রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির আগামী দিনের রাজনীতিতে কৌশলগত পরিবর্তন আসতে পারে। দীর্ঘ দিন ধরে চলা সরকার পতন আন্দোলনে কাক্সিক্ষত ফল না আসায় দলটির অভ্যন্তরে পলিসিগত বিষয়গুলো নিয়ে এখন পর্যালোচনা চলছে। সরকার পতন, নাকি সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিকে মূল লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করা হবে তা নিয়ে নানা ধরনের মতামত আসছে। জানা গেছে, আগামীতে সরকার পতনকে প্রধান টার্গেট না করে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি সামনে রেখে আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারে বিএনপি।
দলটির শীর্ষপর্যায়ের নেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনের পর আগামী দিনের রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে বিএনপির অভ্যন্তরে আলোচনা শুরু হয়েছে। দলটি মনে করছে, বিগত নির্বাচনে ৯০ ভাগ ভোটার ভোট বর্জন করে তাদের অবস্থান জানিয়ে দিয়েছে। এখন জনগণের এই আকাক্সক্ষাকে ধারণ করেই সামনে এগিয়ে যেতে হবে। এর কোনো বিকল্প বিএনপির সামনে নেই।
বিএনপি নেতারা বলেছেন, বিদ্যমান ‘একদলীয়’ রাষ্ট্র কাঠামোতে আন্দোলন করে সরকারের পতন ঘটানো কঠিন কাজ। ’৯০ এর পরে এ ধরনের কোনো আন্দোলন সফল হয়নি। ’৯০ এর আন্দোলন সফল হওয়ার পেছনেও যে ধরনের শক্তি এগিয়ে এসেছিল, সে ধরনের কোনো বাস্তবতাও বর্তমানে নেই। সরকার রাষ্ট্রের সব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ নিয়ন্ত্রণে রেখে শাসনক্ষমতা ধরে রেখেছে। এমন পরিস্থিতিতেও হামলা-মামলা-গ্রেফতার উপেক্ষা করে বিএনপি গত ১৫ বছর ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এখন দলটি আরো সুনির্দিষ্টভাবে আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যাবে। ভোট ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনাই হবে আন্দোলনের মূল লক্ষ্য।
এ ছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতি ঘিরে এশিয়ার পরাশক্তিগুলোর অবস্থানও পর্যালোচনা করছে বিএনপি। ইতোমধ্যে দলটি বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় আনার পেছনে ভারত, চীন ও রাশিয়া সহায়তা করেছে বলে অভিযোগ করেছে। নির্বাচনের পর ভারতের পণ্য বয়কটেরও ডাক দেয়া হয়েছিল বিভিন্ন পর্যায় থেকে। এসব পরাশক্তির সাথে আগামী দিনে বিএনপির সম্পর্কের নীতি কী হবে তা নিয়ে ভাবছেন দলের শীর্ষ নেতারা।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখবে বিএনপি। এর সাথে ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচি বাড়িয়ে ধীরে ধীরে রাজপথে শক্ত অবস্থান তৈরির চেষ্টা করা হবে। একইসাথে দল পুনর্গঠনেও এখন মনোযোগ দেয়ার বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছেন নীতিনির্ধারকরা।
বিএনপির শীর্ষপর্যায়ের সূত্র জানায়, পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বুঝে-শুনে সামনের দিকে এগোতে চান তারা। অর্থাৎ যেকোনো কর্মসূচি ও সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা হবে। বিএনপি বলছে, গণমানুষের দাবি এবং আশা-আকাক্সক্ষা থেকে সরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই নির্বাচনের পর কিছুদিন বিরতি দিয়ে সারা দেশে সাংগঠনিক সবপর্যায়ে কালো পতাকা মিছিল পালন করা হয়েছে। এই ধরনের বিক্ষোভ কর্মসূচির মধ্যে থাকতে চান তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা নয়া দিগন্তকে বলেন, গত কয়েক দিনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়নি। শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা নতুন কর্মসূচি নিয়ে ভাবছেন। এখন আসন্ন পবিত্র রমজান মাসকে কেন্দ্র করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে গুচ্ছ কর্মসূচি দেয়ার পরিকল্পনা হচ্ছে।
দলীয় সূত্র জানায়, আগামীতে যুগপৎ আন্দোলনের পাশাপাশি দলীয় কর্মসূচিও পালন করবে বিএনপিসহ মিত্ররা। তবে ব্যাপক ভিত্তিতে নয়, স্বল্প পরিসরে থেমে থেমে কর্মসূচি দিয়ে যুগপৎ আন্দোলন চলবে। দিবসভিত্তিক কর্মসূচির সাথে বিক্ষোভ সমাবেশ, মানববন্ধনের মতো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে আন্দোলন এগিয়ে নেবে বিএনপি ও শরিকরা।
শীর্ষপর্যায়ের নেতাদের মূল্যায়ন, গত ৩০ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম কার্যদিবসে সারা দেশে কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে পুলিশের বাধার মুখে পড়েছেন তারা। এর আগে ২৬ ও ২৭ জানুয়ারিও কালো পতাকা কর্মসূচি পালন করে দলটি। সেখানেও বাধা দেয়া হয়েছে অনেক জায়গায়। এর মাধ্যমে নির্বাচন পরবর্তী সরকারের মনোভাব বুঝতে পেরেছেন তারা। তবে কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণে দলের নীতিনির্ধারকরা সন্তুষ্ট। সদ্য কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া নেতাকর্মীরাও এতে অংশ নেয়ায় দলে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে।
দলের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, কারাবন্দী নেতাকর্মীদের জামিনে মুক্ত করাই এখন তাদের মূল লক্ষ্য। তাই এখন দল এমন কোনো কর্মসূচি দিতে চায় না যাতে সরকার হার্ডলাইনে চলে যায়। দলের স্থায়ী কমিটির একজন নেতা বলেন, নির্বাচনে জয়ী হলেও সরকারের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে গেছে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই নাজুক। সরকার বেশ চাপে আছে। এই অবস্থায় সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে তাদের ওপর চাপ তৈরি করা হবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটি সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে আছি। এই ধরনের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। রাজনৈতিক দল হিসেবে সরকারের অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাব।
বিএনপি নেতারা জানান, আর কিছু দিনের মধ্যে দলের পুনর্গঠন কাজে হাত দেয়া হতে পারে। সে ক্ষেত্রে একেবারে জেলাপর্যায় থেকে সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ স্তরগুলো পুনর্গঠন করা হবে। আন্দোলনে সক্রিয় ছিল না, কর্মীদের সাথে যোগাযোগ ছিল না- পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় এমন নেতাদের বাদ দেয়া হতে পারে। কারণ প্রাথমিক মূল্যায়নে সরকারবিরোধী আন্দোলনে নেতাদের বিশেষ করে অঙ্গসংগঠনের কাজে ক্ষুব্ধ বিএনপির হাইকমান্ড।
দলটি মনে করছে, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো রাজপথে প্রত্যাশিত সক্ষমতা দেখাতে পারেনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন দায়িত্বশীল নেতা জানান, স্থায়ী কমিটি পুনর্গঠনের বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। ছাত্রদলের বিষয়ে প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। তবে পুনর্গঠন ব্যাপকভাবে হবে কি না তা এখনো নিশ্চিত নয়।
Leave a Reply