ইন্ডিয়া জোটের শরিক কারা? ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্সকে (এনডিএ) টেক্কা দিয়ে কি ভবিষ্যতে সরকার গড়তে পারবে তারা? কী বলছে সমীকরণ?
ভারতের মোট ১৮টি বিরোধী দল রয়েছে ইন্ডিয়া জোটে। তাদের কার্যক্রমে জোটের অঙ্ক উল্টাপাল্টা করে দেয়ার ইঙ্গিত মিলেছে। রণকৌশল ঠিক করতে বৈঠকও করছে তারা। কিন্তু অঙ্ক বদলাতে কি সফল হবে ‘ইন্ডিয়া’?
বিপাকে পড়েছে বিজেবি! এক সময় ভারতের শক্তির কেন্দ্রস্থল এখন পুরোপুরি শরিক নির্ভর। সরকার গড়ারও উপায় নেই শরিক দল ছাড়া।
বিজেপির এই দুরবস্থা নতুন রসদ জুগিয়েছে বিরোধী শক্তি ‘ইন্ডিয়া’কে। লোকসভা ভোটের ফলাফলের পর রণকৌশল ঠিক করতে বৈঠক করেছে তারা। কিন্তু ‘ইন্ডিয়া’র কি কেন্দ্রে সরকার গড়ার ক্ষমতা আছে?
লোকসভা ভোটে বিজেপি এবার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। ৫৪৩টি আসনের মধ্যে ২৭২টি আসনে জিতলে সেটা হতো। কিন্তু বিজেপি পেয়েছে ২৪০টি। স্বাভাবিকভাবেই কেন্দ্রে সরকার গড়ার জন্য এখন এনডিএ-এর শরিক টিডিপির চন্দ্রবাবু নাইডু, জেডিইউয়ের নীতিশ কুমার এবং শিবসেনার (শিন্ডে) একনাথ শিন্ডেদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হচ্ছে বিজেপিকে।
কিন্তু শরিকদের পাশে পাওয়ার বিষয়টিও নির্ভর করছে কিছু নতুন এবং পুরনো অঙ্কের ওপর।
মঙ্গলবার লোকসভা ভোটের ফলপ্রকাশের পরে ‘ইন্ডিয়া’ শরিক এবং তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি জানান, ‘ইন্ডিয়া’র পরিবার আরো বড় হবে, শক্তিশালীও হবে।
‘ইন্ডিয়া’ জোট তৈরির উদ্যোগ প্রথম নিয়েছিলেন জেডিইউ প্রধান নীতিশ কুমার। লোকসভায় তার দল পেয়েছে ১২টি আসন। তবে তাতে ‘ইন্ডিয়া’র কোনো লাভ নেই। কারণ নীতিশ লোকসভা ভোটের আগে জোট বদলেছেন। যোগ দিয়েছেন এনডিএতে। ফলে তার প্রাপ্ত আসন আপাতত এনডিএ-এর হাতে।
ইন্ডিয়া জোটের প্রথম বৈঠকটি নীতিশ করেছিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতার সাথেই। ‘ইন্ডিয়া’ নামটিও দিয়েছিলেন মমতা। লোকসভা ভোটের ফলাফল বলছে, তৃণমূল ২৯টি আসন পেয়েছে।
‘ইন্ডিয়া’ জোট যাদের ছাড়া সম্ভব হতো না, তারা হলো কংগ্রেস। প্রধান বিরোধী মুখ তারা, ভারতের সাবেক শাসকদল। এ বছর কংগ্রেস বিরোধী দলগুলোকে সাথে নিয়ে লড়েছিল বাছাই করা কিছু আসনে। তা সত্ত্বেও প্রাপ্ত আসনের সংখ্যা বেড়েছে তাদের। ২০১৯ সালে ৫২টি আসন পাওয়া কংগ্রেস জিতেছে ৯৯টি আসনে।
এনডিএতে কারা আছে? চন্দ্র-নীতিশ ছাড়া আর কাদের হাত ধরবে বিজেপি? সরকার গড়ার অঙ্ক কী?
ইন্ডিয়া জোটের আরো এক বড় শরিক হলো অখিলেশ যাদবের নেতৃত্বাধীন সমাজবাদী পার্টি। উত্তরপ্রদেশের সাবেক শাসকদল এবারের লোকসভায় জিতেছে ৩৭টি আসন।
তামিলনাড়ুর শাসকদল ডিএমকেও রয়েছে ‘ইন্ডিয়া’য়। তারা এবার লোকসভায় তামিলনাড়ুর ২২টি আসন পেয়েছে। আর আছে দিল্লি এবং পাঞ্জাবের শাসক দল অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নেতৃত্বাধীন আপ। যারা এবারে দিল্লিতে একটি আসন না পেলেও পাঞ্জাবে তিনটি আসন জিতেছে। অর্থাৎ এ পর্যন্ত ‘ইন্ডিয়া’র মোট প্রাপ্ত আসন দাঁড়াল ১৯০-এ। বিজেপির প্রাপ্ত আসনের থেকে ৫০ আসন কম। তবে এই সংখ্যা কেবল ইন্ডিয়ার পাঁচটি দলের প্রাপ্ত আসনের যোগফল।
এছাড়া রয়েছে মহারাষ্ট্রের মহাগঠবন্ধনের দুই দল উদ্ধব ঠাকুরের নেতৃত্বাধীন শিবসেনা (উদ্ধব) এবং শরদ পওয়ারের নেতৃত্বাধীন এনসিপি (শরদ)। এরা পেয়েছে যথাক্রমে ৯টি এবং ৮টি আসন। অর্থাৎ মহারাষ্ট্র থেকে ‘ইন্ডিয়া’ পেয়েছে ১৭টি আসন।
‘ইন্ডিয়া’র শরিক বামফ্রন্টের কিছু দলও। তারা হলো সিপিআই, সিপিএম এবং আরএসপি। এর মধ্যে সিপিআই এবং আরএসপি একটি করে আসন পেয়েছে কেরলে। সিপিএম কেরল ছাড়াও রাজস্থান এবং তামিলনাড়ু মিলিয়ে জিতেছে মোট চারটি আসন। এছাড়া বামপন্থী সিপিআইএম লিবারেশনও জিতেছে ২টি আসন। অর্থাৎ বামপন্থী দলগুলোর থেকে মোট ৮টি আসন এসেছে ‘ইন্ডিয়া’য়।
বিহারের লালুপ্রসাদ যাদবের দল আরজেডি ‘ইন্ডিয়া’র অন্যতম শরিক। শুরুর দিন থেকে লালু এবং তার ছেলে তেজস্বী যাদব রয়েছেন ‘ইন্ডিয়া’র সাথে। বিহারে এবার তাদের আসনসংখ্যাও বেড়েছে। গত লোকসভায় বিহারে একটিও আসন না জেতা আরজেডি এবার জিতেছে ৪টি আসন।
ঝাড়খণ্ডের শাসকদল ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা। হেমন্ত সোরেনের দল ‘ইন্ডিয়া’কে এই লোকসভায় দিয়েছে ৩টি আসন।
এছাড়া রাজস্থানের আরএলপি এবং আরএলটিপিও রয়েছে ‘ইন্ডিয়া’য়। দু’দলই রাজস্থানে ২টি আসন জিততে পেরেছে।
জম্মু ও কাশ্মিরের জেকেএনসি পেয়েছে ২টি আসন। তবে ‘ইন্ডিয়া’র শরিক পিডিপি কোনো আসন পায়নি।
দক্ষিণের আরো চারটি দল তামিলনাড়ুর ভিসিকে, এমডিএমকে এবং কেরলের কেইসিএম এবং মুসলিম লিগ পেয়েছে যথাক্রমে ২, ১, ১ ও ৩টি আসন। অর্থাৎ সব মিলিয়ে আরো ৭টি আসন ‘ইন্ডিয়া’ পেয়েছে দক্ষিণের রাজ্যগুলো থেকে।
এই সব মিলিয়ে মোট ২৩৩টি আসন নিজেদের বিরোধী জোটে টানতে পেরেছে ‘ইন্ডিয়া’। যেখানে নীতিশ, নাইডু এবং শিন্ডের মতো বড় তিনটি দল নিয়ে বিজেপি এনডিএর ছাতার তলায় আনতে পেরেছে ২৯২টি আসন।
যেহেতু কেন্দ্রে সরকার গড়ার আসন সংখ্যা ২৭২, তাই ‘ইন্ডিয়া’র সরকার গড়তে হলে শুধু এনডিএ ভাঙালেই চলবে না, আরো ৩৯টি আসন যুক্ত করতে হবে।
এই পরিস্থিতিতে যদি এক সময় ‘ইন্ডিয়া’ জোটে থাকা নীতিশকে এবং কয়েক মাস আগে বিজেপির পুরনো সমঝোতা-সঙ্গী জগন মোহন রেড্ডির জন্য জেলে যাওয়া চন্দ্রবাবুকে নিজেদের দিকে টানতে পারে, তাতেও কার্যসিদ্ধি হবে না। সেক্ষেত্রে নীতিশদের ১২ এবং নায়ডুর ১৬ আসন মিলে ইন্ডিয়ার হাতে আসতে পারে ২৮টি আসন। বাকি থেকে যাবা আরো ১১।
এই ১১টি আসন যুক্ত করতে হলে সাতজন নির্দল এবং জগনের পার্টির চার সাংসদকে প্রয়োজন ‘ইন্ডিয়া’র। অথবা অন্যান্য আঞ্চলিক দলের জয় করা আরো সাতটি আসনকে নিজেদের দিকে আনতে হবে।
কিন্তু এত হিসাব মিলিয়ে এতগুলো ছোট ছোট দলকে এক জায়গায় এনে দেশ শাসন করা কি আদৌ সম্ভব?
রাজনীতির বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজনীতিতে অসম্ভব বলে কিছু নেই। তবে ‘ইন্ডিয়া’ও সম্ভবত এই মুহূর্তে এত দূর ভাবছে না। বুধবারের বৈঠকে ‘ইন্ডিয়া’ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে তারা সর্বসমক্ষে জানিয়েছে, তার মূল বক্তব্য হলো আপাতত ঐক্যবদ্ধ বিরোধী হিসেবেই সংসদে থাকতে চায় তারা।
অন্য দিকে, এনডিএর বৈঠকেও নরেন্দ্র মোদিকে পূর্ণ সমর্থন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন নীতিশ-নাইডু।
তবে বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলছে, আসলে ‘ইন্ডিয়া’ ‘ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ’ রাজনৈতিক অবস্থান নিতে চাইছে। যার ইঙ্গিত বুধবার সকালে পাওয়া গেছে তেজস্বী যাদবের কথায়।
তেজস্বী দিল্লিতে ‘ইন্ডিয়া’র বৈঠকে যোগ দিতে এসেছিলেন যে বিমানে, সেই বিমানে ছিলেন নীতিশ কুমারও। এ ব্যাপারে তেজস্বীকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘ধৈর্য ধরে দেখতে থাকুন আগামী দিনে কী কী হয়।’
রাজনীতিবিদদের একাংশ মনে করছেন, এখনই জোট বেঁধে সরকার গড়ার কথা বলে বিজেপি এবং এনডিএ শরিকদের সতর্ক করে তুলতেও চাইছে না তারা। সে জন্যই সরকার গড়ার ব্যাপারে এখনই আলাদাভাবে উদ্যোগী হচ্ছে না বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’।
অনেকেরই মত, শরিক নির্ভর বিজেপির অবস্থা খুব শিগগিরই কঠিন হয়ে উঠতে চলেছে।
তাদের বক্তব্য, বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় শরিকদের চাহিদা মেনে নিতে বাধ্য হতে পারে তারা।
সেই সময়ে ‘ইন্ডিয়া’র ভূমিকা হবে এনডিএ শরিকদের অন্তর্দ্বন্দ্বের ফয়দা তোলা। তবে এ সবই রাজনৈতিক কারবারিদের একাংশের অনুমান। ‘ইন্ডিয়া’ বা কোনো বিরোধী নেতা এ বিষয়ে কোনও ইঙ্গিত দেননি।
সেই সময়ে ‘ইন্ডিয়া’র ভূমিকা হবে এনডিএ শরিকদের অন্তর্দ্বন্দ্বের ফয়দা তোলা। তবে এ সবই রাজনৈতিক কারবারিদের একাংশের অনুমান। ‘ইন্ডিয়া’ বা কোনও বিরোধী নেতা এ বিষয়ে কোনো ইঙ্গিত দেননি।
আপাতত সব ঠিক থাকলে এনডিএ-এর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শনিবার শপথ নিতে পারেন মোদি।
তবে তারপরে ‘ইন্ডিয়া’ খেলা ঘোরানোর নতুন কোনো পরিকল্পনা করবে কিনা, সেটা ভবিষ্যৎই বলতে পারবে।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা
Leave a Reply