খেলা শেষ হওয়ার বাঁশি বাজতে আর কিছুক্ষণ বাকি। তখন আল বায়েত স্টেডিয়ামের টিভি পর্দায় ভেসে উঠল এক মরক্কোর মহিলা দর্শকের কান্নার ছবি। দু’গাল বেয়ে পড়ছিল তার চোখের পানি। এই মধ্য বয়সী মরোক্কান মহিলার এই দৃশ্য একটি প্রতীক। অশ্রু ভেজা নয়ন শুধু তার একার নয়, পুরো আরব বিশ্বের। মুসলিম দুনিয়ার এবং সারা আফ্রিকার।
কাতার বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল পর্যন্ত এই উত্তর পশ্চিম আফ্রিকান দেশ মরক্কোই ছিল তাদের আশা ভরসার কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু গতকাল রাতে তারা আর থামাতে পারেনি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকে। দুই অর্ধের দুই গোলে ০-২ এ হেরে সেমিতে বিদায় আশরাফ হাকিমি, হাকিম জিয়াচদের। ফলে তাদের এখন লড়তে হবে তৃতীয় স্থানের জন্য। আর ফ্রান্স টানা দ্বিতীয় বারের মতো ফাইনালে।
পরশু বাংলাদেশ সময় রাত ৯টায় খালিফা ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়ামে মরক্কোর প্রতিপক্ষ গত রাশিয়া বিশ্বকাপের রানার্সআপ ক্রোয়েশিয়া। তবে হারলেও ম্যাচ শেষে পুরো গ্যালারি ভর্তি দর্শকের হাততালি আর অভিনন্দনে সিক্ত হয়েছেন লাল জার্সিধারীরা। খেলা শেষেও তাদের সমর্থকরা নেচে গেয়ে আনন্দ করেছে স্টেডিয়ামের বাইরে।
ফ্রান্সের সাথে মরক্কোর পুরনো শত্রুতা। সেই প্রতিশোধও নেয়া হয়নি। যেমনটা সেনেগাল ও তিউনিসিয়া নিয়েছিল ফরাসিদের বিপক্ষে। সাবেক উপনিবেশ এবং হাজার হাজার মুসলমান হত্যা করেছিল ফরাসিরা আফ্রিকার এই দেশগুলো দখলে রাখার সময়। সেনেগাল ২০০২ সালের জাপান -দক্ষিন কোরিয়া বিশ্বকাপে এবং তিউনিশিয়া এই কাতারের ফ্রান্সকে ১-০ তে হারিয়েছিল।
মরক্কোর এই ব্যর্থতার জন্য প্রথম মুসলিম দেশ হিসেবে, আরব এবং আফ্রিকান দেশ হিসেবে বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলাও হলো না তাদের। যদিও প্রথম মুসলিম দেশ হিসেবে ২০০২ সালের বিশ্বকাপের সেমিতে খেলেছিল তুরস্ক। এখন মরক্কোর শেষ সুযোগ তুরস্কের মতো তৃতীয় হওয়া। যা তাদের আরেকটি অর্জন হিসেবে যোগ হবে।
জাপান-কোরিয়া বিশ্বকাপে তুরস্ক তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে স্বাগতিক দক্ষিণ কোরিয়াকে ৩-১ গোলে হারিয়েছিল। কাতার বিশ্বকাপের এই দ্বিতীয় সেমিফাইনালে মরক্কো স্রেফ গোলটিই করতে পারেনি। বল পজিশন তাদেরই ছিল বেশি।
তাদের এমবাপ্পে, জিরুড এবং গ্রিজম্যানের মতো সুপার কোয়ালিটির ফুটবলার নেই। এই তিনজনের কেউই মরক্কোর বিপক্ষে গোল করতে পারেনি। ১৭ মিনিটে জিরুডের শট পোস্টে লাগায় এই বিশ্বকাপে পঞ্চম গোল পাওয়া হয়নি তার। এমবাপ্পে নিজের নামের পাশে ষষ্ঠ গোল জমা করতে না পারলেও ৭৯ মিনিটে দলের জয় নিশ্চিত করা দ্বিতীয় গোলের মূল কারিগর তিনি।
বক্সের মধ্যে তিন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে তিনি যে দারুণ পাস দেন তাতে আনুষ্ঠানিকতাই সেরেছেন রান্ডাল কুলো মুয়ানে। ফ্রাঙ্কফুটে খেলা এই গোল করার সামান্য আগেই বদলি হিসেবে নামেন।
৫ মিনিটে ডিফেন্ডারের ভুলে কাতার বিশ্বকাপের সেরা চমক মরক্কোর পিছিয়ে পড়া। গ্রিজম্যানের পাস থেকে কিলিয়ান এমবাপ্পের শট ডিফেন্ডারের গায়ে লেগে বল গোলপোস্টের সামনের ডান পাশে যায়। সেই বলে সেখানে থেকে বাম পায়ের ভলিতে গোল করেন এসি মিলানে খেলা ডিফেন্ডার থিও হার্নান্দেজ।
এরপর ম্যাচে ফেরার দারুণ সুযোগ মরক্কোর পেয়েছিল ১০ মিনিটে। বক্সের বাইরে থেকে মিডফিল্ডার আজ্জেদিন উনাহির বাঁকানো শট ঠেকিয়ে দেন ফ্রান্সের গোলরক্ষক হুগো লরিচ। বামদিকে পুরো শরীর ফেলে ওই বল কর্নার করেন টটেনহ্যামের এই কিপার। ৩৬ মিনিটে এমবাপ্পের শট গোলরক্ষক ইয়াসিন বোনো ঠেকানোর পর ফিরতি বলে জিরুডের শট পোস্টে বার দিয়ে বাইরে যায়।
৪৪ মিনিটে মরক্কো ফের ম্যাচে ফেরার সুযোগ হারায় কপাল দোষে। কর্নার থেকে আসা বলে জাওয়াদ আল ইয়াকিম ব্যাকভলি নেন। ওই বল পোস্টে লেগে ফেরত এলে হতাশা নেমে আসে ৬৮ হাজার ২৯৪ জন দর্শকের মাঝে।
এরপর ৭৯ মিনিটে ফ্রান্সের দ্বিতীয় গোলে ম্যাচের সব আকর্ষণই শেষ। এরপরও ইনজুরি টাইমে মরক্কোর গোল প্রচেস্টা গোল লাইন থেকে বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের ডিফেন্ডার ক্লিয়ার করে। ক্লিন শিট জয়ে ফাইনালে আর্জেন্টিনার মুখোমুখির অপেক্ষায় দিদিয়ের দেশ্যামসের দলের।
Leave a Reply