বাণিজ্যিক আমদানির অনুমতি দেওয়ার পরও দেশে স্বর্ণ ও রৌপ্যের অবৈধ চালান আসা বন্ধ হয়নি। প্রায়ই দেশের আইন প্রয়োগকরী সংস্থার হাতে ধরা পড়ছে অবৈধ স্বর্ণ ও রৌপ্যের চালান। এ অবৈধ স্বর্ণ ও রৌপ্যে স্ফীত হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্ট। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে স্থায়ী, অস্থায়ী ও রিজার্ভ খাত মিলে মোট স্বর্ণ জমা রয়েছে প্রায় ৫ হাজার ৩৬০ কেজি। এর মধ্যে ২ হাজার ৯০০ কেজির বেশি আছে অস্থায়ী খাতে। আর স্থায়ী খাতে আছে ১৫৯ কেজি। আর এ দুই খাত মিলে রৌপ্য জমা আছে ৫ হাজার ৪৬৪ কেজি। আন্তর্জাতিক বাজার দরে স্থায়ী ও অস্থায়ী খাতে পড়ে থাকা স্বর্ণ ও রোপ্যের দাম প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। মূলত আটক স্বর্ণ ও রৌপ্যের মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা ও দীর্ঘদিন নিলাম না হওয়ায় এসব স্বর্ণ ও রোপ্য দেশের অর্থনীতিতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না।
জানা যায়, সর্বশেষ ২০০৮ সালের জুনে স্বর্ণ বিক্রির নিলাম করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর পর গত সাড়ে ১৩ বছরেও কোনো নিলাম হয়নি। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে ২ হাজার ২৩০ কেজি স্বর্ণবার নেওয়া হয়েছে, যার আর্থিক মূল্য প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা হওয়া স্বর্ণ সব ধরনের প্রক্রিয়া শেষ করে দ্রুত নিলামে বিক্রি
করা গেলে তা জাতীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। এ জন্য অস্থায়ী খাতে জমা থাকা স্বর্ণের বিপরীতে দায়ের করা মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি ও স্থায়ী খাতে নেওয়া স্বর্ণ দ্রুত নিলামে বিক্রির পদক্ষেপ নেওয়ার পক্ষে মত দেন অনেকেই।
দেশে বছরে স্বর্ণের চাহিদা রয়েছে প্রায় ২০ থেকে ৪০ টন। বাণিজ্যিক আমদানির অনুমতি দেওয়ার পর গত দুবছরে ১২টি প্রতিষ্ঠানকে ৩০৬ দশমিক ৭৬ কেজি স্বর্ণবার আমদানির অনাপত্তি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যা মোট চাহিদার হিসাবে নগণ্য। সূত্রগুলো বলছে, বাণিজ্যিকভাবে স্বর্ণ আমদানির সুযোগ দেওয়ার পরও অবৈধভাবেই দেশে স্বর্ণ আসছে বেশি। গত বৃহস্পতিবার শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) ১৪৩ কেজি ৫৫ গ্রাম স্বর্ণ জব্দ করা হয়েছে। জব্দ স্বর্ণের বাজারমূল্য প্রায় ১০৩ কোটি টাকা। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৭৪ দশমিক ৪৯ কেজি স্বর্ণ এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৮০ দশমিক ৩৫ কেজি স্বর্ণ জব্দ করা হয়।
জানা যায়, কাস্টমস ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়া স্বর্ণের বার, গয়না ও মূল্যবান ধাতু আদালতের নির্দেশে মামলার আলামত হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে অস্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তা অস্থায়ী খাতেই জমা রাখা হয় এবং মামলা নিষ্পত্তি শেষে আদালতের আদেশে এর ভাগ্য নির্ধারণ হয়। অর্থাৎ মামলার রায় দাবিদারের পক্ষে গেলে তা পাওনাদারকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। আর যদি দাবিদার খুঁজে না পাওয়া যায়, সেটি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা হয়। এর মাধ্যমে ওই স্বর্ণ স্থায়ী খাতে নেওয়া হয় এবং নিলামের মাধ্যমে আর্থিক মূল্য কাস্টমস কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়। এ ছাড়া স্থায়ী খাতে নেওয়া স্বর্ণের মান আন্তর্জাতিক মানের হলে সেটি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমৃদ্ধ করতে বাংলাদেশ ব্যাংকই কিনে নেয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, বিভিন্ন সময়ে আটক স্বর্ণ ও রৌপ্য বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা হওয়ার পরই যে নিলামে বিক্রি করতে হবে তা নয়। অনেক সময় জমা হওয়া স্বর্ণ ও রৌপ্যের বিপরীতে মামলা থাকে। সেই মামলা যতদিন ফয়সালা না হবে, ততদিন এটা স্থায়ী তথা সরকারি খাতে যাবে না। যদি মামলা নিষ্পত্তির পর ফয়সালা হয়ে যায় যে কোনো দাবিদার নেই, তা হলে এটা স্থায়ী খাতে যাবে এবং তখনই নিলামের প্রশ্ন আসে। যার কারণে পুরো প্রক্রিয়া শেষ করে নিলাম হতে বিলম্ব হয়।
কোন খাতে কী পরিমাণ স্বর্ণ জমা : বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিসের বুলিয়ন ভল্টে মোট স্বর্ণ জমা আছে ৫ হাজার ৩৫৯ কেজি ৬৯৫ গ্রাম। এর মধ্যে অস্থায়ী খাতে (মামলাধীন) জমা স্বর্ণের পরিমাণ ২ হাজার ৯০০ কেজি ৪৭৬ গ্রাম। মামলা নিষ্পত্তির পর স্থায়ী খাতে জমা আছে ১৫৯ কেজি ৩৯৫ গ্রাম। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে নেওয়া স্বর্ণের পরিমাণ ২ হাজার ২২৯ কেজি ৮২৩ গ্রাম। জানা যায়, সর্বশেষ ২০১৭ সালের ১৭ জানুয়ারি স্থায়ী খাতে নেওয়া ৪৫৬ কেজি ওজনের ৩ হাজার ২৪৬ পিস স্বর্ণবার কিনে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে যোগ করা হয়, যার আর্থিক মূল্য ছিল ১৪১ কোটি ২৭ লাখ টাকা।
কোন খাতে কী পরিমাণ রোপ্য জমা : এখন পর্যন্ত মোট রৌপ্য জমা আছে ১০ হাজার ৭১২ কেজি ১৮৬ গ্রাম। এর মধ্যে অস্থায়ী খাতে জমা ৪৮৯ কেজি ৩৮১ গ্রাম। আর স্থায়ী খাতে জমা ৪ হাজার ৯৭৪ কেজি ৭৬৮ গ্রাম। আর রিজার্ভ খাতে জমা আছে ৫ হাজার ২৪৮ কেজি ৩৬ গ্রাম।
নিলাম হয় না ১৩ বছর : এ পর্যন্ত ৭ বার নিলামের মাধ্যমে স্বর্ণালংকার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সর্বশেষ ২০০৮ সালের ৩০ জুন নিলামের মাধ্যমে একই বছরের ২৩ জুলাই ২১ কেজি ৮১২ গ্রাম বিভিন্ন ধরনের স্বর্ণালংকার বিক্রি করা হয়, যার আর্থিক মূল্য ছিল ৩ কোটি ৫২ লাখ ২৮ হাজার টাকা। বর্তমানে নিলামের মাধ্যমে বিক্রয়যোগ্য স্বর্ণালংকার আছে ৩৮ কেজি ৩৩২ গ্রাম। এর মধ্যে ১০ কেজি ৯৭২ গ্রাম দুদদের তদন্তাধীন থাকায় বিক্রির কার্যক্রম আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, কাস্টমসের মাধ্যমে দুদক ও এনবিআরের ছাড়পত্র পাওয়ার পর স্বর্ণালংকার বিক্রির কার্যক্রম শুরু হবে। এ বিষয়ে কাস্টম হাউসে সম্প্রতি চিঠি পাঠানো হয়েছে।
জানা যায়, স্থায়ী খাতে নেওয়ার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে গোল্ড পরীক্ষা করা, ওজন করা এবং এর হিসাব নিয়মিত লেজারে সংরক্ষণ করার দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ কাজে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের খরচ ছাড়া কোনো লাভ নেই। কারণ মামলা নিষ্পত্তি শেষে ওই সোনার আর্থিক মূল্য কাস্টমসের হাতে তুলে দেওয়া হয়, যা তাদের কমিশন আয় খাতে দেখানো হয়। পরবর্তী সময় সেটা কাস্টমসের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমা হয়।
Leave a Reply