1. tasermahmud@gmail.com : admi2017 :
  2. akazadjm@gmail.com : Taser Khan : Taser Khan
বুধবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:০২ অপরাহ্ন

পরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

মুহতাসিম আহমেদ
  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ৬ জানুয়ারী, ২০২২

বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। বিশাল জনসংখ্যার ক্রমাগত বৃদ্ধির ফলে দেশে দিন দিন বর্জ্যরে পরিমাণ বাড়ছে, যা পরিবেশের জন্যে খুবই উদ্বেগজনক।

অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশেরও বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা অনুন্নত। আমাদের দেশে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বলতে সাধারণত একটি নির্দিষ্ট খোলা স্থানে বর্জ্যগুলো স্তুপ করা (ময়লার ভাগাড়) বুঝে থাকি; কিন্তু বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় এটি কোনো সমাধান নয়। এভাবে বর্জ্য খোলা স্থানে ফেললে তা থেকে দুর্গন্ধ ছড়ায়, বিভিন্ন প্রকারের রোগবাহী জীবাণু ও কীটপতঙ্গের উৎপত্তি ঘটে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ল্যান্ডফিল বা ময়লার ভাগাড়ে বর্জ্যরে পরিমাণ কমাতে এগুলো সরাসরি পোড়ানো হয়। এতে প্রচুর গ্রিন হাউজ গ্যাস (কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন ইত্যাদি) নিঃসরিত হয়। এ ছাড়াও ল্যান্ডফিলে বর্জ্য পচে গিয়ে যে তরল নির্গত হয় তা ভূ-গর্ভের পানির সাথে মিশে পানি দূষিত করে। অর্থাৎ আমাদের বর্তমান বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনায় ল্যান্ডফিল অপরিকল্পিতভাবে ব্যবহারের কারণে দিন দিন পরিবেশ দূষণের ঝুঁকি বাড়ছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অন্যান্য যে ধাপ রয়েছে সেগুলোও এ দেশে ঠিকভাবে অনুসরণ করা হয় না। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে এমনিতেই বাংলাদেশের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। পরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা না গেলে দেশের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর আরো বিপর্যয় নেমে আসবে। তাই এ ক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনা ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন সময়ের প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার ইতোমধ্যে কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে আরো কঠোর আইন ও তার যথাযথ প্রয়োগ প্রয়োজন।

বাংলাদেশে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত যে সব পরিবেশ সংরক্ষণ সংক্রান্ত আইন, বিধিমালা ও আদেশ রয়েছে সেগুলো হলো- ১. বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫, ২. বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-২০০০ (সংশোধিত), ৩. বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-২০০২ (সংশোধিত), ৪. বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-২০১২ (সংশোধিত), ৫. পরিবেশ আদালত আইন-২০০০, ৬. পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা-১৯৯৭, ৭. পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা-১৯৯৭ (সংশোধিত ফেব্রুয়ারি), ৮. পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা-১৯৯৭ (সংশোধিত আগস্ট), ৯. পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা-১৯৯৭ (সংশোধিত ২০০৫), ১০. পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা-১৯৯৭ (সংশোধিত ২০১০)। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত যেসব বিধিমালা ও আদেশ রয়েছে সেগুলো হলো- ১. চিকিৎসাবর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ) বিধিমালা-২০০৮, ২. বিপজ্জনক বর্জ্য ও জাহাজ ভাঙার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা-২০১১, ৩. ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক পণ্য থেকে সৃষ্ট বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ব্যবস্থাপনা বিধিমালা-২০১৭ (খসড়া)।

বাংলাদেশে শহরগুলোতে গ্রামের তুলনায় সুযোগ-সুবিধা বেশি থাকায় দিন দিন মানুষজন শহরমুখী হয়ে উঠছে। ফলে শহরাঞ্চলে বর্জ্য উৎপন্নের পরিমাণ গ্রামের তুলনায় অনেক বেশি। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ২০০৫ সালে বাংলাদেশে প্রতিদিন ১৩ হাজার ৩৩০ টন বর্জ্য উৎপন্ন হতো যা ২০১৫ সালে বেড়ে ২৪ হাজার ৬৬৫ টন ছিল। ধারণা করা হয়, দৈনিক বর্জ্য উৎপন্নের এই পরিমাণ ২০২৫ সাল নাগাদ বৃদ্ধি পেয়ে ৪৭ হাজার টন হবে। ২০১৮ সালের অন্য আরেকটি রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতিদিন রাজধানীতেই প্রায় সাত হাজার টন বর্জ্য তৈরি হয়। বর্তমানে করোনা মহামারীর জন্য এর পরিমাণ আরো বেড়েছে, যার ফলে দেশের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আরো বেশি হুমকির মুখে পড়েছে। এই বিপুল পরিমাণ বর্জ্য সংগ্রহ করে নির্ধারিত স্থানে ফেলার মতো অবকাঠামো ঢাকায় নেই। বিশেষ করে করোনা মহামারীর সময়ে মেডিক্যাল বর্জ্য অনেক বেশি উৎপন্ন হলেও তার যথাযথ নিষ্কাশন হচ্ছে না। ফলে রোগজীবাণু সংক্রমণের ঝুঁঁকি বেড়েছে। দফায় দফায় লকডাউনের জন্য বর্জ্য সংগ্রহ ব্যবস্থায়ও স্থবিরতা লক্ষিত হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ঢাকায় উৎপন্ন মোট বর্জ্যরে ৭০-৭৫ শতাংশ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। বাকি বর্জ্য নানাভাবে যেখানে সেখানে ছড়িয়ে থাকে, যা পরিবেশ দূষণের প্রধান কারণ। দেশের অন্যান্য শহরাঞ্চলের চিত্রও তুলানামূলক একই রকম, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা আরো বেশি হতাশার।

টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে এবং বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তরিত করতে চাইলে আমাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতেই হবে। এটি খুব শিগগিরই করে ফেলা যাবে তা-ও নয়। তবে এখন থেকেই যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নতির জন্য প্রথমেই যা প্রয়োজন তা হচ্ছে সঠিক পরিকল্পনা। এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে ৫০-১০০ বছরের মহাপরিকল্পনা করা যেতে পারে। দেশে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য প্রচলিত আইনগুলোর সাথে এই মহাপরিকল্পনার কঠোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। তবেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চিত্র পাল্টাতে শুরু করবে। টেকসই উন্নয়ন অর্জনের লক্ষ্যে উন্নত দেশেগুলোর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করা যেতে পারে। দেশের বড় শহরগুলোতে বর্জ্য উৎপন্নের পরিমাণ অনেক বেশি। যে সব বিভাগীয় ও জেলা শহরে বর্জ্য উৎপন্নের পরিমাণ বেশি, সেগুলো চিহ্নিত করে আলাদা ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।

এই শহরগুলোতে পরিকল্পিত ময়লার ভাগাড় (খধহফভরষষ), কম্পোস্ট সার (ঈড়সঢ়ড়ংঃ) উৎপাদন কেন্দ্র, বর্জ্য পুনরায় ব্যবহার (জবঁংব), রিসাইকেল (জবপুপষরহম) কেন্দ্র তৈরি করতে হবে। এই ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করার পাশাপাশি বর্জ্য নিষ্কাশন সম্পর্কিত বিভিন্ন ধাপগুলো যেমন- ময়লা সংগ্রহ, পুনরুদ্ধার, পুনরায় ব্যবহার, কম্পোস্টিং এবং ল্যান্ডফিলে নিয়ে ফেলার প্রক্রিয়া আলাদা আলাদা কর্তৃপক্ষের আওতায় রাখতে হবে এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় যেন কোনো প্রকার অনিয়ম বা দুর্নীতি না থাকে সেই উদ্যোগ নিতে হবে।

শহরগুলোর বর্জ্য শতভাগ সংগ্রহ করা নিশ্চিত করতে হবে। সাধারণত সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা শহরের ময়লা সংগ্রহের কাজ করে। তাই শতভাগ বর্জ্য সংগ্রহ নিশ্চিতের জন্য তাদের আরো বেশি সক্রিয় ভ‚মিকা রাখতে হবে। কারণ অসংগৃহীত আবর্জনাই অনেকাংশে শহরের পরিবেশ দূষণ করে। দেশের বর্তমান বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবলের ঘাটতি রয়েছে। এ কাজে অবশ্যই দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল নিয়োগ করতে হবে। বর্জ্য সংগ্রহ নিশ্চিত করার পর এই বর্জ্যগুলো থেকে পচনশীল বর্জ্য ও অপচনশীল বর্জ্য আলাদা করার ব্যবস্থা করতে হবে। বর্জ্য আলাদা করার এই কাজটি দু’ভাবে করা যেতে পারে।

প্রথমত, নাগরিক সচেতনতা তৈরি করার মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে দৈনিক একটি পরিবারে যে পরিমাণ বর্জ্য উৎপন্ন হয় তার মাঝে পচনশীল বর্জ্য ও অপচনশীল বর্জ্য আলাদা ব্যাগে বা ময়লার ঝুড়িতে সংরক্ষণ করার অভ্যাস গড়ে তোলা যেতে পারে। অথবা দ্বিতীয়ত, বর্জ্য যথাযথ সংগ্রহের পরে পচনশীল থেকে অপচনশীলগুলো আলাদা করা যেতে পারে। আলাদা করার পরে পচনশীল বর্জ্যকে কম্পোস্টিং করার লক্ষ্যে কম্পোস্ট উৎপাদনের নির্দিষ্ট যে কেন্দ্র থাকবে সেখানে পাঠাতে হবে। বাংলাদেশের মোট বর্জ্যরে প্রায় ৭০ শতাংশ পচনশীল। বিশেষ প্রক্রিয়ায় এই পচনশীল বর্জ্যকে কম্পোস্টিং করার মাধ্যমে বর্জ্যকে জৈবসারে রূপান্তরিত করা সম্ভব যা কৃষি জমির জন্য খুবই উপকারী এবং এটি ব্যবহারে রাসায়নিক সারের মতো বিরূপ কোনো প্রভাব নেই। অন্য দিকে অপচনশীল যেসব বর্জ্য থাকবে তা থেকে যদি পুনর্ব্যবহার (জবঁংব) করার মতো কিছু থাকে যেমন- বিভিন্ন ধরনের ধাতব পদার্থ, বাক্স, পুরনো জামা, ই-বর্জ্যরে অংশবিশেষ, ব্যাগ ইত্যাদি তবে সেগুলো আলাদা করতে হবে এবং পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করে তোলার মাধ্যমে বাজারে বিক্রি করা যেতে পারে। বিভিন্ন উন্নত দেশেও এমন পুনর্ব্যবহারযোগ্য জিনিসপত্রের দোকান রয়েছে এবং নতুন জিনিসের তুলনায় সাশ্রয়ী ও মান ভালো হওয়ায় এসব পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্যের ভালো চাহিদা দেখা যাচ্ছে। তাই আমাদের দেশের বাজারেও এরকম পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে বর্জ্যরে পরিমাণ কমিয়ে আনা যেতে পারে। বাকি যে অপচনশীল বর্জ্য থাকবে তা থেকে প্লাস্টিক, কাচজাতীয় পদার্থগুলোকে রিসাইকেলিং কেন্দ্রে নিয়ে রিসাইকেল করে ব্যবহারযোগ্য করার ব্যবস্থা করতে হবে।

বাংলাদেশে শহরাঞ্চলে অপচনশীল বর্জ্যরে ৫১ শতাংশ হচ্ছে প্লাস্টিক যার বেশির ভাগই রিসাইকেল না করেই ফেলে দেয়া হয়। প্লাস্টিক পরিবেশের ভারসাম্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। অথচ পরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারলে এই বিপুল পরিমাণ বর্জ্য রিসাইকেলিংয়ের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনায় পরিণত করা সম্ভব। বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহীত বর্জ্যরে উপোরক্ত সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন নিশ্চিত করার পরে যা উচ্ছিষ্ট থাকবে তাই মূলত ল্যান্ডফিলে এনে ফেলার উপযোগী বর্জ্য। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হচ্ছে বর্জ্যকে যথাযথভাবে ল্যান্ডফিলে নিয়ে অপসারণ করা। দেশে পরিকল্পিত ল্যান্ডফিল তৈরি করে সেখানে যথাযথভাবে বর্জ্যগুলোকে নিষ্পত্তি করতে হবে। অথচ আমাদের দেশে বর্জ্য সংগ্রহের পরেই তা নিয়ে সরাসরি ল্যান্ডফিলে ফেলে দেয়া হয়। ফলে দেশে এক দিকে যেমন বর্জ্যরে পরিমাণ বাড়ছে অন্য দিকে বর্জ্য থেকে যে অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়া সম্ভব তা থেকেও দেশ বঞ্চিত হচ্ছে।

আজকের শিশুই আগামীর ভবিষ্যত কাণ্ডারী। তাই এই পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নের পাশাপাশি ছোটবেলা থেকেই শিশুদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। এ শিক্ষা দিতে হবে পরিবার থেকেই। ছোট থেকেই ময়লা-আবর্জনা যথাযথ স্থানে ফেলার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায়ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে। গণমাধ্যমে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে নিয়ে প্রচারের মাধ্যমে শিশুসহ আমাদের সবাইকে সচেতন করে তুলতে হবে।

উন্নত দেশগুলোতে বর্জ্যকে সম্পদের সাথে তুলনা করা হয়। আমাদের দেশেও পরিকল্পিতভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারলে টেকসই উন্নয়নের জন্য বর্জ্যই সম্পদ হয়ে উঠবে। সব দিক বিবেচনা করে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি পরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার মাধ্যমে দূষণমুক্ত, নিরাপদ ও সুস্থ-সুন্দর পরিবেশের বাংলাদেশ নির্মাণ অসম্ভব নয়।

লেখক : শিক্ষার্থী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল
ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019-2023 usbangladesh24.com