রাজধানী ঢাকার আজিমপুরের একটি বাসায় শুক্রবার সকালে ডাকাতির সময় যে শিশুকে অপরহণ করা হয়েছিল তাকে মধ্যরাতে উদ্ধার করে বাবা-মায়ের হাতে তুলে দিয়েছে র্যাব। সারাদেশে আলোড়ন তৈরি করা এ ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহে তারা এক নারীকে আটক করেছে র্যাব।
শনিবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব জানিয়েছে, শিশুটিকে মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নেয়ার আগে তার মায়ের হাত-পা বেঁধে মুখে কাপড় গুজে দেয়া হয়েছিল। এরপর মা ও শিশু উভয়ের মুখেই ‘স্প্রে’ করে দেয়া হয়েছিল অজ্ঞান করার জন্য।
‘এরপর নগদ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কারের পাশাপাশি শিশুটিকে নিয়ে গিয়েছিল অপহরণকারীরা,’ সংবাদ সম্মেলনে বলেন র্যাব মুখপাত্র মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস।
র্যাব কার্যালয় থেকে ফোনে শিশুটির বাবা মোহাম্মদ আবু জাফর বলেন, শিশুটি তার মায়ের কোলে ফিরে এসেছে।
‘আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই। র্যাব আমাদের বাচ্চাটাকে ফেরত এনেছে। এখন সে তার মায়ের কোলে। আমি পাশেই আছি,’ বলছিলেন তিনি।
উল্লেখ্য, শুক্রবার সকালে লালবাগ থানার আজিমপুরের মেডিক্যাল স্টাফ কোয়ার্টারের পাশের একটি বাসায় ডাকাতির সময় আট মাস বয়সী ওই শিশু সন্তানকে নিয়ে গিয়েছিল ডাকাতরা। এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে মুহূর্তের মধ্যেই ঘটনাটি নিয়ে সারাদেশে আলোড়ন তৈরি হয়।
বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমে ওই শিশুটির ছবি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং তাকে খুঁজে পেতে সহায়তার জন্য অসংখ্য মানুষ তার ছবি ও সংবাদ শেয়ার করায় এটি সব জায়গায় আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সামাজিক মাধ্যমের পোস্টগুলোতে এক ধরনের উদ্বেগও লক্ষ্য করা যায়।
সম্প্রতি বাংলাদেশের কয়েকটি জায়গায় শিশু নিখোঁজের পরপর কয়েকটি সংবাদ নিয়ে ব্যাপক প্রচার হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে।
বিশেষ করে সিলেটের কানাইঘাটে থেকে নিখোঁজ হওয়া শিশু মুনতাহা আক্তারকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করার জন্য ডোবায় পুঁতে রাখার ঘটনা ব্যাপক চাঞ্চল্য তৈরি করেছিল। ৩ নভেম্বর নিখোঁজের পর ১০ নভেম্বর তার লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল।
এরপর নতুন করে আট মাসের শিশু জাইফাকে দুর্বৃত্তরা বাসায় ডাকাতির পর নিয়ে গেছে। খবর প্রচার হলে তা সারাদেশেই ব্যাপক আলোচনা ও উদ্বেগের জন্ম দেয়।
অপহরণ ও উদ্ধার সম্পর্কে র্যাব যা বললো
সংবাদ সম্মেলনে র্যাব মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস জানিয়েছেন, শুক্রবার রাত দেড়টার দিকে মোহাম্মদপুর এলাকায় আদাবরের নবীনগর হাউজিংয়ের একটি বাসা থেকে শিশুকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন তারা।
‘বর্তমান সময়ে গত কয়েক দিনের আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আট মাস বয়সী শিশুকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করা। ভিকটিম শিশুর মাকে অপহরণকারী চক্রের একজন নারী দুই সপ্তাহ আগে থেকে অনুসরণ করেন ও সখ্যতা গড়ার চেষ্টা করেন,’ বলছিলেন তিনি।
আটক নারীকে জিজ্ঞাসাবাদ ও শিশুটির বাবা-মায়ের সাথে কথাবার্তায় পাওয়া তথ্য অনুযায়ী র্যাব জানায়, শিশুটির চাকরিজীবী মা মঙ্গলবার অফিসের যাওয়ার সময় অপহরণকারী চক্রের নারীর সাথে পরিচয় হয় ও শেয়ারে রিকশায় করে তার স্টাফ বাসে ওঠার জন্য আজিমপুর বাসস্ট্যান্ড যান। শিশুটির বাবা একটি মেডিক্যাল ইন্সটিটিউটের ল্যাব সহকারী।
শিশুটির মায়ের সাথে অপহরণকারী চক্রের ওই নারী পরে স্টাফ বাসেই যাতায়াত করেছেন। তিনি সরকারি পরিবহন পুলে সাময়িক চাকরি করেন ও আর্থিক সঙ্কটে আছেন বলে জানান।
‘এরপর উভয়ের মধ্যে মোবাইলে কথা-বার্তা হয় এবং এর মাধ্যমে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। এই সম্পর্কে ধারাবাহিকতায় অপহরণকারী চক্রের নারী শিশুর মাকে সাবলেট থাকার জন্য দুই হাজার টাকা অগ্রিম দেন এবং বৃহস্পতিবার বিকেলে সেই বাসায় আসেন,’ বলছিলেন র্যাবের মুখপাত্র।
তার মতে, বাসায় এ সময় ওই শিশু, তার মা ও তার নানি অবস্থান করছিল। কিন্তু ওই রাতে হুট করে তাদের একজন আত্মীয় চলে আসায় অপহরণকারী চক্র তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
‘তারপরেও সবাইকে ঘুমের ওষুধ ও চেতনানাশক খাইয়েছেন তিনি। সকালে শিশুটির নানি ও রাতে আসা আত্মীয় গ্রামে যাবার উদ্দেশে চলে যায়। শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে অপহরণকারী চক্রের নারী তিনজন ছেলেকে ওই বাসায় নিয়ে আসেন ও দরজা খুলে ঘরে ঢুকতে দেন। তাদের দু’জন ভেতরে প্রবেশ করেছিল।
ওই দু’জনই ঘর থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। ৬ থেকে ৭ ভরি স্বর্ণালঙ্কার এবং বেশ কিছু দামী ঘড়ি লুটের পর মায়ের কোল থেকে শিশুটিকে ছিনিয়ে নিয়ে মুক্তিপণ আদায়ে ব্যবহার করার জন্য। তারা দশ লাখ টাকাও দাবি করেছিল।
এ সময় শিশুর মায়ের মুখে কাপড় গুজে দেয়া হয়েছিল। তাছাড়া শিশু ও তার মায়ের মুখে স্প্রে করেছিলে অজ্ঞান করার জন্য। এরপর অপহরণকারীরা আদাবরের ওই বাসায় যায়।
‘কিন্তু পরে মিডিয়া ও সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারের কারণে তারা আর যোগাযোগ করেননি। এখন আরো তদন্ত হবে। দেখা হবে, পারিবারিক কেউ জড়িত আছে কি-না,’ বলছিলেন তিনি।
এর আগে মধ্যরাতে শিশুটিকে উদ্ধারের পর রাতেই র্যাবের একটি দল আজিমপুরে এসে শিশুটির বাবা ও মাকে র্যাব কার্যালয়ে নিয়ে যায় বলে বিবিসিকে জানিয়েছে শিশুটির এক চাচা।
র্যাব সূত্র বলছে, র্যাব কার্যালয়ে নেয়ার পর অপহরণকারীচক্রের আটক নারীকে জিজ্ঞাসাবাদ ও শিশুর মায়ের সাথে কথা বলে র্যাবের তদন্তকারীরা। এরপর সকালেই গণমাধ্যমে পাঠানো খুদে বার্তায় শিশুটিকে উদ্ধারের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানায় র্যাব।
এদিকে শুক্রবার সকালে শিশুটিকে অপহরণকারী চক্র নিয়ে যাওয়ার পর সেখানকার যে ভিডিও ফুটেজ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে এসেছিল তাতে দেখা যাচ্ছিল এক নারী ও দুই পুরুষ শিশুটিসহ মালামাল নিয়ে যাচ্ছে। এর ভিত্তিতেই পুলিশ র্যাবের একাধিক দল কাজ করতে শুরু করে। পরে রাতে গোয়েন্দারা অপহৃত শিশুর অবস্থান চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়।
সূত্র : বিবিসি
Leave a Reply