প্রচণ্ড শীতে কাঁপছে দেশ। শীতকাল কারো কারো জন্য আনন্দের বিষয়। শীত মানেই কুয়াশা-মোড়ানো ভোরে চুলার পাশে বসে পিঠা খাওয়া। ঝরাপাতা জড়ো করে জ্বালিয়ে আগুন তাপানো। গল্পের আসরে বসে ধূমায়িত চা-কফির উষ্ণ স্বাদ। দীর্ঘ রাতে লেপ-কম্বলের ওম লাভের আনন্দ। কিন্তু যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয় তাদের জন্য শীত মানে ভয়াবহ দুঃসংবাদ। শীতের প্রকোপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এক টুকরো শীতের কাপড় তাদের জন্য যেন শত আরাধনার ধন। দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের অনেক মানুষের প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্রও নেই শীতের প্রকোপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য।
আমাদের আশপাশেও এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়। সড়কের পাশে, বাস ও রেলস্টেশনে, বাজারঘাটে রাতের বেলা এমন অনেক অসহায় মানুষকে পড়ে থাকতে দেখা যায়। আমরা যখন লেপ-কম্বল গায়ে জড়িয়ে দীর্ঘ রাত সুখনিদ্রায় বিভোর তখন তাদের রাত কাটে নির্ঘুম অবস্থায় শীতের প্রকোপে জবুথবু হয়ে। যার পেটে ভাত নেই তার গায়ে গরম কাপড় জুটবে কোত্থেকে! আমরা কি পারি না তাদের সাহায্যে একটু এগিয়ে আসতে?
সমাজের অসহায় ও শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো আমাদের সবারই নৈতিক দায়িত্ব। অসহায়দের সাহায্যে এগিয়ে আসার মাধ্যমেই রচিত হবে মানবিক সেতুবন্ধ। আমাদের সামান্য সহযোগিতা তাদের জীবনে এনে দিতে পারে এক টুকরো সুখ। কনকনে শীতে ঠক ঠক করে কাঁপা মানুষের গায়ে শীতবস্ত্র জড়িয়ে তার মুখে হাসি ফোটানোর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে। এর মাধ্যমে প্রকাশ পায় মানুষের প্রতি আমাদের মমত্ব ও ভালোবাসা। আমরা চাইলেই এসব দুঃখী মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারি। এর জন্য কি অঢেল বিত্তবৈভবের মালিক হওয়ার প্রয়োজন?
মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকেরাও করতে পারেন অনেক কিছু। এ অসহায়দের প্রতি তাদেরও রয়েছে কিছু নৈতিক দায়িত্ব। আমাদের উপার্জিত অর্থের সামান্য পরিমাণও যদি এ অসহায়দের জন্য আমরা বরাদ্দ করি তাহলে বিন্দু বিন্দু সে দান শীতার্তদের কষ্ট লাঘবে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারে।
বড় অঙ্কের অর্থ দান করা জরুরি নয়। আন্তরিকতা ও ভালোবাসার সাথে অল্প দানও অনেক মূল্যবান। তা ছাড়া আমাদের অতিরিক্ত সোয়েটার, জ্যাকেট, কম্বল ইত্যাদি শীতবস্ত্র দান করার মাধ্যমেও আমরা তাদের পাশে দাঁড়াতে পারি।
ইদানীং অসহায় ও শীতার্ত মানুষের জন্য বিভিন্ন জায়গায় ‘মানবতার দেয়াল’ নামে একটি উদ্যোগ সবার নজর কেড়েছে। এসব দেয়ালে মানুষের প্রয়োজনীয় কাপড় ও শীতবস্ত্র থাকে। যাদের অতিরিক্ত কাপড় আছে তারা সে দেয়ালে তা রেখে যায়। সেখান থেকে যে কেউ তার প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে যেতে পারে। এটি ইতিবাচক একটি উদ্যোগ। সামাজিক উদ্যোগে এ ব্যবস্থাটি আরো সুন্দর করা যেতে পারে। রাসূলুল্লাহ সা: আমাদের এ বিষয়ে উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তির অতিরিক্ত বাহন-জন্তু বা বাহনের খালি জায়গা আছে সে যেন বাহনহীন ব্যক্তিকে তা দিয়ে সাহায্য করে। কোনো ব্যক্তির যদি অতিরিক্ত পাথেয় থাকে তাহলে সে যেন পাথেয়হীন ব্যক্তিকে তা দিয়ে সাহায্য করে। বর্ণনাকারী বলেন, নবীজী এভাবে আরো অনেক ধরনের সম্পদের কথা বললেন। তাতে আমাদের মনে হতে লাগল যে, প্রয়োজন অতিরিক্ত সম্পদে আমাদের কোনো অধিকার নেই।’ (মুসলিম-১৭২৮)
কিছু মানুষের একটি ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগও ভালো লাগে। শীতবস্ত্র বিতরণের ক্ষেত্রে দিনের বেলায় বিতরণ করলে তুলনামূলক সচ্ছল মানুষও শীতবস্ত্র নিয়ে যায়। এতে প্রকৃত অসহায়রা বঞ্চিত হয়ে যায়। তাই তারা রাতে ১১টা-১২টার দিকে বিভিন্ন স্টেশনে অসহায় মানুষের থাকার জায়গায় ঘুরে ঘুরে শীতে কষ্ট করা মানুষের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ করেন। যেন প্রকৃত হকদাররাই এ দানে উপকৃত হন। তাদেরকে আল্লাহ উত্তম প্রতিদান দিন। এ জাতীয় উদ্যোগ ব্যক্তিগতভাবেও গ্রহণ করা যেতে পারে।
কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান থেকেও এ ধরনের মহতী উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে। সাধ্য ও সামর্থ্য অনুসারে আমরা তাদের সাথেও শরিক হতে পারি।
অসহায়ের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে এ বিষয়টিও বিবেচ্য যে, উপযুক্ত পাত্রের হাত পর্যন্ত তা পৌঁছাচ্ছে কি না। তাই স্বাভাবিকভাবে এদিক-ওদিক দেয়ার চেয়ে খুঁজে খুঁজে যথাস্থানে অনুদান পৌঁছে দেয়ার বিষয়টিও খেয়াল করার মতো। নবী করিম সা: বলেন, ‘প্রকৃত অভাবী সে নয়, যে এক-দুই লোকমার জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ফেরে; বরং প্রকৃত অভাবী তো সেই, যার সামর্থ্য নেই অথচ (সে মানুষের কাছে মুখ ফুটে চাইতে) লজ্জাবোধ করে। অথবা (তিনি বলেছেন) মানুষের কাছে গায়ে পড়ে চায় না।’ (সহিহ বুখারি-১৪৭৬, সহিহ মুসলিম-১০৩৯)
সমাজের সুবিধাবঞ্চিত ও দুস্থদের পাশে দাঁড়ানো শুধু সামজিক দায়িত্বই নয়; এটি মুসলিমের ধর্মীয় দায়িত্বও বটে। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে বনি আদম! আমি পিপাসার্ত ছিলাম; কিন্তু তুমি আমাকে পানি পান করাওনি। বান্দা তখন বলবে, হে আল্লাহ! আপনি উভয় জাহানের প্রতিপালক। আপনাকে কিভাবে পানি পান করাব? আল্লাহ তায়ালা বলবেন, আমার অমুক বান্দা পিপাসার্ত হয়েছিল; কিন্তু তুমি তাকে পানি পান করাওনি। যদি তাকে পানি পান করাতে তাহলে সেখানে আমাকে পেতে (আজ তার প্রতিদান পেতে)। হে বনি আদম! আমি পীড়িত ছিলাম; কিন্তু তুমি আমার সেবা করোনি। তখন বান্দা বলবে, আপনি উভয় জাহানের প্রতিপালক কিভাবে আমি আপনার সেবা করব? তখন আল্লাহ তায়ালা বলবেন, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল; কিন্তু তুমি তার সেবা করোনি। যদি তুমি তার সেবা করতে তাহলে আমাকে তার কাছে পেতে…।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান-২৬৯)
আল্লাহ তায়ালা একটি কুকুরকে পানি পান করানোর কারণে বনি ইসরাইলের একজন ব্যভিচারিণী নারীকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়েছেন। তাহলে ভেবে দেখুন, যে ব্যক্তি একজন মানুষকে খাওয়াবে, পানি পান করাবে, বিপদাপদে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসবে, তার সাথে আল্লাহ তায়ালা কেমন আচরণ করবেন!
তীব্র শীতে অসহায় দুস্থ ছিন্নমূল মানুষ ভীষণ কষ্টে সময় পার করছে। অনেকেরই শীতবস্ত্র কেনার সামর্থ্য নেই। রেলস্টেশনে, বাসটার্মিনালে কিংবা অজপাড়াগাঁয়ে অনেকেই ঠাণ্ডায় ভীষণ কষ্ট করছে। তাই আসুন, অসহায়দের সাহায্যে আমরা এগিয়ে আসি। সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিই। শীতার্ত মানুষ উষ্ণ হয়ে উঠুক আমাদের ভালোবাসায়।
লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া গাফুরিয়া মাখযানুল উলুম, টঙ্গী, গাজীপুর
Leave a Reply