‘সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর জন্য যিনি নিখিল বিশ^-জাহানের রব। যিনি পরম দয়ালু ও করুণাময়। যিনি প্রতিদান দিবসের মালিক’ (সূরা ফাতিহা : ১-৩)। আল্লাহর স্মরণের এটি দ্বিতীয় বাক্য। প্রথম বাক্যটি হলো- সুবহানআল্লাহ। যাকে ইসলামী পরিভাষায় তাসবিহ বলা হয় এবং আলহামদুলিল্লাহকে বলা হয় তাহমিদ বা কালিমাতুশ শোকর। আল্লাহর গুণাগুণ বর্ণনা করা প্রতিটি মানুষের জন্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির রীতি-নীতি। সচেতনতা ও আন্তরিকতার সাথে এ রীতির অনুসারী হলে অনিবার্যভাবে মানুষ কয়েকটি সুফল লাভ করতে পারে- ১. মানুষ অনেক খারাপ কাজ থেকে নিষ্কৃৃতি পেতে পারে। কারণ আল্লাহর নাম উচ্চারণ করার অভ্যাস তাকে প্রত্যেকটি কাজ শুরু করার আগে এ কথা চিন্তা করতে বাধ্য করবে যে, যথার্থই এ কাজে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করার কোনো ন্যায়সঙ্গত অধিকার তার আছে কি না। ২. বৈধ সঠিক ও সৎ কাজ শুরু করতে গিয়ে আল্লাহর নাম নেয়ার কারণে মানুষের মনোভাব ও মানসিকতা সঠিক দিকে মোড় নেবে। সে সব সময় নির্ভুল বিন্দু থেকে তার কাজ শুরু করবে। ৩. এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সফলতা হচ্ছে এই যে, আল্লাহর নামে যখন সে কাজ শুরু করবে তখন আল্লাহর সাহায্য, সমর্থন ও সহায়তা তার সহযোগী হবে। তার প্রচেষ্টায় বরকত হবে। শয়তানের বিপর্যয় ও ধ্বংসকারিতা থেকে তাকে সংরক্ষিত রাখা হবে। বান্দা যখন আল্লাহর দিকে ফিরে তখন আল্লাহও বান্দার দিকে ফিরেন, এটিই আল্লাহর রীতি।
পৃথিবীতে মহান আল্লাহ আমাদেরকে এমন অসংখ্য নিয়ামতরাজি দান করেছেন যা গুনে শেষ করা যাবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘যদি তোমরা আল্লাহর নিয়ামতসমূহ গুনতে চাও তাহলে গুনতে পারবে না। আসলে তিনি বড়ই ক্ষমাশীল ও করুণাময়’ (সূরা নাহল-১৮)। এই অসংখ্য নিয়ামতের জন্য যদি আমরা সারাজীবন তাঁর প্রশংসা করতে থাকি, তবুও তাঁর একটি নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা যাবে না। এ জন্য আমাদের জীবন ব্যবস্থা এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যে, সারাক্ষণ কোনো না কোনোভাবে যেন মুখ থেকে আল্লাহর জিকিরের শব্দ বেরিয়ে আসে। যেকোনো কথা-বার্তা ও কাজে-কর্মে চেতনে-অবচেতনে আল্লাহর নাম চলে আসবে। তবে এরূপ অবস্থা সৃষ্টি হওয়া খুব সহজ ব্যাপার নয়। কোনো লোকের মধ্যে এরূপ অবস্থা ততক্ষণ পর্যন্ত সৃষ্টি হয় না যতক্ষণ তার হৃদয়ে আল্লাহর চিন্তা-খেয়াল সম্পূর্ণ দৃঢ়মূল হয়ে না যাবে।
চেতনার স্তর হতে অবচেতন ও অনবচেতন পর্যন্ত আল্লাহর চিন্তা গভীর হয়ে গেলেই একজন লোকের এ অবস্থা হতে পারে যে, সে যে কাজই করবে আর যে কথাই বলবে তাতে আল্লাহর নাম সে অবশ্যই উচ্চারণ করবে। যেমন খাওয়ার আগে বিসমিল্লাহ, খাওয়ার পর আলহামদুলিল্লাহ, বিছানায় যেতে এবং শয্যা ত্যাগের সময় আল্লাহকে স্মরণ করবে। সাধারণ কথা বার্তায় মুখে বারে বারে বিসমিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, ইনশাআল্লাহ, মাশাআল্লাহ, সুবহানআল্লাহ, জাজাকাল্লাহ ও অনুরূপ অর্থের অন্যান্য শব্দ বা বাক্য বের হতে থাকবে। নিজের সব ব্যাপারে আল্লাহর রহমত ও সাহায্যের প্রার্থনা করবে। আল্লাহর প্রতিটি নিয়ামতের জন্য আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করবে। বিপদ-মুসিবত ও বিভিন্ন জটিলতার জন্য শুধু আল্লাহর দিকে মুখ করবে এবং আল্লাহরই সাহায্যের মুখাপেক্ষী হবে। রাসূল সা: যেকোনো বিপদে-মুসিবতে নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন। মোট কথা উঠতে-বসতে, চলতে-ফিরতে ও দুনিয়ার সব কাজ করতে আল্লাহর স্মরণ-আল্লাহর নাম করাই হবে তার স্থায়ী নিয়ম। প্রকৃতপক্ষে এটিই হচ্ছে ইসলামী জীবনের প্রাণশক্তি।
আল্লাহর শোকর গোজার করবেন, নয় তো কুফরে লিপ্ত হবেন, এ দুয়ের মধ্যে তৃতীয় কোনো অবস্থান কারো জন্য তৈরি করা হয়নি। শোকর গোজার অর্থ হলো- আল্লাহর প্রভুত্বের স্বীকৃতি, আল্লাহর অভিভাবকত্বের স্বীকৃতি, আল্লাহর মহানুভবত্বের স্বীকৃতি, আল্লাহর সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি ও আল্লাহর অসংখ্য নিয়ামতের স্বীকৃতি সর্বোপরি আল্লাহর অস্তিত্বের স্বীকৃতি। কেউ যদি শোকর গোজার না করে, তাহলে বুঝতে হবে সে মূূূূূূূূলত আল্লাহকেই অস্বীকার করছে। সে তার মহান প্রভু সম্পর্কে মারাত্মক ধোঁকায় পড়ে আছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘হে মানুষ! কোনো জিনিস তোমাকে তোমার মহান রবের ব্যাপারে ধোঁকায় ফেলে রেখেছে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, তোমাকে সুঠাম ও সুসামঞ্জস্য করে গড়েছেন এবং যে আকৃতিতে চেয়েছেন তোমাকে গঠন করেছেন। কখনো না, বরং তোমরা শাস্তি ও পুরস্কার প্রদানের দিবসকে (আখিরাতকে) মিথ্যা প্রতিপন্ন করছ’ (সূরা ইনফিতার : ৬-৯)।
আসলে, আমাদের অস্তিত্ব নিজেই ঘোষণা করছে, আমরা নিজে নিজেই সৃষ্টি হয়ে যাইনি। আমাদের পিতা-মাতাও আমাদের সৃষ্টি করেননি বা আমাদের মধ্যে যেসব উপাদান আছে সেগুলো নিজে নিজে একত্র হয়ে যাওয়ার ফলেও ঘটনাক্রমে মানুষ হিসেবে তৈরি হয়ে যায়নি; বরং এক মহাজ্ঞানী ও মহাশক্তিধর আল্লাহ এই পূর্ণাঙ্গ মানবিক আকৃতি দান করেছেন। আমাদের সামনে অসংখ্য ধরনের প্রাণী রয়েছে, তাদের মোকাবেলায় সবচেয়ে সুন্দর শারীরিক কাঠামো এবং শ্রেষ্ঠ ও উন্নত শক্তি একেবারেই সুস্পষ্ট। সুতরাং বুদ্ধির দাবি তো এই ছিল, এসব কিছু দেখে কৃতজ্ঞতায় আমাদের মাথা নত হয়ে যাবে এবং মহান রবের মোকাবেলায় কখনো নাফরমানি করার দুঃসাহস করবে না। আমরা এও তো জানি, আমাদের প্রভু শুধু রহিম ও করিম করুণাময় ও অনুগ্রহশীলই নন, তিনি জাব্বার ও কাহহার- মহাপরাক্রমশালী এবং কঠোর শাস্তি দানকারীও বটে। এত কিছু জেনেও যখন কৃতজ্ঞতার মাথা নত হয়নি, তাহলে ধরে নিতে হবে যে, সে কুফরিতে লিপ্ত হয়েছে।
তিনি দয়া করে আমাদের মানুষ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিবেক নামক অমূল্য সম্পদ দান করেছেন, তারপর তিনি আমাদের সরল সঠিক পথে চলার জন্য পথ দেখিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আমি তাকে রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছি। এরপর হয় সে শোকর গোজার হবে নয়তো হবে কুফরের পথ অনুসরণকারী’ (সূরা আদ দাহর-৩)। আল্লাহ মানুষকে শুধু জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধি দিয়েই ছেড়ে দেননি; বরং এগুলো দেয়ার সাথে সাথে তাকে পথও দেখিয়েছেন যাতে তারা জানতে পারে শোকরিয়ার পথ কোনটি এবং কুফরির পথ কোনটি। এরপর যে পথই অবলম্বন করুক না কেন তার জন্য সে নিজেই দায়ী। এ বিষয়টিই সূরা বালাদে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে- ‘আমি তাকে দু’টি পথ (অর্থাৎ ভালো ও মন্দ) স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছি।’
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আর স্মরণ করো তোমাদের রব এই বলে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, যদি কতৃজ্ঞ থাকো তাহলে আমি তোমাদের আরো বেশি দেবো আর যদি নিয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞ হও তাহলে আমার শাস্তি বড়ই কঠিন’ (সূরা ইবরাহিম-৭)। অর্থাৎ আল্লাহর নিয়ামতসমূহের অধিকার ও মর্যাদা চিহ্নিত করে সেগুলোকে সঠিকভাবে ব্যবহার করে, তাঁর বিধানের মোকাবেলায় অহঙ্কারে মত্ত হতে ও বিদ্রোহ করতে উদ্বুদ্ধ না হয় এবং তার অনুগ্রহের অবদান স্বীকার করে নিয়ে অনুগত থাকে তাহলে আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহ আরো বাড়িয়ে দিবেন। এই অনুগ্রহ শুধু বৈষয়িক অনুগ্রহ নয়; বরং তার সৎবৃত্তিকে আরো উন্নত করে দেবেন। তাঁর জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের মুক্তির পথ উন্মুক্ত করে দেবেন। আর যারা বিদ্রোহ করে আল্লাহ তাদেরকেও তাঁর নিয়ামত দেবেন বটে কিন্তু আখিরাতে আল্লাহর শাস্তি বড়ই কঠিন। উপরিউক্ত আয়াতে আল্লাহ সেই সংবাদই দিয়েছেন। ‘আর যদি নিয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞ হও তাহলে আমার শাস্তি বড়ই কঠিন।’ আল্লাহ যখন কোনো জাতির প্রতি অনুগ্রহ করেন এর জবাবে সংশ্লিষ্ট জাতি বিশ^াসঘাতকতা ও বিদ্রোহ করে তখন এ ধরনের জাতির এমন মারাত্মক ও ভয়াবহ পরিণামের ইতিহাস আমরা বনি ইসরাইলদের থেকে দেখেছি।
লেখক:
শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
Leave a Reply