মেজর সিনহা পরিকল্পিত হত্যার শিকার। বিচারক রায় প্রদানকালে এই পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু এই পরিকল্পিত হত্যার সাথে চরম জিঘাংসারও বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। যা ভয়াবহ ও মর্মান্তিক। এসব বিষয়ে পর্যালোচনা করা আমাদের জন্য খুবই জরুরি।
প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিলেন এমন একজন (স্বেচ্ছায় অবসরপ্রাপ্ত) চৌকস সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা কেন করা হয়? এই পরিকল্পনার কী উৎস, কী উদ্দেশ্য, কারা কারা জড়িত, এই হত্যার মূল লক্ষ্য কী এসব বিষয় অনুসন্ধান করা অবশ্যক।
একজন ওসি বা পুলিশের পরিদর্শক সেনাবাহিনীর একজন মেজরকে খুন করার পরিকল্পনা বা ষড়যন্ত্র করবে এটা কোনক্রমেই সরল সমীকরণ নয়। এই হত্যার দুরভিসন্ধি উদঘাটন করা ভবিষ্যতের প্রয়োজনেই গুরুত্বপূর্ণ।
ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, চেকপোষ্টে মেজর সিনহা দুই হাত উঁচু করে গাড়ি থেকে কামডাউন কামডাউন বলেন এবং পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। লিয়াকত আলী মেজর সিনহার পরিচয় জেনেও তার কোন কথা না শুনে এবং কোন ধরনের সময় না দিয়েই তাকে লক্ষ্য করে প্রথমে গুলি ছোড়েন এবং কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে আবারও গুলি করেন।
এতে মেজর সিনহা রাস্তায় পড়ে যান। লিয়াকত আলী এ অবস্থায় সিনহাকে হাতকড়াও পরানোর নির্দেশ দেন। এসআই নন্দলাল আহত সিনহাকে হাতকড়া পরান।
এরপর লিয়াকত আলী মোবাইল ফোনে ওসি প্রদীপ এর সঙ্গে এক মিনিট ১৯ সেকেন্ড কথা বলেন এবং রাত ৯ টা ৩০ মিনিটে ঘটনাটি কক্সবাজারের এসপিকে জানান। সিনহা তখনও জীবিত ছিলেন এবং ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে সিনহা পানি খাওয়ার জন্য আকুতি মিনতি করছিলেন। এটা শুনে লিয়াকত আলী আরো উত্তেজিত হয়ে বলেন, তোকে গুলি করেছি কি পানি খাওয়ানোর জন্য? এরপর লিয়াকত আহত সিনহার কাছে যান এবং বুকের বা-পাশ জুড়ে কয়টা লাথি মেরে বুকের পাঁজরের কয়েকটা হাড় ভেঙে ফেলেন এবং পা দিয়ে গলা চেপে ধরেন।
রাত দশটার দিকে ওসি প্রদীপ একটি সাদা মাইক্রোবাস ও একটি পিকআপ ভ্যানে ফোর্স নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছান। প্রদীপ ও লিয়াকত একান্তে কিছু সময় সলাপরামর্শ করেন। এরপর প্রদীপ গুলিবিদ্ধ সিনহার কাছে গিয়ে দম্ভোক্তি করে বলেন, অনেক টার্গেট নেওয়ার পর কুত্তার বাচ্চাদের কিচ্ছু করতে পারছি। প্রদীপ প্রথমে সিনহাকে পা দিয়ে নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখেন। সিনহা তখনও জীবিত এবং পানির জন্য আকুতি করছিলেন। প্রদীপ তখন তার পায়ের জুতা দিয়ে সিনহার গলা চেপে ধরেন এবং এক পর্যায়ে সিনহার শেষ নাড়াচাড়াও বন্ধ হয়ে যায়। সিনহাকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর তারা এক ধরনের বিকৃত ও পৈশাচিক আনন্দ লাভ করে। তারপর মাদকের গল্প সাজায়।
উপর্যুপরি গুলি করার পরে মাটিতে কাতরানো অবস্থায় নিরস্ত্র একজন মানুষকে হাতকড়া পরানো কতটা জরুরি ছিল। সেনাবাহিনীর একজন ‘মেজর’ নিশ্চিত হওয়ার পর দ্রুত গুলি করা, তারপর রক্তাক্ত দেহে লাথির পর লাথি, জুতা দিয়ে গলা চেপে ধরার যে নির্মমতা, যে নিষ্ঠুরতা এবং মৃত্যু যন্ত্রণাকাতর মুমুর্ষ একজন মানুষকে চিরকালীন বিদায়ে এক ফোটা পানি না দেয়ার মাধ্যমে যে জিঘাংসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, তাকে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা বলে আত্মপ্রসাদ লাভ এর কোনো সুযোগ নেই।
প্রশ্ন জাগে এ ধরনের অসংখ্য বর্বরোচিত হত্যার সাথে জড়িত হিংস্র এবং দুর্ধর্ষ একজন ওসি কিভাবে বছরকে বছর তার দায়িত্ব পালন করেছে।
টেকনাফ থানায় প্রদীপ কুমার দাশ ২২ মাসে বন্দুকযুদ্ধে ১৪৪ জনকে হত্যা করেছে। তখন কি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা সরকারের মনে হয়নি কেউ একজন পর পর ১৪৪ জন মানুষ হত্যার একই গল্প বার বার বলে যাচ্ছে, তার কারণ অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। বরং ওসি প্রদীপ কুমার দাশ মানুষ হত্যার গল্প বলে বারবার পুলিশ পদক বাগিয়ে নিয়েছে, হত্যার জন্য বারবার পুরস্কৃত হয়েছে।
মেজর সিনহাকেও অন্যান্যদের মত মাদক কারবারি বানানোর মিথ্যা নাটক সাজানো হয়েছিল, সাজানো হয়েছিল আত্মরক্ষার্থে গুলি করে হত্যার নাটকও। কিন্তু অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের সংগঠন ‘রাওয়া’ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তীব্র প্রতিবাদের কারণে সে নাটক মঞ্চস্থ হতে পারেনি।
এখন প্রমাণিত হচ্ছে বিচারবহির্ভূত হত্যার নামে এতদিন যে সব গল্প প্রচার করা হতো সেসব গল্পের কোন সত্যতা নেই। কিন্তু সরকার কি এখন অতীতে ঘটে যাওয়া বিচারবহির্ভূত হত্যার প্রতিটি ঘটনা অনুসন্ধান এবং কারা কারা জড়িত তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনবে? স্বজনহারা মানুষদের কিছুটা কি সান্ত্বনা যোগাবে? আর যারা বিনা অপরাধে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছে তাদের মুক্তির কোন ব্যবস্থা করবে? যারা অত্যাচারিত হয়েছে তাদের কোনো প্রতিকার মিলবে?
যারা দিনের পর দিন বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ার হত্যায় জড়িত থাকছে তাদের মনন, তাদের গভীর মনস্তত্ত্ব, তাদের আচরণ, পর্যবেক্ষণ এবং তাদের সম্পদের অনুসন্ধান করে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার সরকারের কোন উদ্যোগ কি আছে? হত্যাকে পুরস্কারের উপাদানে বা বীরত্ব হিসাবে সংযুক্ত করলে কি ভয়ংকর পরিণতি হতে পারে তা কি সরকার বিবেচনা নিচ্ছে? প্রত্যেক মানুষের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে। কিন্তু যারা অসহায় তাদের হত্যা করা হবে আর তারা এর বিচারটুকুও পাবেনা তাহলে আর প্রজাতন্ত্রের প্রয়োজন থাকেনা।
সুপ্রিম কোর্ট মৌলিক অধিকার তথা সংবিধানের অভিভাবক। বিচারবহির্ভূত হত্যার প্রশ্নে সরকারকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্য উচ্চতর আদালত স্বীয় বিবেচনায় তার এখতিয়ার প্রয়োগ করবেন এটাই জাতির প্রত্যাশা।
সিনহা হত্যা মামলায় রেপিড একশন ব্যাটেলিয়নের দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ‘অপরাধের জন্য পুলিশ সদস্যদের নিয়ে নিজস্ব একটা পেটুয়া ও সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন ওসি প্রদীপ। তাঁর চাহিদা মতো টাকা না দিলে মামলায় ফাঁসানো ও বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজিয়ে মানুষ খুন করতেন।’
সরকারের পুলিশ বাহিনী দিয়ে ‘নিজস্ব পেটুয়া ও সন্ত্রাসী বাহিনী’ গড়ে তোলা যায় অথচ সরকার সেদিকে নজর দেবে না এটা কোন সভ্য দেশে কল্পনাও করা যায় না। ওসি প্রদীপ এর উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ সব জেনেও নীরব রয়েছেন, এসব দায় অবশ্যই নির্ধারণ করা উচিত।
সিনহা হত্যার পর ওসি প্রদীপ এর ক্রসফায়ার বাণিজ্য প্রকাশিত হওয়ায় বাংলাদেশে আরও কতজন ক্রসফায়ারের বাণিজ্য করছে, পুলিশ দিয়ে নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলে তা তদন্ত করার জন্য সরকার কি কোন উদ্যোগ নিয়েছে? এই ধরনের বিবেকবর্জিত, কান্ডজ্ঞানহীন এবং মানসিক ভারসাম্যহীন কর্মকর্তারা মাঠে থাকলে কি ভয়ঙ্কর বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটতে পারে তা জাতি প্রত্যক্ষ করেছে। কিন্তু সরকার কি ক্রসফায়ারে জড়িত থাকা পুলিশ কর্মকর্তাদের মাঠ পর্যায় থেকে প্রত্যাহার করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে! না আরেকজন প্রদীপের ভয়ঙ্কর চিত্র প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত সরকার অপেক্ষা করবে!
হাওয়ার্ড ফাস্ট তার স্পার্টাকাস গ্রন্থে বলেছিলেন আমাদের জীবন যে কত শূন্যগর্ভ সে সম্পর্কে আমরা একটা কথাও বলি না। অসভ্য বর্বরদের কর্মকাণ্ড গুলোকে আমরা পূজাপার্বণের মত মেনে চলি। আমরা পশুস্তরে নামতে নামতে এমন এক জায়গায় নেমে এসেছি যেখানে আমাদের আচরণ জড় পিণ্ডের মতো, আর এই জড়ত্ব ক্রমশই বাড়ছে।
Leave a Reply