ইদানীং ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, হার্ট অ্যাটাক, ব্রেইন স্ট্রোক, অতিরিক্ত ওজন, কিডনি ফেইলিউর, ক্যানসার ইত্যাদি অসংক্রামক রোগের বিস্তার বিশ্বব্যাপী ব্যাপক হারে বেড়েই চলেছে। এ রোগগুলোর মধ্যে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা পৃথিবীর প্রায় সব দেশের মানুষের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশেও বেড়ে চলেছে। অসংক্রামক রোগ কোনো জীবাণুর মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে না।
তাই অ্যান্টিবায়োটিক, টিকাসহ চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতির ফলে জীবাণুুবাহিত সংক্রামক রোগ কিছুটা দমন করা সম্ভব হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, আমাদের দেশে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ লাখ ডায়াবেটিস রোগী রয়েছেন। এদের সবারই যে রোগ নির্ণিত হয়েছে, এমন নয়। আনুমানিক ৫০ শতাংশ মানুষ জানেনই না, তাদের ডায়াবেটিস হয়েছে। যে ৩০ থেকে ৪০ লাখ রোগী কোনো না কোনোভাবে চিকিৎসার আওতায় এসেছেন, তাদের চিকিৎসা কেমন হচ্ছে বা পরিণতি কী হতে যাচ্ছে, তা অনুমান করা যায়।
ডায়াবেটিস চিকিৎসার উদ্দেশ্য হলো, চিকিৎসার মাধ্যমে ডায়াবেটিস সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক জটিলতা হতে না দেওয়া। চিকিৎসা যথাযথ না হলে কয়েক বছরের মধ্যে কিডনি ফেইলিউর, দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া, হাত-পা জ্বালাপোড়া, পায়ের বোধশক্তি কমে গিয়ে ক্রমে ঘা হওয়া, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোকসহ বিভিন্ন জটিলতায় জীবনের মান ক্রমে কমে যেতে থাকে। এতে রোগীর ব্যক্তিগত কষ্ট ছাড়াও পরিবার এবং রাষ্ট্রের শ্রমশক্তি ও অর্থের ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে চাপ তৈরি হয়।
কীভাবে এসব প্রতিহত বা কমানো যায়, তা বিবেচনায় রেখে ডায়াবেটিস রোগীর চিকিৎসার টার্গেট ঠিক করা হয়। ডায়াবেটিস রোগ নিয়ে যেসব দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা আছে, গবেষণার আলোকে তারা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, রোগ নির্ণয়ের পর থেকেই রোগীর রক্তের গ্লুকোজ ৪ থেকে ১০ মিলিমোলের (৭০ থেকে ১৮০ মিলিগ্রাম) মধ্যে রাখতে হবে। ডায়াবেটিস ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণে থাকলে ঐন অ১প নামক পরীক্ষার ফল হবে ৭-এর নিচে। অনেক রোগীই জানেন, তাদের রক্তে ঐন অ১প-এর মাত্রা কত। হয়তো অনেক বেশি। অথচ গবেষণায় সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে, ঐন অ১প-এর মাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডায়াবেটিস রোগীর সব ধরনের জটিলতা দ্রুত বাড়তে থাকে।
উদ্বেগের বিষয় হলো, সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৩০-৫০ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগী রোগ নির্ণয় হওয়ার পর প্রথাগত চিকিৎসা সত্ত্বেও রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। অর্থাৎ বেশির ভাগ সময়ই রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেশি থাকছে। এর কারণ যা-ই হোক, অনিয়ন্ত্রিত বা আংশিক চিকিৎসার ফলে ডায়াবেটিস চিকিৎসার পরিপূর্ণ সুফল থেকে রোগী বঞ্চিত হচ্ছেন। ফলে ডায়াবেটিসজনিত কিডনি রোগ, চোখের সমস্যা, হৃদরোগ, স্ট্রোক ইত্যাদিসহ বিভিন্ন জটিলতা এড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই এ চিত্র কমবেশি বিদ্যমান। অনুমান করা যায়, আমাদের দেশেও ডায়াবেটিস রোগীর অর্ধেকেরও বেশি চিকিৎসার লক্ষ্যমাত্রা থেকে দূরেই থাকছেন। অবশ্য চিকিৎসার মাধ্যমে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা নিয়ে চলছে ব্যাপক গবেষণা। কারণ নির্ণয় করে চিকিৎসা দিলেই ভালো ফল পাওয়া সম্ভব।
রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ঠিক রাখার পাশাপাশি রোগীর উচিত ব্লাডপ্রেসার, রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা, দেহের ওজন ইত্যাদি ঠিক রাখা। চিকিৎসকের পরামর্শে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া। রোগী যদি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে সঠিক পদ্ধেিত জীবনযাপন করেন, তবেই ডায়াবেটিস চিকিৎসার এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হতে পারে।
লেখক : ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ; শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা
Leave a Reply