‘ভয় ও শঙ্কা’ কাটিয়ে দলকে সক্রিয় করে চূড়ান্ত আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে চায় বিএনপি। সেই পরিকল্পনা নিয়েই এগোচ্ছে। দলটি মনে করে, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন একই সূত্রে গাঁথা। নেতারা বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তি ও গণতন্ত্র- এ দুটিকে ভিত্তি ধরেই তারা এগোচ্ছেন এবং দাবি আদায়ে নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচিও পালন করছেন। এর মাধ্যমে জনমত তৈরি, আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত ও দলের সাংগঠনিক সক্ষমতা যাচাই করবে দলটি।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় আমাদের সময়কে বলেন, ‘হামলা, মামলা, গুম, খুনসহ নানা নির্যাতনের কারণে যে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল, তার অনেকটাই কেটে গেছে। বিএনপির প্রতিটি কর্মসূচিতে জনস্রোত নামছে।
মানুষ এখন ১৪৪ ধারারও পরোয়া করছে না। মানুষ এখন চিন্তা করতে পারছে দেশে পরিবর্তন হবে। এ-ও বিশ্বাস করছে, পরিবর্তন বিএনপির নেতৃত্বেই ঘটবে। আমরা আশাবাদী।’
দলটির নেতারা বলেন, ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাবন্দি হন। এর আগে ৩ ফেব্রুয়ারি নির্বাহী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। চেয়ারপারসন কারাবন্দি হওয়ার পর তারেক রহমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। যৌথ নেতৃত্বে দল পরিচালিত হয়। খালেদা জিয়া কারাবন্দি হলে দলের প্রতিটি কর্মকা- বিশেষ করে আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে না পারা, খালেদা জিয়াকে মুক্ত না করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ, জাতীয় সংসদে যোগ দেওয়াসহ বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত নিয়ে দলে ও দলের বাইরে নানা আলোচনা-সমালোচনা দেখা দেয়। দল অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।
এ অবস্থায় গত বছরের সেপ্টেম্বরে নির্বাহী কমিটির সিরিজ বৈঠক করেন দলের সিনিয়র নেতারা। এই বৈঠকে যুক্তরাজ্য থেকে ভার্চুয়ালি যোগ দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ওই বৈঠকে দলের ভবিষ্যৎ করণীয় নিয়ে নির্বাহী কমিটি ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কমিটির নেতারা মতামত দেন। মতামত নেওয়া হয় বিএনপিপন্থি নানা পেশার মানুষের কাছ থেকেও।
দলের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা বলেন, এই বৈঠক বিএনপির রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে অনেকেরই মতবিনিময় হয়েছে। আগে যেমন স্থায়ী কমিটির নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত নিতেন, সেই অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। দলের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দলের ভাইস চেয়ারম্যান, উপদেষ্টা এবং জেলার নেতাদের সঙ্গেও এখন কথা বলেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আমাদের সময়কে বলেন, ‘যারা ভেবেছিল গণতন্ত্রের মাতা খালেদা জিয়াকে কারাগারে নিয়ে বিএনপিকে শেষ করে দিবে, তাদের সেই ভাবনায় পানি ঢেলে দিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দেশের মানুষ এখন তার নেতৃত্বেই পরিবর্তনের কথা ভাবছে।’
লিভারসিরোসিসে আক্রান্ত খালেদা জিয়ার বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দাবিতে গত নভেম্বর থেকে সারাদেশে লাগাতার নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে বিএনপি। এর মধ্যে ঢাকাসহ সারাদেশে গণঅনশন, ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরে সমাবেশ করে বিএনপি। গত ২২ নভেম্বর থেকে জেলায় জেলায় সমাবেশ শুরু করে দলটি। নানা বাধার পরও এ পর্যন্ত দলটি ২৮ জেলায় সমাবেশ করেছে। এরই মধ্যে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ফেনী, কক্সবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সমাবেশ করেছে। প্রতিটি কর্মসূচিতে মানুষের অংশগ্রহণ বিএনপিকে ইতিবাচক আলোচনায় নিয়ে এসেছে। আগামী ১২ জানুয়ারি থেকে আরও ৩৯ সাংগঠনিক জেলায় সমাবেশ ডেকেছে। তৃণমূলেও এর প্রভাব পড়েছে। পটুয়াখালী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য অধ্যক্ষ বাহাউদ্দিন বাহার আমাদের সময়কে বলেন, ‘তৃণমূলে আমরা ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি।’
বিএনপির নেতারা বলেন, সম্প্রতি র্যাব ও তাদের সাত সাবেক এবং বর্তমান কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। চলমান এই কর্মসূচির মধ্যে এমন ঘটনা ঘটায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যেও নিরপেক্ষতা দেখতে পাচ্ছে বিএনপি। সমাবেশগুলোয় তেমন কোনো বাধাও আসছে না। যার কারণে নেতাকর্মীদের মাঝেও একটা সক্রিয়ভাব এসেছে।
চলমান জেলা সমাবেশ প্রসঙ্গে দলের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বলেন, এসব কর্মসূচির মধ্য দিয়ে কোনো নেতার কী ভূমিকা, কার কেমন সক্ষমতা দেখা হচ্ছে। বিশেষ করে যারা বিগত সময় সংসদ নির্বাচন করেছেন এবং যারা করতে চান তাদের সক্ষমতাও দেখতে পারছেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। শুধু তাই নয়; চলমান কর্মসূচির মধ্যদিয়ে তৃণমূল পর্যায়ের দায়িত্বশীল নেতাদের সক্ষমতাও দেখা হচ্ছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিজে প্রতিটি কর্মসূচিতে কার কী ভূমিকা তা পর্যবেক্ষণ করছেন। এরই মধ্যে কয়েকটি জেলা কমিটির ব্যাপারে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন। ব্যর্থতার কারণে বর্তমান নেতৃত্ব সরিয়ে সংশ্লিষ্ট জেলায় নতুন নেতৃত্ব আনার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
দলের স্থায়ী কমিটির এক নেতা বলেন, কোনো আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা না থাকলে সেই আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায় না। চলমান আন্দোলন কর্মসূচিতে যেভাবে মানুষ অংশগ্রহণ করছে, তাতে আমরা আশাবাদী। সব শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে ভয়ের পরিবেশ থেকে মানুষ আজ জেগে উঠেছে। আশা করি এ সরকারের পতন ঘটিয়ে দেশে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করে মানুষের ভোটাধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, দেশের মানুষের অধিকার আদায়, সার্বভৌমত্ব রক্ষা, গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে গিয়ে খালেদা জিয়া আজ মৃত্যুর পথে। তার মতো সাচ্চা জাতীয়তাবাদী নেতা, যিনি দেশের এক ইঞ্চি জমি ছাড়তেও সম্মতি দেননি কখনও, তিনি মরে যাবেন, আর আমরা বসে থাকব এমনটি নিশ্চয়ই হবে না। দ্রুত সময়ের মধ্যে খালেদা জিয়াকে সুচিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর অনুমতি দেওয়া না হলে সরকারের পরিণতি ভয়ঙ্কর হবে।
Leave a Reply