1. tasermahmud@gmail.com : admi2017 :
  2. akazadjm@gmail.com : Taser Khan : Taser Khan
শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৯ পূর্বাহ্ন

রূপকল্প যেন কল্পকথা না হয়!

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ৩ মার্চ, ২০২০

মোহাম্মদ আবু নোমান:

মাত্র আড়াই কিলোমিটার সড়ক বানাতে ব্যয় যেখানে ৭৪৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা; সেই প্রকল্প বাস্তবায়নে জনপ্রতি ১৫ লাখ টাকা খরচ করে ১৩ কর্মকর্তাকে বিদেশে কথিত ‘প্রশিক্ষণ’ নিতে যাওয়ার বিষয়টি বুঝতে বড় বিদ্বান হতে হয় না। প্রকল্পের একটি এলইডি বাতির ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবের (ডিপিপি) তথ্যানুযায়ী, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) ‘নর্থ-সাউথ সড়ক নির্মাণ’ প্রকল্পের অধীন চট্টগ্রাম মহানগরীর জাকির হোসেন সড়কের ওয়্যারলেস মোড় থেকে নির্মাণাধীন বায়েজিদ বোস্তামী-ফৌজদারহাট পর্যন্ত নতুন সড়ক নির্মাণ করা হবে। যদিও একই সংস্থার আরেকটি প্রকল্পে সড়কবাতি কেনা হয়েছিল সাড়ে ১১ হাজার টাকা করে। বলা হচ্ছে, দেশ ‘উন্নয়নের মহাসড়কে’। বলতে হয়, ‘উন্নয়ন’ ও ‘দুর্নীতি’ সমানতালেই এগোচ্ছে! যেকোনোভাবেই হোক, তা বাংলাদেশেই সম্ভব! এ কারণে বালিশকাণ্ড, বাতিকাণ্ড, পর্দাকাণ্ড ইত্যাকার লঙ্কাকাণ্ড একের পর এক ঘটছে। উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাবে বাংলাদেশ। রূপকল্প ২০২১-২০৪১ বাস্তবায়নে যে ধরনের মানুষ দরকার, বর্তমান প্রশাসনে তেমন মানুষ আছে কী?

দেশে বায়ুর মান আরো খারাপ হয়েছে। অথচ গত ১০ বছরে পরিবেশ অধিদফতর দেশে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে ২২১ কোটি টাকা খরচ করেছে। বিশ্বব্যাংকের ঋণের অর্থে ‘নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ’ নামে প্রকল্পের (কেইস) মাধ্যমে এই অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। তবে অর্ধেকের বেশি অর্থাৎ ১২৩ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে প্রশিক্ষণের নামে কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর, পরামর্শক ফি, গাড়ি কেনা ও ভবন নির্মাণে। ২০০৯ সাল থেকে শুরু হয়ে গত জুনে প্রকল্পটি শেষ হয়েছে। এ অবস্থায় প্রকল্পের বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। প্রকল্পের অধীন ১০ বছরে ২৯৬ কর্মকর্তা বিদেশে প্রশিক্ষণে গেছেন। এক কর্মকর্তা ১০ বার বিদেশে গেছেন।

রাষ্ট্রের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যারা বাস্তবায়ন করছেন, তারা নিজেরাই কতটুকু জানেন, বোঝেন? যোগ্যতা, দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহির কোনো বালাই আছে কি? যেকোনো প্রকল্পের শুরুতে অডিট বিভাগের রুটিন অডিটে এসব ধরা পড়ে না? না, চোরে চোরে মাসতুতো ভাই বনে যান? যদিও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রকল্পে সর্বশেষ অনুমোদনে পরিকল্পনা কমিশনে গেলে প্রশিক্ষণের নামে কর্মকর্তাদের অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফর ও সড়কবাতির অতিরিক্ত দাম নিয়ে আপত্তি ওঠে। ইতঃপূর্বে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজে বালিশ-পর্দাসহ বিভিন্ন কেনাকাটায় মেগা দুর্নীতি হয়েছে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। এ ধরনের ডিপিপি যারা প্রস্তুত করেছেন, বলা যায় লাভের গুড়ের বড় ভাগ তারাই ভোগ করার বাসনা করেছেন। উন্নয়নের নামে দুর্নীতির আশ্রয়-প্রশ্রয়কারী কিছু কর্মকর্তা বরাবরই কাগজ-কলমে কোটি কোটি টাকা ব্যয় দেখিয়ে প্রকল্পগুলো থেকে অর্থ লুটপাটের নানা ফন্দি এঁটে থাকেন, সিডিএ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

এখন বাংলাদেশে উন্নয়নের বয়ান অহরহ প্রচারিত হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, উন্নয়নে ব্যয় এবং এর থেকে প্রাপ্ত সুফল কতটুকু সর্বসাধারণ ভোগ করতে পারছে- তার যৌক্তিক দিক পর্যালোচনা করা জরুরি। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের সেরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দেশ, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে, মাথাপিছু আয় ১ হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেছে, উন্নয়নের নানা সূচকে বাংলাদেশ বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় ভালো করছে ইত্যাদি কথা সরকারি তরফ থেকে জোরগলায় প্রচার করা হয়।

বাংলাদেশে উন্নয়নের পথপরিক্রমায় অনর্থক অপচয় ও অপব্যয় নতুন কিছু নয়। উন্নয়ন প্রকল্পসংক্রান্ত অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের নামে আমলাদের বিদেশ সফর, বারবার সড়কের আইল্যান্ড ও ফুটপাথ ভাঙা এবং তা পুনর্নির্মাণ করা, হাসপাতালগুলোর জন্য চড়া দামে যন্ত্রপাতি ক্রয় এবং তা ব্যবহার করতে না পারা। প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা খরচ করে রাস্তা মেরামত, বাঁধ, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ। কয়েক মাস না যেতেই সেগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়া। বাঁধগুলো আগাম বর্ষার এক ধাক্কায় উবে যাওয়া। এসব অপচয় ও অপব্যয় এড়ানো গেলে দেশ আরো অনেক বেশি উন্নয়ন অর্জন করতে পারত। কিন্তু সর্বগ্রাসী দুর্নীতি সব উন্নয়ন প্রচেষ্টা ধ্বংস করে দিচ্ছে।

দুর্নীতি কমানোর কথা ও খবর শুনলে কর্মকর্তাদের মেজাজ গরম হয়ে যায়! তাদের মনোভাব অনেকটা এ রকম, ‘কেনাকাটায় টাকা মারতে না দিলে কাজই করতে দেবো না।’ সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে : ‘(দুর্নীতির) ওপর গণমাধ্যমে বারবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে আলোচনা-সমালোচনার কারণে ক্রয়প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে একধরনের ভীতির সঞ্চার করেছে। অনেকে এ ধরনের পদে থাকতে চাইছেন না। আবার অনেকে ক্রয়প্রক্রিয়া থেকে দূরে থাকছেন কিংবা ক্রয়প্রক্রিয়া বিলম্বিত করছেন। এতে করে স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন বিঘিœত ও সেবাকার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কাও থেকে যায়।’ সরকারকারি কর্মচারীদের ভাবসাব এমন- বালিস কেনা হোক, পর্দা কেনা হোক, সোফা কেনা হোক, গ্লাভস কেনা হোক, বাতি কেনা হোক কোটি কোটি টাকা চুরি করব দুদক কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবে না, সংবাদপত্রও কোনো খবর প্রকাশ করবে না!

প্রবৃদ্ধি বাড়ার ওপর জোর দিচ্ছে সরকার। কিন্তু দূরদর্শী নেতৃত্ব ও দক্ষ প্রশাসন ছাড়া আর্থসামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। কোনো দেশ দুর্নীতি, অশান্তি লালন করে টেকসই উন্নয়ন আশা করতে পারে না। এটা সত্য, বৈশ্বিক অনেক সূচকেই বাংলাদেশ এগিয়েছে। তবে পরিবেশ দূষণ, যানজট, দুর্নীতি সমস্যার সমাধানে সরকার কাজ করলেও আমরা বেশ পিছিয়েই আছি।

দেশে যে উন্নয়ন হচ্ছে, তার ভিত্তি বা শেকড় যদি দৃঢ় না হয়, তবে একটা সময় ধসে পড়তে পারে। এ শঙ্কার কথা আবারো ব্যক্ত করেছে সিপিডি। সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক প্রতিবেদনে বলেছে, জাতিসঙ্ঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে সঠিক পথে নেই বাংলাদেশ। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিচার-বিশ্লেষণ করার মতো তথ্য-উপাত্ত পর্যন্ত নেই। ‘চার বছরে বাংলাদেশের এসডিজি বাস্তবায়ন মূল্যায়ন : বেসরকারি খাতের ভূমিকা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে সিপিডি বলেছে, বৈষম্য দূরীকরণ, শান্তি ও ন্যায়বিচার, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা, কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার মতো বিষয়গুলোতে বাংলাদেশের এখনো কার্যকর অগ্রগতি হয়নি।

আমাদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের একটি প্রধান ঝোঁক হলো কেনাকাটায় অতি উৎসাহ। এতে কমিশন পাওয়া যায় এবং প্রকৃত দামের চেয়ে অতিরিক্ত দাম জায়েজ করে লুটপাটও করা যায়। এগুলো দেখভাল করতে ন্যায়নিষ্ঠ সৎব্যক্তিদের নিয়ে একটি ‘অর্থব্যয় কমিশন’ গঠন করা জরুরি। বর্তমান সরকার দুর্নীতিতে ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ গ্রহণ করেছে। এটি শুধু কাগজ-কলমে থাকলেই হবে না। দুর্নীতির মাত্রা অতীতের সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এর কারণ, যারা দুর্নীতি করেন আর যারা দুর্নীতি ধরেন, তাদের মধ্যে বহু বছর ধরে একটা আঁতাত ও অনৈতিকতার বিষবৃক্ষ শেকড় গেড়েছে। এর মধ্যে সেবা খাতে দুর্নীতির মাত্রা সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে।

আমাদের আশা, রূপকল্প ২০২১-২০৪১ সফল হোক। বাংলাদেশের নাম উন্নত দেশের তালিকায় স্থান পাক। এ যেমন অশেষ খুশির কথা, তেমনি তার জন্য এখন থেকে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন। না হলে উন্নত দেশ হওয়ার ‘রূপকল্প’ রূপকথা বা কল্পকথা হয়ে থাকবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019-2023 usbangladesh24.com