প্রত্যেক মোমেন ব্যক্তি বিশ্বাস করে সুস্থতা-অসুস্থতা। ভালো-মন্দ। সুখ-দুঃখ, সব কিছ ুআল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে। আর আল্লাহ সর্বাবস্থায় বান্দার কল্যাণকামী এই বিষয়ে দৃঢ় আস্থা রাখে। সুস্থতা-অসুস্থতা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আল্লাহ তায়ালা এগুলোর দ্বারা বান্দাদের পরীক্ষা করেন। বান্দা আল্লাহয় কতটা নির্ভরশীল ও ধৈর্যশীল তা পরখ করেন। কুরআনে এসেছে- ‘অবশ্যই আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি এবং ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও ধৈর্যশীলদের’ (সূরা বাকারা-১৫৫)।
অসুস্থতায় উদ্বিগ্নতা নয়
মানুষ অসুস্থ হবে এটি স্বাভাবিক বিষয়। তাই অস্থির ও উদ্বিগ্ন না হয়ে শান্তচিত্তে নবীজীর দেখানো সুন্নাহ মতে রোগ মুক্তির চেষ্টা করা। আল্লাহর সাহায্য কামনা করা। মনে এই বিশ্বাস পোষণ করা যে, এই রোগের স্রষ্টা আল্লাহ, তিনিই আমাকে এর থেকে শেফা দেবেন। সাহাবি আম্মার ইবনে ইয়াসিরের কাছে লোকেরা শারীরিক ব্যথার কথা উল্লেখ করলে একজন গ্রাম্য ব্যক্তি বললেন, আমি কখনো অসুস্থ হইনি। তা শুনে আম্মার রা: বললেন, তুমি আমাদের দলভুক্ত নও। মুসলিম ব্যক্তি মুসিবত দ্বারা পরীক্ষিত হবে এবং এর মাধ্যমে তার গোনাহ মোচন হবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা-৩ : ২৩২) কুরআন ও হাদিস অনুযায়ী অসুস্থতায় মোমেনের করণীয় কী?
ধৈর্য ধরুন সম্মান অর্জন করুন
মুহাম্মদ সা: আল্লাহর সর্বাধিক প্রিয় বান্দা ও রাসূল ছিলেন। তিনি নিজেও রোগাক্রান্ত হয়েছেন। অসুস্থতায় ভুগেছেন। মূলত পৃথিবীতে যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার যত প্রিয়, সে ততধিক বিপদগ্রস্ত। হজরত আবু সাইদ খুদরি রা: বলেন, আমি নবীজীর জ্বরাবস্থায় ঘরে গিয়ে তাঁর কম্বলে হাত দিলে জ্বরের প্রচণ্ডতা আঁচ করে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার জ্বরের প্রচণ্ডতা তো অনেক বেশি! তিনি বললেন, ‘নবীদের সাথে এমনটিই ঘটে। প্রতিদান বৃদ্ধির জন্য তাদের কষ্ট বৃদ্ধি করা হয়। নবীদের পরে সর্বাধিক কষ্ট দেয়া হয় নেককারদের’ (সুনানে বায়হাকি-৩ : ৩৭২)। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘ব্যক্তিকে তার দ্বীনানুপাতে পরীক্ষা করা হয়। যদি তার দ্বীন অনমনীয়-দৃঢ় হয়, তাহলে তার পরীক্ষা কঠোর হয়। আর যদি দ্বীন নমনীয় হয়, তাহলে তাকে তার দ্বীনানুযায়ী রোগ-বালাই দ্বারা পরীক্ষা করা হয়’ (তিরমিজি-২৩৯৮)। কখনো কখনো আল্লাহ তায়ালা নিজের কাছে ব্যক্তির সম্মান বৃদ্ধির জন্যও অসুস্থতা দিয়ে থাকেন।
শুকরিয়া করুন, ক্ষমার সুযোগ লুফে নিন
অসুস্থতা মোমেনের জন্য শাপেবর। এ ক্ষেত্রে ক্ষতির তুলনায় কল্যাণই অধিক অর্জিত হয়। আল্লাহ তায়ালা মোমেন ব্যক্তির বালা-মুসিবত ও কষ্টে মাগফিরাত নিহিত রেখেছেন। নবীজী বলেছেন, ‘যখন কোনো মোমেন ব্যক্তি অসুস্থ হয় এর দ্বারা আল্লাহ তায়ালা ব্যক্তির গোনাহ মিটিয়ে দেন’ (বুখারি-৫৬৬০)। তাই তো নবীরা নিজেদের অসুখে, অসুস্থতায় বিচলিত না হয়ে বরং খুশি হতেন। নবীজী সা: বলেছেন, ‘তোমরা প্রাচুর্যে যতটা খুশি হও নবীরা বিপদে ততটা খুশি হন’ (ইবনে মাজাহ-৪০২৪)। তাই অসুস্থতায় কষ্ট না পেয়ে বরং খুশি ও শুকরিয়া আদায় করা উচিত।
অসুস্থতার নিয়ামতের বদলায় সুস্থতার আবেদন
মানুষ হিসেবে আমরা বড় দুর্বল। ঈমানের দিক থেকেও এতটা সবল নই যে, আল্লাহর দেয়া সব পরীক্ষা উৎরে যাব নবী ইবরাহিম আ:-এর মতো। কিংবা বছরের পর বছর ধৈর্য ধরব নবী ইয়াকুবের মতো। আমরা অল্পতেই কাতর হয়ে পড়ি। তাই, অসুস্থতা যদি আপনার সহ্য সীমার বাইরে চলে যায়, তাহলে উচিত আল্লাহ তায়ালার কাছে রোগমুক্তির জন্য প্রার্থনা করা। দোয়ায় এভাবে বলা- হে সুস্থতা ও অসুস্থতার মালিক আল্লাহ! আমাকে অসুস্থতার নিয়ামতের বদলায় সুস্থতার নিয়ামত দান করুন।
স্বল্পকালীন কষ্টে চিরস্থায়ী মুক্তি
পৃথিবীর অসুস্থতা আল্লাহর নিয়ামত বৈ কিছু নয়। সামান্য অসুখের কষ্ট দিয়ে আল্লাহ মোমেন বান্দাদের জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ দেন। জান্নাতে মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। নবীজী সা: বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এটি (অসুস্থতা) আগুন যা আমি দুনিয়াতে মোমেন বান্দাদের ওপর চাপিয়ে দেই। যাতে আখিরাতের আজাবের অংশ দুনিয়াতেই শেষ হয়’ (তিরমিজি-২০৮৮)। মুজাহিদ রহ: বলেন, জ্বর প্রত্যেক মোমেনের জাহান্নামের আগুনের অংশ। অন্যত্র এসেছে, নবীজী সা: বলেছেন, জ্বর জাহান্নামের উত্তপ্ত হাঁপর। আর তা মোমেনের জাহান্নামের নির্ধারিত অংশ’ (বায়হাকি-৯৩৮৬)। অসুস্থতা ব্যক্তিকে পাপমুক্ত করে স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো করে। নবীজী সা: আরো বলেছেন, ‘রোগমুক্ত মোমেন আসমান থেকে বর্ষিত বরফখণ্ডের মতো স্বচ্ছ’ (তিরমিজি-২০৮৬)। তাই, অসুস্থতাকে নিয়ামত ভাবুন।
অসুস্থতাকে গালি দেয়া অনুচিত
অনেকেই অসুস্থতায় বিরক্ত হয়ে গালিগালাজ করেন। ধৈর্যহারা হন। খেই হারিয়ে ফেলেন। এমনটি করা অনুচিত। হজরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা: বলেন, নবীজী উম্মু সায়েবের ঘরে প্রবেশ করে দেখলেন সে কাঁপছে। নবীজী সা: বললেন, ‘কী ব্যাপার? তুমি অবিরত কাঁপছ?’ উত্তরে তিনি বললেন, জ্বর। আল্লাহ যেন তাতে বরকত না দেন। নবীজী সা: বললেন, ‘জ্বরকে গালি দিও না। কেননা, তা আদম সন্তানের গোনাহ দূর করে যেমন হাঁপর লোহাকে জংমুক্ত করে’ (মুসলিম-২৫৭৫)। মোমেন ব্যক্তির অসুস্থতাও অনুরূপ তাকে পাপের সব জংমুক্ত করে।
দান-সদকা করা
অসুস্থাবস্থায় একজন মুমিনের অধিক পরিমাণে দান-সদকা করা উচিত। কারণ, এতে রোগ মুক্তির সম্ভাবনা রয়েছে। নবীজী সা: বলেছেন, ‘তোমরা অসুস্থদের চিকিৎসা করো সদকার মাধ্যমে’ (বায়হাকি-৩৫৫৭)। অন্যত্র এসেছে, নবীজী বলেন, ‘তোমরা অধিক পরিমাণে সদকা করো। কেননা, মুসিবত (অসুস্থতা) সদকাকে অতিক্রম করতে পারে না’ (বায়হাকি-৮০৮৩)।
দোয়ায় গুরুত্ব দেয়া
মোমেন সর্বদা আল্লাহমুখী হবেন। সুখে-দুঃখে, সুস্থতা ও অসুস্থতায় আল্লাহকে ডাকবেন। দোয়া ও প্রার্থনা করবেন। কারণ রোগ মুক্তির একমাত্র অধিকারী আল্লাহ। ইবরাহিম আ: স্বীয় রবের পরিচয়ে বলেছিলেন, ‘যখন আমি রোগাক্রান্ত হই তখন তিনিই রোগমুক্ত করেন’ (সূরা শুয়ারা-৮০)। নবীজী সা: বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে ক্ষমা ও সুস্থতা চাও। কেননা, ঈমানের পরে সুস্থতার চেয়ে উত্তম বস্তু কাউকে দেয়া হয়নি’ (তিরমিজি-৩৫৫৮)।
চিকিৎসার আশ্রয় নেয়া
অসুস্থতায় চিকিৎসা করাও মোমেন ব্যক্তির উচিত। অসুস্থতায় চিকিৎসা করা আল্লাহ ভরসার পরিপন্থী নয়। নবীজী নিজেও অসুস্থতায় চিকিৎসা নিয়েছেন, ওষুধ খেয়েছেন এবং উম্মতকেও চিকিৎসা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছেন। হাদিসে এসেছে, নবীজী সা: বলেন, ‘হে আল্লাহর বান্দারা তোমরা চিকিৎসার ব্যবস্থা করো। কেননা, আল্লাহ বার্ধক্য ব্যতীত সব রোগের ওষুধ রেখেছেন’ (ইবনে মাজাহ-২৭৮৯)। তাই, অসুস্থতায় চিকিৎসা না করাই বরং নবীজী সা:-এর সুন্নাহ পরিপন্থী কাজ।
ধৈর্র্য ধারণকারীরাই সত্যাশ্রয়ী
সর্বোপরি, মোমেনের উচিত অসুস্থতায় ধৈর্য ধারণ করা এবং আল্লাহর প্রতিদানের আশা রাখা। আল্লাহভীত, সত্যনিষ্ঠ বান্দার বৈশিষ্ট হলো, রোগ-শোক সর্বাবস্থায় ধৈর্য ধারণ করা। আল্লাহ বলেছেন- ‘যারা অভাবে, রোগে-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্য ধারণকারী, তারাই সত্যাশ্রয়ী, তারাই মুত্তাকি’ (সূরা বাকারা-১৭৭)। স্বর্ণ আগুনে পুরেই নিজেকে খাঁটি করে। লোহা হাঁপরে নিক্ষিপ্ত হয়েই নিজেকে জংমুক্ত করে। তেমনি একজন মোমেন বিপদাপদ ও অসুখ-বিসুখের সম্মুখীন হয়ে, ধৈর্যের প্রমাণ দিয়েই আল্লাহর প্রিয় হয়।
লেখক :
খতিব-বাইতুল আজিম জামে মসজিদ, রংপুর
Leave a Reply