বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীনের পররাষ্ট্র সচিবদের অংশগ্রহণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে সবশেষ ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয় গত বছরের ১৯ জানুয়ারি। দেড় ঘণ্টার ওই বৈঠকে কবে প্রত্যাবাসন শুরু হবে, সেই সমাধান আসেনি। উল্টো ভিন্ন ভিন্ন প্রস্তাব আসে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে।
পরের মাসে মিয়ানমারের ক্ষমতায় আসে সেনাবাহিনী। তখন থেকেই দেশটির সঙ্গে সব ধরনের কূটনৈতিক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় বাংলাদেশের। এ অবস্থায় নিজ দেশে ফিরে যাওয়া নিয়ে সন্দিহান রোহিঙ্গারা।
বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে একসময় রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয় মিয়ানমার। দুই দফা প্রত্যাবাসনের চেষ্টাও হয়। কিন্তু তাদের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব না মেলায় ভেস্তে গেছে সে চেষ্টা। প্রথম দফায় ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বরে এবং দ্বিতীয় দফায় ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট এ উদ্যোগ ভেস্তে যায়। দ্বিতীয় দফায় তিন হাজার ৫৪০ জনকে ফেরত নিতে অনাপত্তিপত্র দিয়েছিল মিয়ানমার।
এর আগে প্রত্যাবাসনের জন্য কয়েক দফায় মিয়ানমারকে ৮ লাখ ২৯ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা হস্তান্তর করা হয়েছে। তার মধ্যে ৪২ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা যাচাই করেছে মিয়ানমার। কিন্তু রোহিঙ্গারা ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে পাঁচটি দাবি তোলেন। এগুলো হলো- রোহিঙ্গা স্বীকৃতি দিয়ে নাগরিকত্ব প্রদান, ভিটেমাটি ও জমিজমা ফেরত, আকিয়াব জেলায় এডিবি ক্যাম্পে আশ্রয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের নিজ বাড়িতে ফেরত, বুচিদং ও মংডু জেলায় বিভিন্ন কারাগারে বন্দি রোহিঙ্গাদের মুক্তি, হত্যা-ধর্ষণের বিচার ও জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মোতায়েন। প্রথম দফার ক্ষেত্রেও এ রকম দাবি জানিয়েছিলেন রোহিঙ্গারা। রাখাইনে পরিবেশ অনুকূল না হলে তারা ফিরতে নারাজ।
এদিকে দীর্ঘদিন আলোচনা বন্ধ থাকার পর গত ২৮ জানুয়ারি রাখাইনে প্রত্যাবাসনের তালিকায় থাকা রোহিঙ্গাদের পরিচয় যাচাইসংক্রান্ত টাস্কফোর্সের প্রথম বৈঠক হয়। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের মধ্যে ভার্চুয়ালি এ বৈঠক হয়। মিয়ানমারে সামরিক শাসন শুরুর পর এই প্রথম রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে প্রথম আলোচনা হলো। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রিজওয়ান হায়াত বাংলাদেশের এবং মিয়ানমারের বহিরাগমন এবং জনসংখ্যা মন্ত্রণালয়ের উপমহাপরিচালক বৈঠকে দুই পক্ষের নেতৃত্ব দেন। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে রাখাইনের বাস্তুচ্যুত লোকজনের আদি নিবাস চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণের কারণ খুঁজে বের করে তা দূর করার জন্য একসঙ্গে কাজ করার বিষয়ে দুই পক্ষ একমত হয়।
বৈঠকে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিয়ানমারের লোকজনের আদি নিবাস যাচাইয়ে দেরি হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন। দুই পক্ষের মধ্যে সই হওয়া তিনটি চুক্তির আওতায় এসব বিষয় দ্রুত সুরাহার জন্য বাংলাদেশ সব ধরনের সহায়তা দিতে তৈরি বলে মিয়ানমারের কাছে তিনি উল্লেখ করেন। রোহিঙ্গাদের আদি নিবাস যাচাইয়ের বিষয়টিতে জোর দিয়ে শাহ রিজওয়ান হায়াত উল্লেখ করেন, এটি হলে দ্রুত প্রত্যাবাসন শুরু হবে। প্রত্যাবাসনের জন্য তিনি রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি এবং রোহিঙ্গাদের মধ্যে আস্থা সৃষ্টির ওপর জোর দেন। রোহিঙ্গাদের পরিচয় যাচাইয়ের ক্ষেত্রে কারিগরি সমস্যা ও তথ্যঘাটতির প্রসঙ্গ টেনে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল বিষয়টি সুরাহার আশ্বাস দেয়।
এদিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কবে শুরু হবে সে বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘ঠিক কবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হবে সেটি নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। তবে আমরা চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও দায়িত্ব আছে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর।’
দীর্ঘদিন প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমারের অনাগ্রহকে দুঃখজনক অভিহিত করে মন্ত্রী বলেন, ‘অবশ্যই রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে হবে। বিভিন্ন বাহানায় তারা আলোচনা বন্ধ রেখেছিল। তবে সম্প্রতি টেকনিক্যাল কমিটির একটি বৈঠক হয়েছে। সেখানে প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা হয়েছে।’
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ইস্যুকে পাশ কাটিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো ও জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গাদের জীবনমান উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প গ্রহণে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ক্যাম্পগুলোকে জীবনমান ও সুযোগ-সুবিধাগুলো বৃদ্ধি, তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, কারিগরি প্রশিক্ষণ, সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও নানাবিধ বহুবার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের বিষয়ে বেশি তৎপর হয়ে উঠছে। এটিও চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের জন্য। শরণার্থীদের আশ্রয়দাতা দেশে অন্তর্ভুক্ত করাসহ একগুচ্ছ সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে যে ‘পলিসি রিফর্ম ফ্রেমওয়ার্ক’ প্রতিবেদন তৈরি করেছে বিশ্বব্যাংক, তা প্রত্যাখ্যান করেছে বাংলাদেশ। কারণ বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। আর নির্যাতিত ও বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ সাময়িক আশ্রয় দিচ্ছে এবং স্বদেশে তাদের প্রত্যাবাসন হচ্ছে বাংলাদেশের একমাত্র অগ্রাধিকার বলে স্পষ্ট করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে মিয়ানমারের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করে বাংলাদেশ। স্মারকে দুই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসন শুরুর কথা বলা হয়। তবে কবে সেই প্রক্রিয়া শেষ হবে, সে সময়সীমা উল্লেখ করা হয়নি। সমঝোতা স্মারকে তিন সপ্তাহের মধ্যে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ ও দুই মাসের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া মাঠপর্যায়ে শুরুর কথা বলা হয়। চুক্তির ২৬ দিনের মাথায় ১৯ ডিসেম্বর জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠিত হয়।
Leave a Reply