল, তাতে হেয়ার ক্র্যাক দেখা দিয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে এ ক্র্যাক বড় ধরনের ফাটলে পরিণত হতে পারে। এ মুহূর্তের রাজনৈতিক বিতর্ক হলো-(ক) সংস্কার ও নির্বাচনের তুলনামূলক প্রাধান্য নিয়ে, (খ) বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর দূরত্ব নিয়ে, (গ) বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের সম্ভাব্য রাজনৈতিক দল গঠন নিয়ে।
দেখা যাচ্ছে, এ মুহূর্তের রাজনৈতিক স্টেকহোল্ডাররা একে অপরের সঙ্গে সহজ সম্পর্ক রেখে চলতে পারছেন না। রাজনৈতিকভাবে ভিন্ন অবস্থানে থাকলে মতপার্থক্য থাকাই স্বাভাবিক। তবে মতান্তর যদি মনান্তরে পরিণত হয়, তাহলে ভয়াবহ বিপদ দেখা দিতে পারে।
নতুন বছর শুরু হচ্ছে বিদায়ি বছরের ঘাত-প্রতিঘাত এবং বছরের শেষদিকে আন্দোলনকারীদের মধ্যে উল্লেখিত মতপার্থক্যের প্রেক্ষাপট পেছনে ফেলে। নতুন বছরে এসব মতপার্থক্য যদি অমীমাংসেয় দ্বন্দ্বে পরিণত হয়, তাহলে তা হবে পরম দুর্ভাগ্যের বিষয়। এ মুহূর্তে বাংলাদেশের জনগণের জন্য জাতীয় দ্বন্দ্বই প্রধান। প্রতিবেশী ভারত শেখ হাসিনার পতন সহ্য করতে পারছে না। সেদেশের মিডিয়া ও দায়িত্বশীল রাজনৈতিক নেতারা বাংলাদেশকে নিয়ে দায়িত্বহীন মন্তব্যে ধারাবাহিকভাবে লিপ্ত রয়েছে। এমনকি ভারতের কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান চালানোর জন্য প্রস্তুত হতে আহ্বান জানিয়েছে। এক কথায়, বাংলাদেশ এখন ভয়াবহ আগ্রাসনের মুখে। এমন আগ্রাসনের মুখে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে দ্বন্দ্ব দেখা দিলে নতুন বছরে ভয়াবহ বিপদ সৃষ্টি হতে পারে। এটা হবে বাংলাদেশের জন্য আত্মঘাতী। নতুন বছরে প্রার্থনা হবে, রাজনৈতিক দল ও শক্তিগুলো যেন আত্মঘাতী খেলায় মত্ত না হয়ে ওঠে। এমন সময়ে দূরত্ব কমিয়ে ঐক্য গঠনই শ্রেয়। নতুন বছরে আমরা কেন এ ভালো কাজটি করতে পারব না? এটাই এখন দেশবাসীর জিজ্ঞাসা! আশা করব নতুন বছরে আমরা যেন একটি মহান জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে পারি। এ ধরনের ঐক্য হবে দেশি-বিদেশি সব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে শানিত হাতিয়ার।
নতুন বছর আমরা আগের কয়েক বছরের অর্থনৈতিক দুর্দশারই উত্তরাধিকার বহন করছি। মূল্যস্ফীতির কশাঘাত, টাকার অস্থিতিশীল বিনিময় হার, বৈদেশিক মুদ্রার অনির্ভরযোগ্য মজুত, রপ্তানি বৃদ্ধিতে অপারগতা, ব্যাংক ব্যবস্থায় বিধ্বংসী খেলাপি ঋণ, দেশ থেকে বিশাল অঙ্কের অর্থ পাচার, বিধ্বস্ত পুঁজিবাজার, রাজস্ব আহরণ বাড়াতে ব্যর্থতা এবং অবনতিশীল প্রবৃদ্ধির হারের মতো অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে আমাদের নতুন বছরে প্রবেশ করতে হচ্ছে। নতুন বছরে অর্থনীতির ক্ষেত্রে উল্লেখিত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হবে।
নতুন বছর নিয়ে সুবচন শোনাতে না পেরে দুঃখবোধ করছি। তবুও কবির কথায় বলব-হতাশাই শেষ কথা নয়। আমিও হতাশ হতে চাই না। দেশের মানুষও নতুন বছরে হতাশ থাকতে চায় না। তারা চায় আশাজাগানিয়া একটি নতুন বছর। যে বছরটি হবে সৌহার্দের, আনন্দের, জীবনকে সুন্দর করে গড়ার প্রত্যয়ের, প্রতিহিংসার পরিবর্তে সহমর্মিতার, অনৈক্য ও অনাস্থার পরিবর্তে ঐক্য ও সংহতির এবং দেশমাতৃকার মর্যাদা রক্ষার ইস্পাত দৃঢ় প্রত্যয়ের।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ
Leave a Reply