বিয়ে আল্লাহ তায়ালার আদেশ। নবীজী সা:-এর গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ। বিয়ে হলো আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে রহমত ও বরকত, পরিতৃপ্তি ও প্রশান্তির সর্বোত্তম ফোয়ারা। ঈমানের পূর্ণতা, উন্নতি ও চারিত্রিক আত্মরক্ষার অনুপম হাতিয়ার। পুরুষ ও নারীর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন এবং হালালভাবে বংশবিস্তারের একমাত্র বৈধ ও বিধিবদ্ধ অবলম্বন। এ বিয়ের কল্যাণে পারস্পরিক ভালোবাসা-ভালোলাগা ও দয়া প্রদর্শনের মাধ্যমে গড়ে ওঠে সুন্দর এক পৃথিবী।
বিয়ে একটি ইবাদত। হাদিস শরিফে এর মাধ্যমে ঈমানের পূর্ণতা অর্জিত হওয়ার কথা আলোচনা হয়েছে এবং পাত্র গরিব বা নিঃস্ব হলে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে ধনী বানিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতিও দেয়া হয়েছে। (সূরা নূর-৩২,বায়হাকি, শুআবুল ঈমান-৫৪৮৬)
কল্যাণকর, বরকতময়, প্রাচুর্যপূর্ণ ও সর্বোত্তম বিয়ে করতে হলে মোটা দাগে কিছু বিষয় গুরুত্ব দিয়ে মানতে হবে।
ক. পাত্র-পাত্রী নির্বাচনে দ্বীনদারিকে প্রাধান্য দেয়া।
পাত্রী নির্বাচনে লক্ষণীয় : হাদিস শরিফে রাসূল সা: দ্বীনদার মেয়েকে বিয়ে করার নির্দেশ দিয়েছেন। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূল সা: ইরশাদ করেছেন, ‘নারীদের (সাধারণত) চারটি বিষয় দেখে বিয়ে করা হয়। যথা-১. তার ধন-সম্পদ; ২. বংশমর্যাদা; ৩. রূপ-সৌন্দর্য ও ৪. দ্বীনদারি বা ধার্মিকতা। তবে তুমি দ্বীনদার (ধার্মিক) নারীকে বিয়ে করে সফল হও; অন্যথায় তুমি লাঞ্ছিত হবে।’ (বুখারি-৫০৯০, মুসলিম-১৪৬৬, সুনানে আবু দাউদ-২০৪৭)
কমপক্ষে দু’টি ক্ষেত্রে কোনোরূপ ছাড় না দেয়া। প্রথমটি হলো- সৌন্দর্য আর দ্বিতীয়টি হলো- দ্বীনদারি। অর্থাৎ কোনো নারীকে বিয়ের আগে অবশ্যই প্রথমে তার সৌন্দর্যের বিষয়টি জেনে নিতে হবে। তারপর দ্বীনদারি দেখতে হবে।
সুতরাং পাত্রীর সৌন্দর্য এবং দ্বীনদারি ঠিক থাকলে সামনে অগ্রসর হতে কোনো বাধা নেই।
আর সৌন্দর্যের মানদণ্ড পাত্রের চক্ষু শীতলতার মধ্যেই নিহিত।
সর্বোত্তম নারী সম্পর্কে হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে- হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, নবী করিম সা:-কে জিজ্ঞাসা করা হলো, নারীদের মধ্যে কোন নারী সর্বোত্তম? তিনি বললেন, ‘স্বামী যাকে দেখলে আনন্দবোধ করে বা পুলকিত হয়। কোনো নির্দেশ দিলে আনুগত্য করে এবং সে তার নিজস্ব ব্যাপারে বা তার অর্থ-সম্পদের ব্যাপারে যেটি অপছন্দ করে তার বিপরীত কিছু করে না।’ (মুসনাদে আহমদ-৭৪২১, সুনানে নাসায়ি, কুবরা, হাদিস-৮৯৬১)
তবে বিয়ে করার ক্ষেত্রে কোনো মেয়েকে গ্রহণ ও বর্জন যেন হয় দ্বীনদারিকে কেন্দ্র করে। যেমনটি ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ. বলেছেন, ‘কোনো পুরুষ যদি কোনো নারীকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় তাহলে সর্বপ্রথম তার সৌন্দর্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবে। যদি এ ব্যাপারে তার প্রশংসা করা হয় তাহলে তার দ্বীন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবে। দ্বীনের ক্ষেত্রে যদি প্রশংসিত হয় তাহলে বিয়ে করবে; অন্যথায় দ্বীনের কারণে প্রত্যাখ্যান করবে।
আর এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ধার্মিকতা ও নীতি-নৈতিকতাহীন নারী একজন পুরুষের জন্য এবং তার পরিবার ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মারাত্মক ফিতনা, অশান্তি এবং ধ্বংসের কারণ।
পাত্র নির্বাচনে লক্ষণীয় : চরিত্রবান, দ্বীনদার, সভ্য-ভদ্র ও সঠিক আকিদা-বিশ্বাসের কোনো পাত্র পেলে তাকে অগ্রাধিকার দেয়া। কেননা, রাসূল সা: বলেন, ‘যখন তোমাদের কাছে এমন কোনো পাত্র বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে, যার চরিত্র ও দ্বীনদারিতে তোমরা সন্তুষ্ট; তবে তোমরা তার বিয়ের ব্যবস্থা করে দাও। যদি তোমরা তা না করো, তবে তা পৃথিবীতে বিপর্যয় ডেকে আনবে এবং ব্যাপক বিশৃঙ্খলার কারণ হবে।’ (তিরমিজি-১০৮৪, ইবনে মাজাহ-১৯৬৭)
খ. শরিয়তসম্মত পন্থায় পাত্র-পাত্রী একে অপরকে দেখা।
এটি মুস্তাহাব বা সাওয়াবের কাজও বটে। এ ক্ষেত্রে নিয়মতান্ত্রিক বা অনিয়মতান্ত্রিক উভয়ভাবেই দেখা বৈধ হওয়ার বিষয়টি হাদিস ও ফিকাহশাস্ত্র দ্বারা প্রমাণিত।
(সূত্র-সুনানে বায়হাকি, সপ্তম খণ্ড, ৮৪ পৃষ্ঠা; হাদিস নং- ১৩৪৮৭, ১৩৪৮৮, ফতোওয়া শামি, ষষ্ঠ খণ্ড, ৩৭০ পৃষ্ঠা) গ. বিয়ে অনুষ্ঠান এবং তার আগে ও পরের সমস্ত বিষয়কে সম্পূর্ণ শরয়ি আদলে সম্পন্ন করা।
যা খুব স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সহজসাধ্যভাবে অল্প খরচে সম্পাদন করা। অপব্যয়-অপচয় থেকে মুক্ত থাকা। কেননা, কুরআনে কারিমে অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই আখ্যা দেয়া হয়েছে। (সূরা বনি ইসরাইল : ২৬-২৭)
ওমর ইবনে খাত্তাব রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘সর্বোত্তম হলো যা খরচের দিক থেকে সহজসাধ্য হয়।’ (সুনানে আবু দাউদ-২১৯)
বিয়ে যত অনাড়ম্বর হবে, খরচ যত কম হবে, ততই তা বরকতপূর্ণ হবে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘সর্বাধিক বরকতপূর্ণ বিয়ে হচ্ছে, যার খরচ যত সহজ ও স্বাভাবিক হয়।’ (মুসনাদে আহমদ-২৪৫২৯)
ঘ. প্রস্তাব ও মোহরানা সহজ করা।
কেননা, এটি বরকতের আলামত। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘কনের বরকতের আলামত হচ্ছে-বিয়ের প্রস্তাবনা সহজ হওয়া, মোহরানা সহজসাধ্য হওয়া এবং গর্ভধারণ সহজ হওয়া।’ (সহিহুল জামে-২২৩৫)
আরেক হাদিসে হজরত ইবনে উমর রা: থেকে বর্ণিত হয়েছে- তিনি বলেন, ‘সাবধান, তোমরা নারীদের মোহরানা নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে না। যদি মোহরানা নিয়ে বাড়াবাড়ি করা দুনিয়ায় সম্মানের বিষয় হতো কিংবা আল্লাহর কাছে তাকওয়া হতো তাহলে তোমাদের নবী তা করতেন।’ (সুনানে তিরমিজি-১১৪)
বায়হাকির এক বর্ণনায় এসেছে, নবী সা: বলেছেন, ‘সর্বোত্তম মোহরানা হচ্ছে- সহজসাধ্য মোহরানা’। (হাদিস নং-১৪৭২১)
ঙ. বর বা তার নিকটবর্তী স্বজন কর্তৃক সামর্থ্য অনুযায়ী ওলিমার আয়োজন করা।
স্বামী-স্ত্রী বাসর রাত যাপনের পর শুকরিয়াস্বরূপ মানুষকে খাওয়ানোর নাম ওলিমা।
রাসূলুল্লাহ সা: নিজেও ওলিমা করেছেন এবং সাহাবিদেরও করতে বলেছেন। জয়নব বিনতে জাহাশ রা:-কে বিয়ে করার পরদিন নবীজী সা: ওলিমা করেছিলেন। (বুখারি-৫১৭০)
রাসূলুল্লাহ সা: ছাফিয়াহ রা:-কে বিয়ের পর তিন দিন যাবত ওলিমা খাইয়েছিলেন। (মুসনাদে আবু ইয়ালা-৩৮৩৪)
তবে এতে বিরাট কোনো আয়োজনের প্রয়োজন নেই, অপচয় তো নয়ই; বরং প্রত্যেকে যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যবস্থা করবে। এতে আত্মীয়স্বজন, গরিব-দুঃখী, ধনী সব স্তরের মানুষ শামিল করবে। শুধু ধনীদের প্রাধান্য দেবে না। কেননা, হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘ওই ওলিমার খাবার সর্বনিকৃষ্ট, যাতে দরিদ্রদের বাদ দিয়ে শুধু ধনীদেরই দাওয়াত দেয়া হয়।’ (বুখারি-৫১৭৭) এ ছাড়া অন্য কোনো খানাপিনার আয়োজন সুন্নাহসম্মত নয়। (বুখারি-২০৪৮)
লেখক :
সিনিয়র মুদাররিস, জামিয়া কাসিমুল উলুম, শ্রীনগর, মুন্সীগঞ্জ, ঢাকা
Leave a Reply