ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনী রোডম্যাপ চায় বিএনপি। অন্তর্বর্তী সরকার এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে অবস্থান স্পষ্ট না করলে আগামী বছরের মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি তুলবে দলটি। একইসাথে এ দাবিতে রাজপথেও সোচ্চার হবে তারা। সোমবার (৪ নভেম্বর) অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে। বৈঠকে নির্বাচন ইস্যুতে বিস্তর আলোচনা হয়েছে।
বৈঠকে বিএনপির শীর্ষ নেতারা বলেছেন, গত কয়েক মাস ধরে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বারবার নির্বাচনের রোডম্যাপের দাবি জানানো হচ্ছে। বিরোধী অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও একই দাবি করছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এখনো এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে কোনো বক্তব্য দেয়া হয়নি। বরং সরকারের দু-একজন উপদেষ্টার বক্তব্য বিষয়টিকে আরো ধোঁয়াচ্ছন্ন করে তুলেছে। সরকার নির্বাচন না দিয়ে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে চায় কি না সে বিষয়ে শঙ্কা প্রকাশ করা হয় বৈঠকে। এমন প্রেক্ষাপটে রোডম্যাপ ইস্যুতে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত দেখবে দলটি। বিএনপির অবস্থান হচ্ছে, তারা এ সরকারকে সহযোগিতা করতে চায়, যাতে করে তারা একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে পারে। দলটি মনে করে, সরকারের রাষ্ট্রকাঠামোর সংস্কার ও নির্বাচনী প্রস্তুতি এক সাথে চলতে পারে। এতে তাদের কোনো আপত্তি নেই। কারণ, বিএনপিও প্রয়োজনীয় সংস্কার চায়। এ জন্য দলটি সরকারের সংস্কার প্রস্তাবের সাথে সহমতও পোষণ করেছে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে তারা সহযোগিতা করতেও প্রস্তুত। এ জন্য সরকার ঘোষিত দশটি কমিশনের পাশাপাশি বিএনপির পক্ষ থেকেও ছয়টি কমিটি গঠন করা হয়েছে, যেটাকে তারা স্যাডো (ছায়া) কমিটি বলছে। এসব কমিটির সুপারিশমালা তারা সরকারকে দিবে।
বিএনপি নেতারা বলছেন, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া, এটা অব্যাহত থাকবে। তাদের রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফা রূপরেখায়ও সংস্কারের কথা বলা আছে। তবে দেশের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত। তারা এখন ভোট দিতে উদগ্রীব। জনগণ দ্রুত নির্বাচন চায়। তাই সরকারের উচিত, নির্বাচনমুখী প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। এজন্য বিএনপির পক্ষ থেকে সরকারকে নির্বাচন কমিশন (ইসি), প্রশাসন এবং বিচার বিভাগকে প্রাধান্য দিয়ে সংস্কার কার্যক্রম চালানোর জন্য বলা হয়েছিল। বিএনপি নেতারা আরো বলছেন, সংস্কার ও নির্বাচনী প্রস্তুতি যদি একসাথে চলে, তাহলে দেশবাসী মনে করবে- সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং সরকার সে পথেই হাঁটছে। কিন্তু তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। এমন প্রেক্ষাপটে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়।
মেয়াদের তিন মাস অতিক্রান্ত হলেও সরকার এখনো রোডম্যাপের বিষয়টি স্পষ্ট না করায় নির্বাচন নিয়ে আসলে তাদের চিন্তা কী, অথবা নির্বাচন ছাড়া তারা কত দিন ক্ষমতায় থাকতে চায় কিংবা ক্ষমতা ও নির্বাচনকে দীর্ঘায়িত করতে চায় কিনা-এটা নিয়ে বিএনপি নেতারা এক ধরনের শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বৈঠকে নেতারা বলেন, সরকার সংস্কারের কথা বললেও নির্বাচন নিয়ে তাদের কোনো বক্তব্য নেই। তারা সরকারকে অবিলম্বে নির্বাচনী রোডম্যাপ ইস্যুতে অবস্থান স্পষ্ট করার দাবি জানান তারা। এর প্রেক্ষিতে গতকাল রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রকাঠামোর কী কী সংস্কার করতে চায় এবং সেটা করতে কতদিন লাগবে, কোনো ছলচাতুরী ছাড়াই তা স্পষ্ট করে অবিলম্বে নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করুন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বলব, জাতিকে ধোঁয়াশায় রাখবেন না। দেশের মানুষ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন গত ১৬ বছরের বিনা ভোটের সরকারকে মানেনি, এখন এই সরকারকেও দীর্ঘদিন মানবে না। জাতিকে অন্ধকারে রেখে আপনারা যা খুশি তাই করবেন, জনগণ সেটা মেনে নিবে না।
সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচন নিয়ে সরকারের দু-একজন উপদেষ্টা যে ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন, সেটাকে ভালোভাবে নিচ্ছে না বিএনপি। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। রাজনীতিবিদরা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য উশখুশ করছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক উপদেষ্টার এমন বক্তব্যে গত রোববার তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ওই দিন রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে সরকারকে ইঙ্গিত করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আবারো চক্রান্ত করে বিএনপিকে বাদ দিয়ে কিছু করার চেষ্টা করতে যাবেন না। এটা বাংলাদেশের মানুষ কখনোই মেনে নেবে না। একবার বিরাজনীতিকরণের ‘মাইনাস টু’ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। আবারো ওই রাস্তায় যাওয়ার কথা কেউ চিন্তা করবেন না।
গত সোমবার নরওয়ের রাষ্ট্রদূত হাকোন অ্যারাল্ড গুলব্রান্ডসেনের সাথে সাক্ষাৎকালে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা মো: নাহিদ ইসলাম বলেন, প্রয়োজনীয় সব সংস্কার শেষে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দলটির নেতারা উপদেষ্টার এই বক্তব্যে আপত্তি জানিয়েছেন। সরকার নির্বাচন ছাড়াই দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে চায় কিনা- তার এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সে বিষয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে বিএনপি।
জানা গেছে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদারকে নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দলটি তার পদত্যাগ চায়। কারণ, আলী ইমাম মজুমদারকে বিতর্কিত কর্মকর্তা মনে করেন তারা। সে কারণে তাকে সরকারে রেখে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে অভিমত বিএনপি নেতাদের।
বৈঠকে ৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসের কর্মসূচি জোরালোভাবে পালনের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এ ছাড়া পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ দফা রূপরেখাকে সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপক আকারে তুলে ধরারও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
Leave a Reply