এ এক নিঃসঙ্গ অনুভূতি যে, আপনার দেশের নেতারা আপনাকে দেখতে চান না। বর্তমানে অনেকাংশেই হিন্দু-ফার্স্ট ভারতে মুসলিম হলে আপনাকে অপমানিত হতে হবে।
এমনটা সব ক্ষেত্রেই হচ্ছে। কয়েক দশকের জানাশোনা প্রিয় বন্ধুরাও বদলে যায়। প্রতিবেশীরা প্রতিবেশীসুলভ আচরণ করা থেকে বিরত থাকে: কোনো উৎসব- উদযাপনে যোগ দেয় না কিংবা কষ্টের সময়ে জিজ্ঞাসা করার জন্য দরজায় কড়া নাড়ে না।
‘এটা প্রাণহীন এক জীবন,’ বলছিলেন জিয়া উস সালাম নামের এক লেখক যিনি দিল্লির উপকণ্ঠে স্ত্রী উজমা আউসফ এবং চার কন্যার সাথে বসবাস করেন।
৫৩ বছর বয়সী মিঃ সালাম এক সময় ভারতের অন্যতম প্রধান সংবাদপত্রের জন্য চলচ্চিত্র সমালোচক হিসেবে কাজ করতেন। সিনেমা, শিল্প, সঙ্গীতেই তার সময় কেটে যেতো। দিনের শেষে দীর্ঘ আড্ডার জন্য পুরনো এক বন্ধুর মোটরসাইকেলের পেছনে চড়ে প্রিয় খাবারের দোকানে চলে যেতেন৷ তার স্ত্রী-ও সাংবাদিক ছিলেন যিনি লাইফ, ফুড, ফ্যাশন নিয়ে লিখতেন।
এখন, মিঃ সালামের রুটিন কেবল অফিস এবং বাসার মধ্যে সীমাবদ্ধ। ভারী উদ্বেগ তার ভাবনার জায়গাগুলো দখল করেছে। ‘দৃশ্যতই মুসলিম’- ব্যাঙ্ক টেলার, পার্কিং লট অ্যাটেনডেন্ট, ট্রেনের সহযাত্রীদের দ্বারা ক্রমাগত এমন জাতিগত প্রোফাইলিং এর কারণে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। পারিবারিক কথোপকথন আরও কষ্টকর, বাবা-মা উভয়ই এমন একটি দেশে নিজেদের কন্যাদের লালন-পালন করছেন যেটি ক্রমবর্ধমানভাবে প্রশ্ন তোলে কিংবা এমনকি মুসলিমদের পরিচয়ের চিহ্নগুলোকে মুছে ফেলার চেষ্টা করে — তারা কীভাবে পোশাক পরে, তারা কী খায়, এমনকি তাদের ভারতীয় নাগরিকত্ব নিয়েও।
তাদের মধ্যে এক কন্যাকে (চিত্তাকর্ষক স্টুডেন্ট-অ্যাথলিট) এতোটাই সংগ্রাম করতে হয়েছিল যে, তার কাউন্সেলিং এর প্রয়োজন ছিল এবং সে কয়েক মাস স্কুলেও যেতে পারে নি। দিল্লির ঠিক বাইরে নয়ডায় মিশ্র হিন্দু-মুসলিম পাড়ায় থাকাটা ঠিক হবে কিনা তা নিয়ে পরিবারটিতে প্রায়ই বিতর্ক হয়।
তাদের সবচেয়ে বড় কন্যা মরিয়ম (স্নাতক শিক্ষার্থী) জীবনকে সহনীয় করে তোলার জন্য যেকোনও কিছুতে আপস করার দিকে ঝুঁকে পড়ে। সে চায় চলে যেতে।
মুসলিম এলাকা ব্যতীত অন্য যে কোনো কোথাও কঠিন হতে পারে। রিয়েল এস্টেট এজেন্টরা প্রায়ই সরাসরি জিজ্ঞাসা করে বসে যে, পরিবারগুলো মুসলিম কিনা; বাড়িওয়ালারা তাদের ভাড়া দিতে নারাজ। মরিয়ম বলেন, “আমি এটায় মানিয়ে নিতে শুরু করেছি।
“আমি মানছি না,” সালাম মরিয়মের পাল্টায় বলছিলেন। তিনি এটা স্মরণ করবার জন্য যথেষ্ট বয়সী যে, আগে কবে বিশাল বৈচিত্র্যময় ভারতে সহাবস্থান ছিল মূল আদর্শ৷ তিনি দেশের ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতায় যুক্ত হতে চান না।
তবে, তিনি বাস্তববাদীও বটে। তিনি চান মরিয়ম বিদেশে পাড়ি দিক, অন্তত দেশের এমন অবস্থায়।
মিস্টার সালাম এই আশাকে আঁকড়ে ধরে আছেন যে ভারতে এটি একটি ক্ষণস্থায়ী পর্যায়।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অবশ্য লম্বা খেল খেলছেন।
দ্রুত উন্নয়নের প্রতিশ্রুতিতে ১০১৪ সালে জাতীয় ক্ষমতায় তার উত্থান, দশক পুরনো হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে ভারতীয় রাজনীতির প্রান্ত থেকে কেন্দ্রে দৃঢ়ভাবে নিয়ে যায়। তখন থেকে (কখনও কখনও বিস্ফোরক ধর্মীয় এবং বর্ণ বিভাজন সত্ত্বেও) তিনি ভারতকে দীর্ঘদিন ধরে একত্র করে রাখা ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামো এবং শক্তিশালী গণতন্ত্র থেকে দূরে সরে গেছেন।
দক্ষিণপন্থী সংগঠনগুলো ভারতীয় সমাজকে পুনর্নির্মাণের চেষ্টায় মিস্টার মোদির চারপাশের বিশাল শক্তিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। তাদের সদস্যরা সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের উসকানি দেয়। সরকার সেখান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও পরে কর্মকর্তাদের মুসলমানদের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দিতে এবং মুসলিম পুরুষদের ঘিরে ফেলতে দেখা যায়। সাহসী সজাগ গোষ্ঠী গরুর মাংস পাচারের অভিযোগে মুসলমানদের পিটিয়ে হত্যা করেছে (অনেক হিন্দুর কাছে গরু পবিত্র)। মিস্টার মোদির দলের শীর্ষ নেতারা প্রকাশ্যে হিন্দুদের সাথে উদযাপন করেছেন যারা কিনা মুসলমানদের বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে।
ব্রডকাস্ট মিডিয়ার বৃহৎ অংশে, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ধর্মান্ধতা অবাধ করা হয়েছে। মুসলিম পুরুষরা হিন্দু নারীদের ধর্মান্তরিত করার জন্য প্রলুব্ধ করে, এমনকি রেস্তোরাঁর খাবারে মুসলমানরা থুথু ফেলে- এমন সব ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া হয় হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপগুলো থেকে। মিঃ মোদি এবং তার দলের নেতারা ভারতীয়দের সমানভাবে কাভার করে এমন কল্যাণমূলক কর্মসূচির দিকে ইঙ্গিত করে বৈষম্যের দাবি প্রত্যাখ্যান করলেও মিঃ মোদি নিজেই এখন পরের মাসের শুরুতে শেষ হতে যাওয়া নির্বাচনে মুসলিম-বিরোধী উপমার পুনরাবৃত্তি করছেন। তিনি ভারতের ২০ কোটি মুসলমানকে আগের চেয়ে আরও বেশি সরাসরিভাবে টার্গেট করেছেন, তাদের “অনুপ্রবেশকারী” বলে অভিহিত করেছেন এবং ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তাদের অনেক সন্তান রয়েছে।
এই ‘ক্রীপিং ইসলামোফোবিয়া’ই এখন মিঃ সালামের লেখনীর প্রধান বিষয়। সিনেমা এবং সঙ্গীত, জীবনের আনন্দ, এখন সবই ছোট মনে হয়। একটি বইয়ে, তিনি মুসলিম পুরুষদের হত্যার ঘটনাবলী বর্ণনা করেছেন। সাম্প্রতিক একটি ফলো-আপে, তিনি বর্ণনা করেছেন, কিভাবে ভারতের মুসলমানরা নিজেদের জন্মভূমিতে নিজেদের ‘অনাথ’ ভাবছেন।
তিনি বলেন, ‘আমি যদি এই ইস্যুগুলো নিয়ে না লিখি, কেবল সিনেমা ও সাহিত্যেই নিজ শক্তি সীমাবদ্ধ করি, তাহলে নিজেকে আয়নায় দেখতে পারবো না। ভবিষ্যতে আমি আমার বাচ্চাদের কী জবাব দেবো – যখন আমার নাতি-নাতনিরা জিজ্ঞাসা করবে, অস্তিত্বের সংকটের সময়ে আপনি কী করতেন?’
ছোটবেলায় মিঃ সালাম দিল্লিতে হিন্দু, শিখ ও মুসলমান রয়েছেন- এমন রাস্তায় সময় কাটাতেন। বিকেলে রোদ তপ্ত হয়ে উঠলে শিশুরা হিন্দু মন্দিরের আঙিনায় গাছের ছায়ায় খেলাধুলা করতো। মন্দিরের পুরোহিত সবার জন্য জল নিয়ে আসতেন। “আমি তার কাছে অন্য বাচ্চাদের মতোই ছিলাম,” মিঃ সালাম স্মরণ করছিলেন।
সেই স্মৃতিগুলো একটি কারণ যেসবের জন্য মিঃ সালাম এই দৃঢ় আশাবাদ বজায় রেখেছেন যে ভারত তার ধর্মনিরপেক্ষতার পোশাক পুনরুদ্ধার করতে পারে। আরেকটি হল- দেশের বৃহৎ অংশে মিঃ মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদ নির্বিচারে চললেও দেশটির অধিক সমৃদ্ধ দক্ষিণের বেশ কয়েকটি রাজ্য তা প্রতিরোধ করেছে।
সেখানে মুসলমানদের মধ্যে পারিবারিক কথোপকথনও অন্য রকম: কলেজ ডিগ্রি, চাকরির পদোন্নতি, জীবন পরিকল্পনা – স্বাভাবিক আশা-আকাঙ্খা নিয়ে।
তামিলনাড়ু রাজ্যে, প্রায়শই ঝগড়া-বিবাদকারী রাজনৈতিক দলগুলো ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষায় এবং অর্থনৈতিক মঙ্গলকে কেন্দ্র করে ঐক্যবদ্ধ হয়। রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী এম.কে. স্ট্যালিন একজন ঘোষিত নাস্তিক।
রাজ্যের রাজধানী চেন্নাইতে পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে বসবাস করেন জান মোহাম্মদ। তিনি বলছিলেন, “প্রতিবেশীরা একে অপরের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দেন। গ্রামীণ এলাকার একটি ঐতিহ্য রয়েছে। যখন কোনো সম্প্রদায় কোনো উপাসনালয় নির্মাণ শেষ করে, তখন অন্যান্য ধর্মের গ্রামবাসীরা ফল, সবজি এবং ফুল উপহার নিয়ে আসে এবং খাবারের জন্য অবস্থান করেন।”
“আবাসনের চেয়েও বড় কথা হলো একটা বোঝাপড়া আছে,” মিঃ মোহাম্মদ বলছিলেন।
তার পরিবার ‘ওভারএচিভার’ এ পূর্ণ — তাদের শিক্ষিত রাজ্যটিতে যা কিনা আদর্শ। মিস্টার মোহাম্মদ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে নির্মাণ ব্যবসায় আছেন। অর্থনীতিতে ডিগ্রিধারী তার স্ত্রী রুখসানা সন্তান বড় হওয়ার পর অনলাইনে পোশাকের ব্যবসা শুরু করেন। এক মেয়ে মাইমুনা বুশরার দুটি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি আছে। সে একটি স্থানীয় কলেজে পড়ায়৷ তার বিয়ের প্রস্তুতি চলছে। সর্বকনিষ্ঠ হাফসা লুবনা বাণিজ্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী এবং দুই বছরের মধ্যে একটি স্থানীয় কোম্পানিতে ইন্টার্ন থেকে (২০ বছর বয়সে) ম্যানেজার হয়ে গেছে।
দুই মেয়েরই পিএইচডি চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। একমাত্র উদ্বেগ ছিল, সম্ভাব্য বর তাতে আতঙ্কিত হতে পারে। “প্রস্তাব আসা কমে যায়,” মিসেস রুখসানা মজা করে বলছিলেন।
এক হাজার মাইল উত্তরে দিল্লিতে মিঃ সালামের পরিবার অন্য দেশ বলে মনে হয়- এমন এক জায়গায় বাস করে। এমন একটি জায়গা যেখানে কুসংস্কার এতোটাই নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে উঠেছে যে ২৬ বছরের বন্ধুত্বও এর ফলে ভেঙ্গে যেতে পারে।
মিঃ সালাম বিশাল আকৃতির জন্য তার একজন সাবেক সম্পাদককে ‘মানব পাহাড়’ ডাকনাম দিয়েছিলেন। শীতকালে দিল্লিতে কাজ শেষে যখন তারা সম্পাদকের মোটরসাইকেলে চড়তেন, তখন তিনি মিঃ সালামকে ঠান্ডা বাতাস থেকে রক্ষা করতেন।
তারা প্রায়ই একসাথে থাকতেন; যখন তার বন্ধুটি ড্রাইভিং লাইসেন্স পায়, তখনও সালাম সাহেব তার সাথে ছিলেন।
“আমি প্রতিদিনই মসজিদে যেতাম, আর তিনি মন্দিরে যেতেন।” মিঃ সালাম বলছিলেন, “আমি সেজন্য তাকে সম্মান করতাম।”
কয়েক বছর আগে, ব্যাপারগুলোর পরিবর্তন হতে শুরু করে। প্রথমে হোয়াটসঅ্যাপ ম্যাসেজ এসেছিল।
সম্পাদক মিঃ সালামের কাছে মুসলিম বিরোধী ভুল তথ্যের কিছু জিনিস ফরোয়ার্ড করা শুরু করেন: উদাহরণস্বরূপ, মুসলমানরা ২০ বছরের মধ্যে ভারত শাসন করবে কারণ তাদের নারীরা প্রতি বছর সন্তান জন্ম দেয় এবং তাদের পুরুষদের চার স্ত্রীর বিধান আছে।
“প্রাথমিকভাবে, আমি বলেছিলাম, আপনি কেন এসবের মধ্যে ঢুকতে চান? আমি ভেবেছিলাম তিনি একজন বৃদ্ধ মানুষ, তিনি এসব পাচ্ছেন এবং ফরোয়ার্ড করছেন।” মিঃ সালাম বলছিলেন, “আমি তাকে বেনিফিট অফ ডাউট দিই।”
ব্রেকিং পয়েন্টটি এসেছিল দুই বছর আগে, যখন মোদির অনুচর যোগী আদিত্যনাথকে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পুনঃনির্বাচিত করা হয়েছিল৷ এটি সালামরা যেখানে বসবাস করেন অর্থাৎ দিল্লি সংলগ্ন জনবহুল আরেকটি রাজ্য। মিঃ আদিত্যনাথ, মুসলমানদের বিষয়ে মিঃ মোদির চেয়েও স্পষ্টতই আরও বেশি বিদ্রোহী যিনি হিন্দু সন্ন্যাসীদের জাফরান পোশাক পরে রাজ্য শাসন করেন, ঘন ঘন হিন্দু তীর্থযাত্রীদের বিশাল জনতাকে ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা দেন। অন্যদিকে, মুসলিম ধর্মবিশ্বাসের প্রকাশ্য প্রদর্শনে ক্র্যাক ডাউন চালান।
ভোট গণনার দিন, ওই বন্ধুটি মিঃ আদিত্যনাথের এগিয়ে যাওয়ায় আনন্দিত হয়ে মিঃ সালামকে ফোন করতে থাকেন। মাত্র কয়েকদিন আগেই বন্ধুটি মিঃ আদিত্যনাথের প্রথম মেয়াদে ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব এবং নিজ ছেলের চাকরি খোঁজার সংগ্রামের বিষয়ে অভিযোগ করছিলেন।
“আমি বললাম, ‘তুমি সকাল থেকেই এতো খুশি, তোমার লাভটা কি?”
“যোগী নামাজ বন্ধ করেছেন,” শুক্রবারে মুসলিমদের জুম্মার নামাজের জমায়েত (যা প্রায়শই রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে) এর কথা উল্লেখ করে বন্ধুটি বলছিলেন।
“সেই দিনই আমি (তাকে) বিদায় জানিয়েছিলাম,” মিস্টার সালাম বলছিলেন “এরপর সে আর কখনো আমার জীবনে ফেরে নি।”
[যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বখ্যাত পত্রিকা নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাউথ এশিয়ার ব্যুরোপ্রধান মুজিব মাশাল এবং রিপোর্টার হরি কুমারের এই প্রতিবেদনটি ১৮ মে ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছে। অনুবাদ করেছেন তারিক চয়ন।]
Leave a Reply