ইউক্রেন খুব শীঘ্রই রাশিয়ার বাহিনীর বিরুদ্ধে একটি পাল্টা আক্রমণ চালাবে বলে আশা করছেন অনেক পর্যবেক্ষক। ইউক্রেনের এমন হামলার উদ্দেশ্য হবে তাদের দখল হয়ে যাওয়া ভূমি উদ্ধার করা।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইউক্রেনের বাহিনীর মূল মনোযোগ নিবদ্ধ ছিল রুশ বাহিনীকে ঠেকিয়ে রাখা এবং শত্রুপক্ষের শক্তি-ক্ষয় করার দিকে।
কিন্তু ইউক্রেনের কর্মকর্তারা এবং তাদের মিত্র পশ্চিমা দেশগুলোও প্রকাশ্যে এবং আড়ালে এমন ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছে যে এবারের বসন্তকালে বড় একটি পাল্টা হামলা আসবে। ইউক্রেন যে এমন একটি হামলার জন্য নতুন সৈন্য এবং অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহের মাধ্যমে প্রস্তুতি নিচ্ছে, সেটাও জানা কথা।
প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, পাল্টা হামলা চালানোর জন্য তার দেশের আরো বেশি সময় দরকার। কারণ ইউক্রেনের সেনাবাহিনী এখনো অনেক প্রতিশ্রুত সামরিক সাজ-সরঞ্জামের জন্য অপেক্ষা করছে।
কিয়েভে নিজের সদর দফতর থেকে কথা বলার সময় প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি তার দেশের কমব্যাট ব্রিগেডগুলো এই লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন। এসব সেনাদলকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে নেটোভুক্ত দেশগুলো।
তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর এখনো আরো কিছু সমরাস্ত্র দরকার। বিশেষ করে সাঁজোয়া গাড়ি, যেগুলো ধাপে ধাপে পাঠানো হচ্ছে।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলছিলেন, ‘আমাদের কাছে এখনই যা আছে তা দিয়েই আমরা এগিয়ে যেতে পারি এবং আমি মনে করি আমরা সফল হতে পারি।’
‘কিন্তু আমাদের অনেক বেশি লোক হারাতে হবে। আমার মনে হয় সেটি গ্রহণযোগ্য হবে না। কাজেই আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। আমাদের এখনো আরেকটু সময় দরকার।’
ইউক্রেনের কর্তৃপক্ষ এই যুদ্ধে একটা বড় অগ্রগতির যে প্রত্যাশা করা হচ্ছে, সেটিকে কিছুটা কমিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। এ মাসের শুরুতে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা বলেন, দেশের নেতারা ‘বুঝতে পারছেন যে তাদের সফল হতে হবে,’ কিন্তু এই হামলাকে ১৫ মাস ধরে চলতে থাকা যুদ্ধের একটি সমাধান হিসেবে দেখা ঠিক হবে না।’
এই পরিকল্পনার বিস্তারিত এখনো গোপন রাখা হয়েছে। তবে ইউক্রেন শত্রুপক্ষকে বোকা বানানোর জন্য তাদের ভুল দিকে চালিত করতে পারে, এমনটা আশা করা যায়। যুদ্ধে অগ্রগতি অর্জনের জন্য ইউক্রেনের পরিকল্পনায় আসলে কী থাকতে পারে ?
পাল্টা-আক্রমণ কী?
রণকৌশলে পাল্টা-আক্রমণ বলতে সাধারণত বোঝানো হয় কোনো সশস্ত্র বাহিনী যখন তাদের আগের রক্ষণাত্মক অবস্থান থেকে সরে এসে বড় আকারে পাল্টা সামরিক হামলা বা অভিযান চালায়।
যেমন, গত বছরের সেপ্টেম্বরে ইউক্রেনের বাহিনী এক দ্রুত পাল্টা হামলা চালিয়ে উত্তর-পূর্বের খারকিভ অঞ্চলে মাত্র ছয় দিনে আট হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা পুনর্দখল করে। তবে এ ধরনের অভিযানকে অতি সরলীকরণের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছেন কর্তৃপক্ষ।
‘পাল্টা আক্রমণ তো আর একক কোনো ঘটনা নয় যে একটা বাঁশি বাজিয়ে এটি শুরু হবে এবং তারপর কোনো একটা নির্দিষ্ট সময়ে এটা শেষ হবে,’ বিবিসির নিউজনাইট অনুষ্ঠানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলছিলেন ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর উপদেষ্টা ইউরি সাক।
‘এই যুদ্ধে অনেক উত্থান-পতন আছে, এই যুদ্ধে বেশ তীব্র লড়াই চলছে এবং অনেক ধরনের বিষয় এখানে বিবেচনায় রাখতে হবে,’ বলছিলেন তিনি।
ইউক্রেনের পাল্টা-আক্রমণ কখন শুরু হবে?
সাক বলেন, ইউক্রেন যখন বুঝতে পারবে যে কম সামরিক ক্ষতির বিনিময়ে ‘যত বেশি সাফল্য অর্জন সম্ভব’ ততটা তারা পারবে, তখনই ইউক্রেন এই অভিযান চালাবে।
তিনি বলেন, ‘একটি দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষা নির্মাণ করতে রুশরা অনেক সময় পেয়েছে।’
দক্ষিণ রাশিয়া এবং রুশ-অধিকৃত ক্রাইমিয়ায় জ্বালানি মওজুদ রাখা হয় এমন দু’টি স্থাপনায় গত কিছু দিনের মধ্যে দুটি অগ্নিকাণ্ড হয়েছে। এর মধ্যে একটি ছিল ক্রাসনোডার অঞ্চলে একটি সেতুর কাছে, যেটি দিয়ে অধিকৃতি ক্রাইমিয়া পেনিনসুলার দিকে যেতে হয়।
এ সপ্তাহে রাশিয়ার সীমান্তবর্তী ব্রায়ানস্ক অঞ্চলে দু’টি আলাদা বিস্ফোরণ ঘটেছে, যাতে মালবাহী ট্রেন লাইনচ্যূত হয়। অন্যদিকে লেনিনগ্রাদ অঞ্চলে এক সন্দেহজনক বিস্ফোরণে বিদ্যুতের লাইন ধ্বংস হয়।
যদিও এসব হামলার কোনটিরই দায় ইউক্রেন স্বীকার করেনি। ইউক্রেনের সেনাবাহিনী বলেছে, রুশ লজিস্টিকসের ওপর এমন হামলা ইউক্রেনের দিক থেকে দীর্ঘ প্রত্যাশিত এক পাল্টা-আক্রমণের প্রস্তুতিরই অংশ।
রাশিয়া এ বছর তাদের বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজের অনুষ্ঠানের কলেবর অনেক কমিয়ে আনে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কারণে।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা ভালো করে জানি এসব হামলা, সন্ত্রাসবাদী কাজ-কর্ম, পরিকল্পনার পেছনে আছে কিয়েভের সরকার। তারা এমন কাজ অব্যাহত রাখার পরিকল্পনা করছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের বিশেষ সংস্থাগুলো তাদের সম্ভাব্য সবকিছু করার চেষ্টা করছে।’
ইউক্রেন কিভাবে পাল্টা-আক্রমণ চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে?
ইউক্রেনের সেনাবাহিনী ২০২২ সালের শেষভাগের পর এ পর্যন্ত রুশ-ইউক্রেন ফ্রন্টে বড় কোনো আক্রমণে যায়নি। বরং পুরো শীতকালটা জুড়ে তারা রুশ সৈন্যদের মনোবল ভেঙে দেয়া এবং তাদের রসদের মজুদে যাতে টান পড়ে সেই দিকেই বেশি মনোযোগ দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের অনুমান, গত ডিসেম্বর মাস হতে লড়াইয়ে এ পর্যন্ত বিশ হাজারের বেশি রুশ সেনা নিহত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের মুখপাত্র জন কার্বি সম্প্রতি উন্মুক্ত করা গোপন দলিলপত্র উদ্ধৃত করে জানিয়েছেন, আরো কমপক্ষে ৮০ হাজার রুশ সেনা আহত হয়েছে। বিবিসি অবশ্য স্বাধীন কোনো সূত্র হতে এসব তথ্য যাচাই করতে পারেনি।
এই একই সময়ে প্রাথমিক তথ্য থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে ইউক্রেন এ মাস পর্যন্ত ১২টি ব্রিগেড প্রস্তুত করেছে, যাতে আছে ৪০ হতে ৫০ হাজার ইউক্রেনীয় সৈন্য।
পশ্চিমা মিত্ররা যেসব সাঁজোয়া গাড়ি এবং আর্টিলারি দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার একটা বড় অংশও এখন ইউক্রেনের হাতে এসে পৌঁছেছে।
ইউক্রেনের কর্মকর্তারা বলেছিলেন, তাদের পাল্টা-আক্রমণ শুরু হতে পারে এপ্রিলের শেষে বা মে মাসের শুরুতে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরকে উদ্ধৃত করে এই একই সময়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল মার্কিন গণমাধ্যমে।
কিন্তু এমন বিশাল একটি অভিযান নির্ভর করে আবহাওয়া থেকে শুরু করে অনেক কিছুর ওপর। পূর্ব এবং দক্ষিণ ইউক্রেনে এপ্রিল মাসে অনেক বৃষ্টি হয়েছে। কাজেই কাদামাটির ওপর দিয়ে সাঁজোয়া গাড়ি দ্রুতগতিতে চালিয়ে নেয়া বেশ কঠিন হতো।
তবে মে মাসের শুরুতে আবহাওয়া শুষ্ক থাকায় ইউক্রেনের পাল্টা-আক্রমণ আসন্ন বলে আবার জল্পনা শুরু হয়েছে।
রুশ সামরিক ব্লগাররা এবং ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিন ধারণা করছেন, ইউক্রেনের এই হামলা শুরু হবে ১৫ মের আগে, যখন সাঁজোয়া গাড়ি চালানোর জন্য মাটি যথেষ্ট শক্ত হয়ে উঠবে।
ইউক্রেন কেন পাল্টা-আক্রমণ চালাবে?
ইউক্রেনের কর্তৃপক্ষ এবং পশ্চিমা মিত্ররা উভয়েই বলেছে, ইউক্রেনীয় বাহিনীর এমন একটি পাল্টা-আক্রমণ সফল হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইউক্রেনের যেসব অঞ্চল রাশিয়া দখল করে আছে, প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি সেগুলো দখলমুক্ত করতে খুবই উদগ্রীব।
তিনি আরো দেখাতে চান যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের সরকারগুলো ইউক্রেনের বাহিনীকে যে সাহায্য-সমর্থন দিয়েছে, তা বিফলে যায়নি।
ইউক্রেনের সৈন্যরা সাফল্য অর্জনের পথে অনেক বড় বাধার মুখে পড়বে বলেই মনে হয়। সৈন্য সংখ্যা বা সাঁজোয়া গাড়ির কথা ধরলে, রাশিয়ার তুলনায় ইউক্রেন খুব সুবিধাজনক অবস্থায় নেই। সামরিক বিমানের সংখ্যা বা এগুলোর মানের বিবেচনাতেও রাশিয়া ইউক্রেনের তুলনায় বহু ধাপ এগিয়ে।
বিমান যুদ্ধে রাশিয়ার এই সুবিধাকে টেক্কা দিতে হলে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর বিরাট সংখ্যায় মোবাইল এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, অর্থাৎ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় দ্রুত সরিয়ে নেয়া যায় এমন ধরনের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দরকার।
কিন্তু বিরাট এক যুদ্ধ ক্ষেত্রে লড়াই করার জন্য এ ধরনের যথেষ্ট মোবাইল এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম তাদের নেই।
অন্যদিকে রাশিয়ার সমস্যা ভিন্ন। রুশ সেনাবাহিনীর ইউনিটগুলোর মধ্যে সমন্বয় নেই, তাদের প্রশিক্ষণে দুর্বলতা আছে। অন্যদিকে তাদের সৈন্যদের মনোবল এবং মানসিক অবস্থা মোটেই ভালো নয়।
মারিনকা, ভুহলেডার, আভডিভকা এবং বাখমুতে যেরকম দীর্ঘসময় ধরে লড়াই চলছে, তাতে রুশ বাহিনী ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে তাদের রসদের মজুদ এবং অস্ত্র-শস্ত্রের সরবরাহে ঘাটতি পড়েছে।
কোথায় এই পাল্টা-আক্রমণ চালাবে ইউক্রেন?
ইউক্রেনীয় বাহিনী কোন দিক থেকে কোথায় পাল্টা-আক্রমণ চালাবে, তা দেশটির নেতারা গোপন রেখেছেন যাতে করে শত্রুকে চমকে দেয়া যায়।
সামরিক বিশ্লেষক এবং বিশেষজ্ঞরা বেশ কিছু অঞ্চলের কথা ইঙ্গিত করেছেন যেখানে ইউক্রেন এই হামলা চালাতে পারে।
এমন একটি এলাকা হচ্ছে ইউক্রেনের দক্ষিণে জাপোরিশা অঞ্চল।
ইউক্রেন এদিকে অগ্রসর হতে পারলে তার একটা সুবিধা আছে। ক্রাইমিয়া অঞ্চলটি যে স্থল-সেতুর মাধ্যমে রাশিয়া ডনবাসের সাথে সংযুক্ত, সেটি যদি ইউক্রেনীয় বাহিনী বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে, তাহলে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর রসদ সরবরাহ দু’দিক থেকে বিঘ্নিত হবে।
কিন্তু রুশ সেনাবাহিনী এই এলাকাটিকে দুর্ভেদ্য করে তুলেছে। সেখানে তাদের কয়েক লাইনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আছে। সেখানে তারা বিশাল বিশাল সব দুর্গের রক্ষার্থে চারদিকে পরিবেষ্টিত খাত খনন করেছে।
অন্যদিকে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় শহর বাখমুতের জন্যই এই যুদ্ধে সবচেয়ে দীর্ঘ এবং রক্তক্ষয়ী লড়াই চলছে।
প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বাখমুতকে ইউক্রেনিয়ানদের মনোবলের ‘দুর্গ’ বলে বর্ণনা করেছেন। যদি বাখমুতে ইউক্রেন জয়ী হতে পারে, সেটি কেবল তাদের মনোবলই উজ্জীবিত করবে না, এর পথ ধরে কাছাকাছি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর পপাসনা, হরলিভকা এবং আভডিভকাতেও রুশ প্রতিরক্ষায় ফাটল ধরতে পারে।
এমন পাল্টা ইউক্রেনীয় হামলার আরো কয়েকটি সম্ভাব্য জায়গা হতে পারে খেরসনের দক্ষিণ এবং পূর্বাঞ্চল, অথবা ভুহলেডার থেকে ভলনোভাখার দিকে। অথবা লুহানস্কের সভাটোভ এবং ক্রেমিনার মাঝে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ রুটটি বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার চেষ্টা করতে পারে।
সূত্র : বিবিসি
Leave a Reply