চলতি অর্থবছরে গবেষণা ও বিশেষ গবেষণা খাতে বিশ্ববিদ্যালয় বরাদ্দ করেছে ১৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা, যা মোট বাজেটের মাত্র ২ দশমিক ১ শতাংশ। বাজেটের আকার বিগত বছরের চেয়ে ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ বাড়লেও গবেষণায় বরাদ্দ কমছে ২ দশমিক ৮৪ শতাংশ প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌলিক গবেষণা নেই বললেই চলে। গবেষণাকেন্দ্র গুলোর কোনোটিতেই নেই পর্যাপ্ত লোকবলও। বছরে একবার সেমিনার করা ছাড়া বেশিরভাগ সময়ই বন্ধ থাকে এসব গবেষণাকেন্দ্র। শিক্ষকরাও গবেষণাক্ষেত্রে অনেকটা অনাগ্রহী। শিক্ষকরা বলছেন, গবেষণায় অপর্যাপ্ত বরাদ্দ নেই। ক্লাসরুম, আবাসন ও গ্রন্থাগারে যথাযথ পরিবেশ না থাকাকেও কারণ বলে মানছেন তারা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান শিক্ষক রয়েছেন দুই হাজারের বেশি। ১৯৮৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৬০০। এই দীর্ঘ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকসংখ্যা বাড়লেও কমেছে গবেষণাপত্র ও প্রকাশনা। কোনো বিভাগেই শিক্ষক অনুপাতে তা বাড়েনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা, ইতিহাস, অর্থনীতি, মার্কেটিং, রসায়ন, পদার্থ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান- এই সাত বিভাগের গত ৩০ বছরের বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ থেকে এ তথ্য উঠে এসেছে।
১৯৮৮-৮৯ শিক্ষাবর্ষে এসব বিভাগে ১৮৮ জন শিক্ষকের অধীনে ২০৮টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। সে অনুপাতে ওই একই বিভাগগুলোয় ২৫১ জন শিক্ষকের অধীনে ৩০০টি গবেষণাপত্র বের হওয়ার কথা থাকলেও ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে বের হয়েছে মাত্র ৬০টি। এর প্রায় ৮০ শতাংশ কম। অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষক নিয়োগে যোগ্যতার চেয়ে লবিং এবং রাজনীতি-সংশ্লিষ্টতাকে প্রাধান্য দেওয়া, শিক্ষক রাজনীতিতে মাত্রাতিরিক্ত দলীয়করণ, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এবং সান্ধ্যকালীন কোর্সে অতিরিক্ত মনোযোগের কারণে শিক্ষকরা গবেষণায় সময় দিতে পারছেন না। এ ছাড়া গবেষণা খাতে অপেক্ষাকৃত কম বরাদ্দের অভিযোগ তো আছেই।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, শুধু ব্যক্তিগত পদোন্নতির জন্য যেটুকু গবেষণা বা প্রকাশনার বাধ্যবাধকতা থাকে, তার বাইরে কোনো একাডেমিক কাজ শিক্ষকরা করেন না। অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত গবেষণার কাজ শিক্ষার্থীদের দিয়ে করিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটে বলে জানান শিক্ষার্থীরা।
গবেষণা কমে যাওয়ার ফলে বিশ^ র্যাংকিংয়ে পিছিয়ে পড়ছে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়। বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিং করা দুই প্রতিষ্ঠান ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’ ও ‘কিউএস র্যাংকিং’য়ের তালিকায় ভালো অবস্থানে নেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের অন্যতম সেরার তকমাধারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির কিউএস র্যাংকিংয়ে অবস্থান ৮০০-১০০০, দক্ষিণ এশিয়ায় ১৩৫। আর টাইমস হায়ারের বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে অবস্থান আরও খারাপ, ১০০১ প্লাস।
কিউএস র্যাংকিংয়ে ২০২০ সালে ১ নম্বরে রয়েছে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি)। এ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১১ হাজার ১৬১, যাদের মধ্যে বিদেশি তিন হাজার ৭৩২। স্নাতকে শিক্ষার্থী ১৭ শতাংশ। বাকি ৮৩ শতাংশই স্নাতকোত্তর বা পিএইচডি গবেষক। শিক্ষক রয়েছেন ২ হাজার ৯৭৭ জন। তাদের মধ্যে বিদেশি এক হাজার ৬৭৭ জন।
অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ৩৩ হাজার ৩৬০ শিক্ষার্থীর মধ্যে বিদেশি মাত্র ৪৮ জন। পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনে ৮০ শতাংশ আর স্নাতকোত্তর পর্যায়ে মাত্র ২০ শতাংশ। অর্থাৎ গবেষণায় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ খুবই কম। শিক্ষক রয়েছেন ২ হাজার ২৬৮ জন।
কিউএস র্যাংকিং অনুযায়ী, ২০১২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল ৬০০-এর ঘরে। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত অবস্থান নেমে যায় ৭০০-এর ঘরে। ২০১৯ সালে এ অবস্থানের অবনমন হয়। ২০২০ সালে তা চলে গেছে ৮০০-১০০০-এর ঘরে। আর দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ২০১৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল ২০১-২৫০-এর ঘরে। ২০১৭ সালে ঘুরে দাঁড়িয়ে অবস্থান ১০৯ নম্বরে উঠে আসে। তিন বছরে ফের অবনতি হয়েছে, ২০২০ সালে অবস্থান ১৩৫তম।
বিশ^বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন সূত্রে জানা যায়, সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩ অনুষদ, ৮৪ বিভাগ, ১৩ ইনস্টিটিউট, ৬০টি গবেষণাকেন্দ্র, ১৯টি আবসিক হল ও চারটি হোস্টেল রয়েছে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৩ হাজার ৩৯৬, যার মধ্যে ছেলে ২২ হাজার ৪৯৭, মেয়ে ১৩ হাজার ১৯৫। পিএইচডি গবেষক ১ হাজার ১৬১, এমফিল গবেষক ১ হাজার ৪৩ জন। শিক্ষক এক হাজার ৯৯২ জন।
বার্ষিক বিবরণী অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ সালে কলা অনুষদভুক্ত ১৭ বিভাগে গবেষণা মাত্র ৩৬টি, আর গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ২৬টি। বিজ্ঞান অনুষদে আট বিভাগে গবেষণা ১১৬, প্রকাশিত প্রবন্ধ বা আর্টিকেল ১৬ এবং ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে ৯ বিভাগে ৫২টি প্রবন্ধ বা পাবলিকেশন প্রকাশ পায়। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে ১৬ বিভাগে গবেষণা ৬৪, প্রকাশিত প্রবন্ধ বা বই ১৪; জীববিজ্ঞান অনুষদের ১১ বিভাগে গবেষণা ২১১, প্রকাশনা ২৩৩; ফার্মেসি অনুষদে গবেষণা ৬২, পাবলিকেশন ১০৪; আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদের পাঁচ বিভাগে গবেষণা ৩৪, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি অনুষদে গবেষণা ১৫৮, পাবলিকেশন ৪১; চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগে গবেষণা চার এবং ১৩টি ইনস্টিটিউটে গবেষণা ১৮ ও পাবলিকেশন ৪৮টি।
গবেষণা ও পাবলিকেশন নেই ইসলামিক স্টাডিজ, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি, সংগীত, ভাষাবিজ্ঞান, আইন, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স, ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম, ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট, অর্গানাইজেশন স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড লিডারশিপ বিভাগ, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, অর্থনীতি, লোকপ্রশাসন, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ, অপরাধবিজ্ঞান, প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন, মনোবিজ্ঞান, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি, সমুদ্রবিজ্ঞান, দুর্যোগবিজ্ঞান, আবহাওয়াবিজ্ঞান, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট, পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট এবং লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউটে।
অধিকাংশ শিক্ষকের দাবি, গবেষণার জন্য যে পরিমাণ বরাদ্দ দরকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বাজেটে তা রাখে না। এ কারণে শিক্ষকরাও গবেষণার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজস্ব ও উন্নয়ন বাজেট অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৬টি গবেষণাকেন্দ্রের জন্য বরাদ্দ হয় ৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা।
এর আগের বছর ৭ কোটি ৯৫ লাখ টাকা বরাদ্দ হলেও খরচ হয় ৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে গবেষণার জন্য ৪ কোটি ৮৬ লাখ টাকা খরচ হয়। চলতি অর্থবছরে গবেষণা ও বিশেষ গবেষণা খাতে বিশ্ববিদ্যালয় বরাদ্দ করেছে ১৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা, যা মোট বাজেটের মাত্র ২ দশমিক ১ শতাংশ। বাজেটের আকার বিগত বছরের চেয়ে ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ বাড়লেও গবেষণায় বরাদ্দ কমছে ২ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কার্যক্রমের এ বেহাল দশা নিয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বিবরণীতে গবেষণা কম থাকলেও মূলত আমাদের শিক্ষকরা আরও বেশি গবেষণা করছেন। শিক্ষকরা বার্ষিক বিবরণীতে উল্লেখ করার জন্য সেসব গবেষণা সময়মতো জমা দেন না। এটা ঠিক যে, কিছু শিক্ষক রয়েছেন, যারা গবেষণায় কম আগ্রহী। তবে অসাধারণ কয়েক জন গবেষকও আমাদের রয়েছেন।
ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, জ্ঞানে বিশ্ববিদ্যালয় সমৃদ্ধ হয় আর গবেষণার মাধ্যমেই জ্ঞানের সৃষ্টি। বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানের চর্চা ও শিক্ষাদানের প্রয়োজন আছে, এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না। শিক্ষা ও গবেষণার সংকট বাড়ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে যে প্রত্যাশা, সেটা পূরণ করতে পারছে না।
Leave a Reply