চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত এই তিন মাসে সৌদি আরব, ওমান, মালয়েশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের দেশ রোমানিয়াসহ শ্রমবান্ধব দেশগুলোতে সোয়া তিন লাখেরও বেশি শ্রমিক কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান শ্রমবাজার সৌদি আরবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের চেয়ে মার্চ মাসে কর্মী যাওয়ার হার কমে গেছে। অবশ্য এই সময়ে দ্বিতীয় সম্ভাবনাময় দেশ মালয়েশিয়াতে শ্রমিক যাওয়ার গতি অনেক বেড়েছে। একই সাথে নতুন শ্রমবাজার পূর্ব ইউরোপের দেশ রোমানিয়াতেও শ্রমিক যাচ্ছে বেশি। তবে এই দেশ থেকে শ্রমিক পালিয়ে যাওয়ার কারণে যেকোনো সময় শ্রমবাজারটি বন্ধের আশঙ্কা করছেন জনশক্তি ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্টরা।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, নানাবিধ সমস্যায় সৌদি আরবের শ্রমবাজারে শ্রমিক যাওয়ার হার তুলনামূলকভাবে কমছে। তবে সৌদি আরবগামী শ্রমিকরাই এখন মালয়েশিয়া ও রোমানিয়ামুখী হয়েছে। এর ফলে প্রতিনিয়ত মালয়েশিয়া ও রোমানিয়াসহ শ্রমবান্ধব কয়েকটি দেশে শ্রমিক যাচ্ছে বেশি।
বিএমইটির পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জানু-মার্চ) বিএমইটির বহির্গমন ছাড়পত্র নিয়ে বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছে ৩ লাখ ২৩ হাজার শ্রমিক, যা গড়ে প্রতি মাসে এক লাখেরও বেশি। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ১ লাখ ৪ হাজার ৫১৩, ফেব্রুয়ারি মাসে এক লাখ ৯ হাজার ৫৯ এবং মার্চে এক লাখ ৯ হাজার ৪৩৮ জন। এই তিন মাসে সৌদি আরবে সর্বোচ্চ গেছে ১ লাখ ২২ হাজার ৫৭২ জন। এরপরের অবস্থানে আছে মালয়েশিয়া। দেশটিতে এই তিন মাসে পাড়ি জমিয়েছে ৮২ হাজার ৮৯৩ জন। এর পরের অবস্থানে আছে ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, কুয়েত, কাতার, ইতালি, দক্ষিণ কোরিয়া ও জর্দান। সৌদি আরবগামী শ্রমিকদের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে গড়ে ৪২ হাজারের বেশি শ্রমিক গেলেও মার্চে শ্রমিক যাওয়ার গতি কমেছে। এ মাসে গেছে ৩৭ হাজার শ্রমিক। অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাস থেকে মার্চে ৫ হাজার শ্রমিক কম গেছে। একই সাথে মহিলা শ্রমিক যাওয়ার হারও কমেছে সৌদি আরবে। গত বছরের (২০২২) জুলাই মাসের আগে মালয়েশিয়াতে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক যাওয়ার কোনো পরিসংখ্যানই বিএমইটিতে ছিল না। কিন্তু অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে কূটনৈতিক তৎপরতায় দেশটিতে গড়ে প্রতি মাসে এখন ২৮ হাজার করে শ্রমিক যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিন ফ্লাইট থাকছে মালয়েশিয়ায়। তবে সম্প্রতি এক ঘোষণায় মালয়েশিয়া সরকার নতুন চাহিদাপত্র দেয়া বন্ধ রেখেছে।
এ প্রসঙ্গে একাধিক জনশক্তি রফতানিকারক গতকাল শনিবার নয়া দিগন্তকে নাম না প্রকাশ করার শর্তে জানান, সৌদি আরবে শ্রমিক যাওয়া কমার অন্যতম কারণ হচ্ছে দেশটিতে নিয়োগকর্তারা ঠিকমতো কর্মীদের আকামা তৈরি করে দেয় না। বেতনও ঠিক মতো দিতে চায় না। এ ছাড়া নারী শ্রমিকদের যাওয়ার ক্ষেত্রে রয়েছে নানাধরনের সমস্যা। একজন এজেন্সি মালিক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রী ও সচিব বিদেশগামীদের ক্ষেত্রে কঠোর হলেও বিএমইটিতে কর্মকাণ্ডে চলছে বিপরীত চিত্র। মানে অনেক উল্টাপাল্টা কাজ হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, নারী শ্রমিকদের সৌদি আরব যাওয়ার ক্ষেত্রে দুই মাসের ট্রেনিং সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখেন ট্রেনিং সেন্টারগুলোর সাথে যোগসাজশ করে আবার কখনো ট্রেনিং সার্টিফিকেট ছাড়াই (ফলস) বহির্গমন ছাড়পত্র দেয়া হচ্ছে। এর ফলে এসব নারী কর্মী বিদেশে গিয়ে পড়ছেন নানা ধরনের সমস্যায়। এই সুযোগে ট্রেনিং সার্টিফিকেট না দিয়ে বহির্গমন ছাড়পত্র করানো একটি চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এসব অভিযোগ গোপনে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সরেজমিন তদন্ত করলেই জানতে পারবে নেপথ্যে কী ঘটছে? শুধু সৌদি আরব নয় একক ভিসায় ইতালি, পোল্যান্ড, রোমানিয়াগামীদের বহির্গমন ছাড়পত্র দেয়ার নামেও সিন্ডিকেট সদস্যরা নানা ধরনের অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আরো তৎপর হতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে গত সপ্তাহে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক মো: শহিদুল আলমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি টেলিফোন ধরেননি। অবশ্য সৌদি আরব, রোমানিয়া ইতালি, পর্তুগালসহ অন্য দেশে শ্রমিক প্রেরণে সিন্ডিকেট তৈরি হলেও মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে শ্রমিক প্রেরণে কোনো ধরনের সমস্যা নেই বলে জানা গেছে।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ব্যুরো মালয়েশিয়া শাখার একজন কর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে বলেন, সৌদি আরবসহ কয়েকটি পুরনো শ্রমবাজারে শ্রমিক যাওয়ার হার কমলেও মালয়েশিয়ায় শ্রমিক যাচ্ছে তুলনামূলক অনেক বেশি। কোনো কোনো দিন এক থেকে দেড় হাজার শ্রমিকেরও বহির্গমন ছাড়পত্র হচ্ছে। আমরাও চেষ্টা করছি এসব শ্রমিক যেন যথাসময়ে দেশ ত্যাগ করতে পারে। কখনো কখনো অফিস সময়ের পরও তাদের বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে আমরা সার্ভিস দিয়ে থাকি। কারণ আমাদের একটা ভুলের কারণেও একজন শ্রমিকের ফ্লাইট মিস হয়ে যেতে পারে। এক প্রশ্নের উত্তরে ওই কর্মকর্তা অবশ্য স্বীকার করেন, বিএমইটিতে অনিয়ম দুর্নীতি হচ্ছে। তবে এর মাত্রা কিভাবে কমানো যায় আমরা সে চেষ্টাও করছি। তবে সবাই কিন্তু অনিয়ম দুর্নীতি করছে না। অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, মালয়েশিয়ায় কর্মী যাচ্ছে একটি পদ্ধতির মাধ্যমে। কিন্তু সৌদি আরব, দুবাইসহ অন্যান্য দেশে লোক যাচ্ছে আগের নিয়মে। এর আগে লিবিয়ার ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত ফকিরাপুলের একজন ব্যবসায়ী নয়া দিগন্তকে বলেন, লিবিয়াতে অনেক শ্রমিকের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু সিস্টেমের জটিলতায় দেশটিতে কর্মী যাওয়া এখনো শুরু হচ্ছে না। তবে আশা করছি চলতি মাসে লিবিয়া থেকে একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল দূতাবাসে সরেজমিন পরিদর্শন করে যাওয়ার পরই শ্রমবাজারটি পুরোদমে খুলে যেতে পারে।
এক প্রশ্নের উত্তরে ঈদের পর মন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল লিবিয়া সফরের কথা রয়েছে বলে জানান তিনি।
Leave a Reply