এখন আষাঢ় মাস। জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে শুরু হবে শ্রাবণ- ভরা বৃষ্টির মাস। শ্রাবণের মাঝামাঝিতেই হবে পবিত্র কোরবানির অনুষ্ঠান। মাঠে আউশ ধান। একে সামনে রেখেই এবার অনুষ্ঠিত হবে কোরবানির ঈদ। গত রোজার ঈদে মাঠে ছিল বোরো ফসল- বাম্পার ফলন।
বরাবরের মতো এবারও রোজার ঈদ হওয়ার কথা ছিল আনন্দময়। অর্থনীতি থাকার কথা ছিল চাঙ্গা। প্রবাসী বাঙালিদের পাঠানোর কথা ছিল কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার। বাজার-সওদা করতে হবে। জামা-কাপড় কিনতে হবে। জুতা-মোজা, শাড়ি-ব্লাউজ ইত্যাদি কিনতে হবে।
না, প্রকৃতি তা হতে দেয়নি। দেশময় মহামারী- অদৃশ্য এক দুর্ধর্ষ শত্রু। নাম তার করোনাভাইরাস। উহান নামীয় চীনা শহর থেকে আগত। সারা পৃথিবী এতে আক্রান্ত। লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত। হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করছে। মানুষ বেকার, কলকারখানা বন্ধ। লকডাউন, অফিস-আদালত বন্ধ। এমন পরিস্থিতিতে এবারের রোজার ঈদ মোটেই আনন্দময় ছিল না। একটা অতৃপ্তির মধ্যেই মানুষ রোজার ঈদ উদ্যাপন করেছে। অর্থনীতি, বেচাকেনায় ছিল ভীষণ মন্দা। ‘ক্যাশের’ আমদানি ছিল সীমিত।
এ অভিজ্ঞতার পর দেখতে দেখতে প্রায় এসে গেল কোরবানির ঈদ- ত্যাগের ধর্মীয় অনুষ্ঠান। জুলাইয়ের শেষে অথবা আগস্টের শুরুতে তা অনুষ্ঠিত হবে। এই পবিত্র ঈদকে ঘিরেও একটা অর্থনীতি আছে। সামাজিক লেনদেন আছে। বেচাকেনার প্রশ্ন আছে।
বিপুলসংখ্যক পশু কোরবানি হবে। বছর ধরে খামারিরা এসব লালন-পালন করেছেন এ ঈদ উপলক্ষে বাজারে বিক্রি করবেন বলে। বিশাল বাজার এর জন্য। লাখ লাখ পশু কোরবানি হয়। হাজার হাজার কোটি টাকার অর্থনীতি। সবাই এর জন্য অপেক্ষা করে থাকে। এই কোরবানির ঈদের রয়েছে আরেক অর্থনীতি, সেটা হল চামড়ার অর্থনীতি।
সারা বছরের চামড়ার চাহিদা, চামড়া শিল্পের চাহিদা এ মৌসুমেই মেটে। অপেক্ষা করে থাকেন যেমন চামড়া শিল্পের মালিকরা, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানিকারকরা; তেমনি দেশব্যাপী অপেক্ষা করে থাকেন হাজার হাজার ফড়িয়া, বেপারি, কোরবানিদাতা গৃহস্থ। রয়েছেন কোরবানিতে সহায়তাকারী নানা পেশাজীবী। এই যে প্রতীক্ষা, এই আশা-প্রত্যাশা, তা কি এবার পূরণ হবে?
বলা বাহুল্য, করোনা পরিস্থিতির এখনও কোনো উন্নতি দেশে-বিদেশে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। অর্থনীতিও সেভাবে সচল হয়নি। অফিস-আদালত খুলেছে। পরিবহন কিছু চলছে। কিন্তু করোনার আতঙ্ক কিছুতেই যাচ্ছে না। বিশ্ব খুবই বড় মন্দার শিকার। আমাদের রফতানি বাজারও ক্ষতিগ্রস্ত। বহু মানুষ বেকার। বহু মানুষ নতুন করে বেকার হচ্ছে। লোকের চাকরি যাচ্ছে, বেতন হ্রাস পাচ্ছে।
মধ্যবিত্ত ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যাচ্ছে। ফ্ল্যাটবাড়ি সব খালি হচ্ছে। বাড়ি ভাড়ার বিজ্ঞাপন ঝুলছে। মধ্যবিত্তের অবস্থা খুবই খারাপ। গরিব আরও গরিব হয়েছে। সরকার নানা প্রণোদনা দিয়ে অর্থনীতিকে সচল রাখার চেষ্টা করছে। গরিবকে খাবার চাল দিচ্ছে, নগদ টাকা দিচ্ছে, খোলাবাজারে সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিক্রি করছে। বাজার থেকে অনেক বেশি পরিমাণ বোরো ধান-চাল কেনার কথা সরকার ঘোষণা করেছে।
সবচেয়ে বড় কথা, সরকার শিল্প খাতকে বাঁচানোর জন্য, রফতানিমুখী শিল্পকে বাঁচানোর জন্য লক্ষাধিক কোটি টাকার প্রণোদনা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। শিল্পের জন্য, শিল্পের ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের জন্য ঋণ দেবে সরকার অর্থাৎ ব্যাংকগুলো। এসএমইর জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা হয়েছে। রফতানিমুখী শিল্পের জন্য আলাদা ব্যবস্থা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক রি-ফাইন্যান্স সুবিধা দেবে।
বলা যায়, উদারভাবে ঋণ পুনঃতফসিলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোনো ঋণ কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থতার জন্য ‘খেলাপি’ হিসেবে চিহ্নিত হবে না। সুদ হিসাব স্থগিত করা হয়েছে। সর্বশেষ দেখা যাচ্ছে, সরকার কোরবানির ঈদের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ ঘোষণা করেছে।
সাধারণভাবে চামড়া ব্যবসায়ী ও চামড়াশিল্পের মালিকদের কোনো ঋণ পাওয়ার কথা নয়। ঐতিহাসিকভাবেই এ শিল্প ব্যাংকগুলোকে দীর্ঘদিন ধরে ডোবাচ্ছে। যুগান্তরের একটি প্রতিবেদনে দেখলাম চামড়া খাতে ব্যাংকগুলোর মোট বকেয়া ঋণের পরিমাণ সর্বশেষ হিসাবে ৪ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকাই খেলাপি। অধিকাংশ চামড়া শিল্পের মালিকই এর মধ্যে পড়েন।
এতৎসত্ত্বেও সরকার খামারি, ছোট-বড় চামড়া ব্যবসায়ী এবং শিল্পের খাতিরে কোরবানি উপলক্ষে ৪০০ কোটি টাকা ঋণের ব্যবস্থা করেছে। বাধা ছিল খেলাপি ঋণগ্রহীতা। তারা ঋণ পাবে কীভাবে? সেই বাধাও দূর করা হয়েছে। ১০ শতাংশ ‘ডাউন পেমেন্টে’ চামড়া ব্যবসা ও শিল্পের ঋণ পুনঃতফসিল করা যাবে। এর জন্য ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে দরখাস্ত করতে হবে। তলবি ঋণ ও মেয়াদি ঋণ পরিশোধে যথাক্রমে ৬ ও ৮ বছর সময় দেয়া হবে। অবশ্যই এক বছর থাকবে ‘গ্রেস পিরিয়ড’। সুদের হার তো যথেষ্ট কমই আছে।
এসব সুবিধা সরকার দিয়েছে কয়েকটি উদ্দেশ্য নিয়ে। কোরবানি উপলক্ষে পশু বেচাকেনায় যাতে কোনো বিঘ্ন না ঘটে। দ্বিতীয়ত, কোরবানির চামড়ার বাজার যাতে স্থিতিশীল থাকে। কোরবানিদাতা গৃহস্থ, ছোট ছোট ফড়িয়া, বেপারিরা যাতে দামে না ঠকেন। চামড়া শিল্প মালিক ও রফতানিকারকরা যাতে বাজার মন্দা বলে চামড়া বিক্রেতা পক্ষকে মাত্রাতিরিক্তভাবে না ঠকান। এবং এসব পদক্ষেপে যাতে কোরবানির অর্থনীতি স্বাভাবিক ও সচল হয়।
মুশকিল হচ্ছে, সরকার সুবিধা দেয় চামড়া ব্যবসায়ীদের প্রতিবছর। বাণিজ্যিক ব্যাংক এ খাতে ঋণ দিতে চায় না। কারণ, এ খাতের ঋণ নিয়ে তারা যাচ্ছেতাই অবস্থায় আছেন। এতৎসত্ত্বেও সরকার জোর করে সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে দিয়ে কোরবানি উপলক্ষে প্রতিবছর ৪০০-৫০০ কোটি টাকা ঋণের ব্যবস্থা করে। কোনো কোনো বেসরকারি ব্যাংকও সীমিত আকারে চামড়া ব্যবসায় টাকা খাটায়।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সরকারি সুবিধা পাওয়া সত্ত্বেও এ খাতের বড় বড় মালিক ও শিল্পপতিরা চামড়া বিক্রেতাদের ভীষণভাবে ঠকান। গেল বছর সাধারণ গৃহস্থরা, ছোট ছোট বেপারি ও দালালরা চামড়ার দাম পাননি। চামড়া নিয়ে পথে পথে তারা ঘুরেছেন। লবণ পাওয়া যায়নি চামড়া রাখার জন্য। বড় বড় ব্যবসায়ীরা ‘সিন্ডিকেট’ করে চামড়ার দাম অস্বাভাবিকভাবে নিচু রাখেন। এতে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং লোকসানে পড়েন ছোট ছোট বিক্রেতারা। এর প্রভাব পশুর হাটেও পড়ে। খামারিরা ন্যায্যমূল্য পান না।
আগে এক সমস্যা ছিল পশুর চোরাচালান, এমনকি কোরবানির চামড়াও চোরাচালান হতো। এবার এ সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ, একে তো করোনার কারণে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ বিঘ্নিত আছে; তদুপরি এখন আমরা পশু উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ‘জিডিপি’ বর্ধিষ্ণু।
সরকার গবাদি পশুর খাতে অধিকতর বরাদ্দ দিচ্ছে। গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগির চিকিৎসাসেবা প্রদান, রোগ প্রতিরোধের জন্য টিকা উৎপাদন ও বিতরণ, কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম সম্প্রসারণ এবং খামারিদের প্রশিক্ষণ ইত্যাদি কর্মসূচির মাধ্যমে গবাদি পশুর উৎপাদনে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। ফলে ঘাটতিজনিত কারণে বিদেশ থেকে গরু আসার কোনো কারণ দেখি না।
এ মুহূর্তে পশুর হাটের সমস্যা একটা আছে। সেটা হচ্ছে পরিবহন। কিন্তু কাগজে দেখলাম সরকার এবার রেলে পশু পরিবহনের ব্যবস্থা করবে। এতে পরিবহন খরচ কম পড়ার কথা। এ অবস্থায় বাজারে কোরবানির পশুর কোনো অভাব হবে না। খামারিরা অপেক্ষা করে আছেন, ছোট ছোট বেপারিরাও অপেক্ষা করে আছেন। এ ক্ষেত্রে বড় বড় চামড়া ব্যবসায়ী, শিল্প মালিক এবং রফতানিকারকদের বাজারে অবদান রাখা দরকার।
মনে রাখতে হবে- বেপারি, ফড়িয়া, দালাল চামড়ার বাজারের একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এদের বাদ দিয়ে চামড়া শিল্প চলবে না। সারা দেশে শিল্প মালিকদের নিজস্ব লোক নেই, যারা চামড়া সংগ্রহ করে দেবে। প্রতিবছরের মতো বেপারিরাই চামড়া সংগ্রহ করবেন। এ ক্ষেত্রে লক্ষ রাখতে হবে খামারি, ছোট ছোট চামড়া ব্যবসায়ীরা যাতে দামে না ঠকেন।
চামড়া শিল্প মালিকদের এবার করোনা একটা অজুহাত হতে পারে। তবে কথা আছে। চামড়া শিল্পের ভবিষ্যৎ ভালো। বিদেশে চামড়াজাত পণ্যের বাজার আছে। উদ্ভাবনী শক্তি দ্বারা মালিকরা কাজ করলে ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের না ঠকিয়েও তারা চামড়া শিল্পের উন্নতি করতে পারবেন।
ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Leave a Reply