করোনা মহামারীর প্রভাবে একদিকে মানুষের আয় কমছে, অন্যদিকে হু-হু করে বাড়ছে জীবনযাত্রার ব্যয়। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি যেন ‘নিউ নরমাল’ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। লাগামহীন বাজার ব্যবস্থাপনায় নেই কোনো নজরদারি। অনেক পরিবার ব্যয় সংকোচন করে কোনোমতে টিকে আছে।
এ ছাড়া করোনার কারণে লাখ লাখ মানুষ কর্ম হারিয়েছে, অনেক মধ্যবিত্ত নেমেছেন নিম্নবিত্তে; দরিদ্র হয়েছেন অতিদরিদ্র। সঞ্চয় ভেঙে ফেলেছেন অনেকেই। ব্যাংকে সুদের হার কমেছে। সঞ্চয়পত্রেও কড়াকড়ি আরোপ হয়েছে। স্বাভাবিক হয়নি দেশের শেয়ারবাজারও। এসব মন্দ খবরের সঙ্গে আছে টাকার মান কমে যাওয়ার ঘটনাও। ফলে করোনা মহামারীতে বিদ্যমান পরিস্থিতি সরকারের জন্য তৈরি করেছে নানামুখী চ্যালেঞ্জ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা মহামারী শিগগির একেবারে স্বাভাবিক হবে, তা বলা যাচ্ছে না। ফলে সরকারকে বিদ্যমান পরিস্থিতি অনুসারে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
গত বছরের অক্টোবরে প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১৫৩ টাকা থেকে ৭ টাকা বাড়িয়ে ১৬০ টাকা করা হয়। তিন মাসের মাথায় ফের প্রতি লিটারে বাড়ানো হয় ৮ টাকা। ফলে প্রতি লিটার সয়াবিনের দাম পড়ছে ১৬৮ টাকা। এদিকে তিন দিন আগে এক কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৪৫ টাকায়। গতকাল সেই একই পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৫৫-৬০ টাকায়। একই অবস্থা সবজি ও মাছের বাজারেও।
গতকাল বাজারে প্রতি কেজি ঢেঁড়স বিক্রি হয়েছে ১২০-১৩০ টাকায়। গোলবেগুন বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা কেজিতে। একই দামে বিক্রি হচ্ছে করলা। কালো বেগুন বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০ টাকা কেজিতে। প্রকারভেদে শিম বিক্রি হচ্ছে ৫০-৭০ টাকা কেজিতে। পাকা টমেটোর কেজি ৩৫-৫০ টাকা। কাঁচা টমেটো বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকা কেজিতে। অথচ গত সপ্তাহে শিম বিক্রি হয় ২৫-৪০ টাকা কেজিতে। চিচিঙ্গা বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা কেজিতে, গত সপ্তাহে বিক্রি হয় ৪০-৫০ টাকায়। একেকটি ছোট ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ৩০-৩৫ টাকায়। বড় হলে গুনতে হচ্ছে ৫০-৫৫ টাকা। কাঁচা মরিচের কেজি ৬০-৮০ টাকা।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছে, গত এক বছরে বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে ৩১ শতাংশ। এ বছর খাদ্যপণ্যের দাম যতটা বেড়েছে, গত এক দশকে আন্তর্জাতিক বাজারে দরবৃদ্ধির হিসাবে তা সর্বোচ্চ। এর কারণ হিসেবে করোনা মহামারীর পাশাপাশি সর্ববৃহৎ কৃষির দেশ কানাডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারেও অব্যাহতভাবে বাড়ছে পণ্যমূল্য। এ ছাড়া বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মেলাতে জ্বলানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে আবার গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গ্যাসে-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে নতুন করে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে।
নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেও মূল্যস্ফীতি আগের মাসের তুলনায় কমেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। গত বুধবার যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, গত জানুয়ারি মাসে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ডিসেম্বরের চেয়ে কমেছে। সরকারের এই সংস্থার হিসাবে, পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসভিত্তিক) চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ। আগের মাস ডিসেম্বরে এই হার ছিল ৬ শতাংশের ওপরে; ৬ দশমিক ০৫ শতাংশ। নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে যে পণ্য বা সেবার জন্য ১০০ টাকা খরচ করতে হতো, ২০২২ সালের জানুয়ারিতে সেই পণ্য বা সেবার জন্য ১০৫ টাকা ৮৬ পয়সা খরচ করতে হয়েছে। আগের মাসে এই খরচ ছিল ১০৬ টাকা ৫ পয়সা।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, তেল, ডাল আর চিনির দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়ার কারণে দেশের বাজারেও বাড়ছে। তবে কখনও কখনও অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগ নেয়, দাম বাড়িয়ে দেয়, সে জন্য ভোক্তা অধিকার আছে, তারা কাজ করছে। যেখানে অবৈধভাবে পণ্যের দাম বাড়বে, সেখানে ডিসিরা কাজ করবেন, তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকরা আশঙ্কা করছেন, আগামী মাসগুলোতে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিফলন পাওয়া যেতে পারে। এমনিতে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ছে টানা কয়েক মাস ধরে। যার ফলে সংকটে পড়েছেন মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষ। এদিকে স্পেন, আয়ারল্যান্ড ও সুইডেনে ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি থাকায় দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক সতর্ক অবস্থানে আছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেও মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ছে।
করোনা মহামারীর প্রভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়ে ব্যাপকভাবে। মানুষের জীবন-জীবিকা নিয়ে কঠিনতম সময়ে এক বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে সরকারকে। এরপরও সরকারের নেওয়া মেগা প্রকল্প মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগ, কর্ণফুলী টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ ফার্স্টট্র্যাকভুক্ত প্রকল্পগুলো সমাপ্ত করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার।
এদিকে করোনার প্রভাবে সরকারের রাজস্ব আয় ব্যাপকভাবে কমে গেলেও এসব প্রকল্পের ব্যয় সংস্থানের ক্ষেত্রে কোনো কমতি রাখেনি। বাজেট বরাদ্দের পাশাপাশি বৈদেশিক অর্থায়নও প্রায় স্বাভাবিক রেখেছে। এরই ধারাবাহিকতায় কর্ণফুলী টানেল, পদ্মা সেতু, পদ্ম সেতুতে রেলসংযোগ প্রকল্প ও মেট্রোরেল লাইন-৬ প্রকল্প এ বছরের মধ্যেই খুলে দেওয়া হবে যান চলাচলের জন্য। এসব প্রকল্প সঠিক সময়ে শেষ করতে পারলে তা সরকারের কাছে মাইলফলক হয়ে থাকবে। পাশাপাশি এ সময় দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখা, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের চাকা গতিশীল রাখাও সরকারের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ। শুধু তাই নয়, পণ্যমূল্য স্বাভাবিক ও বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশ যে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে প্রবেশ করছে, এটাকে চূড়ান্ত অবস্থানে নিয়ে যাওয়াও এক কঠিন চ্যালেঞ্জ।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর আমাদের সময়কে বলেন, ‘বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পণ্য আমদানির ওপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহার করতে হবে। এ ছাড়া এই মুহূর্তে ভারত থেকে চাল ও পেঁয়াজ আমদানির ওপর জোর দিতে হবে।’
মান হারাচ্ছে টাকা : বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য করে থাকে মার্কিন ডলারে। আন্তঃব্যাংক মুদ্রা বাজারে প্রতি ডলার কিনতে ব্যয় হয়েছে ৮৬ টাকা। যদিও ব্যাংকগুলো নগদ ডলার বিক্রি করছে তিন থেকে চার টাকা বেশি দরে। ব্যাংকের বাইরে খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলার ৯১ থেকে ৯২ টাকায় কেনাবেচা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রতি ডলারের বিনিময়ে পাওয়া যেত ৬৯ টাকা। বর্তমানে প্রতি ডলারের বিনিময়মূল্য ৮৬ টাকায় পৌঁছে গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে আমদানি চাপ বেড়েছে। সে অনুযায়ী প্রবাসীদের পাঠানো আয় বা রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়েনি। ফলে আমদানি দায় পরিশোধে বাড়তি ডলার লাগছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। যে কারণে টাকার বিপরীতে বাড়ছে ডলারের দাম। তবে বাজার স্থিতিশীল রাখতে ব্যাংকগুলোর চাহিদার বিপরীতে ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সার্বিক বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান আমাদের সময়কে বলেন, মহামারীর প্রভাবে বিশ্বব্যাপী পণ্যমূল্য বেড়েছে। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়েছে। পাশাপাশি ফসল উৎপাদন কমেছে। শ্রমিকরা কাজ করতে পারেনি। মধ্যপ্রাচ্যে অনেক শ্রমিক কর্মহীন হয়েছেন। ফলে মানুষের কষ্ট হচ্ছে। তবে সেটি নিরসনে কাজ করছে সরকার। রমজানে কোটি পরিবারের মধ্যে কমমূল্যে নিত্যপণ্য সরবরাহ করা হবে। এ ছাড়া সরবরাহব্যবস্থা ঠিক রাখতে বিশেষ নজর রয়েছে সরকারের। সড়কে যাতে কোনো সমস্যা (চাঁদাবাজি) না হয়, সেটিও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে।
Leave a Reply