আজ ২০২২ সালের প্রথম দিন। জাতীয় জীবনে বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম ও হাতাশার মধ্যে ইংরেজি এই নতুন বছরের যাত্রা হলো শুরু। অন্ধকার যত গভীর হয়; আলোপ্রাপ্তির সময়ও তত নিকটবর্তী হয়। বিগত বছরগুলো একটির পর একটি গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে গেলেও নতুন বছরটি সেই সম্ভাবনার দ্বার কি খুলতে পারবে? বিগত দিনের গ্লানি মুছে উজ্জ্বল দিনের যাত্রা শুরুর প্রত্যাশায় উদগ্রীব পুরো জাতি। যেখানে অনিয়ম বিশৃঙ্খলা ঘুচতে শুরু করবে। মানুষ সুন্দরের নাগাল পাবে। আত্মসমালোচনা করে নতুন উদ্যম নিতে পারলে হতে পারে বছরটি চলতি শতাব্দীতে বাংলাদেশের জন্য শুভযাত্রার পথরেখা।
জাতীয় জীবনে আমাদের সবচেয়ে বড় অবক্ষয় হয়েছে বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে। বিপুল মানুষের জীবনে নেমে এসেছে চরম ভোগান্তি। রাষ্ট্র তাদের ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে পারেনি। ভিন্নমতের প্রতি খড়গ চলছে বছরের পর বছর ধরে। নিপীড়িতরা প্রশাসনিক ব্যবস্থার অনুদার ও উদাসীন আচরণে বঞ্চনার শিকার। ফলে আদালতে বহু মানুষ ভিড় জমিয়েছেন। তবে অনেকেই পাননি ফরিয়াদের জবাব। আবার বহু মানুষ অন্যায় অনিয়ম করে অন্যের অধিকার ভূলুণ্ঠিত করেও বিচারের মুখোমুখি হয়নি। এমন বহু উদাহরণ দেয়া যাবে; যারা আইন ভঙ্গকারী, দুর্নীতিবাজ তারা বুক চিতিয়ে সমাজে চলছে। বিপরীতে অন্যায় না করেও অনেকে আইনের গ্যাঁড়াকলে পড়েছেন। আগত বছরটিতে আমরা আশা করব পুরনো অন্যায় বদলাতে শুরু করবে।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে লুণ্ঠনের নতুন সংস্কৃতি আমরা দেখেছি। অভিনব লুটপাট সবাইকে হতবাক করে দেয়। বিশেষ করে যখন ফাঁস হয়, একেকটি কেলেঙ্কারিতে হাজার কোটি টাকা গায়েব হয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সরকারের অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, টাকার অঙ্কে সেটা খুব বড় নয়। দেখা গেছে, এক ব্যক্তি একাই প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা দেশের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে লোপাট করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। এমন দুর্ভাগ্যজনক ঘটনায় দেশের ভেতরের যে প্রশাসনিক কাঠামো যারা লুটপাটকারীদের বাধা দেবেন, তাদেরই কোনো একটি অংশ এতে সহযোগী হয়েছে। ফলে দুর্বৃত্তরা সহজে জনগণের অর্থ আত্মসাৎ করে নিরাপদে সটকাতে পেরেছে। অন্য দিকে, উন্নয়নের নামে দুর্নীতির চিত্রটি সারা দেশে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। সাথে সরকারি প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির যে নতুন মাত্রা বিগত বছরে দেখা গেছে; তা টেনে ধরতে পারলে নতুন বছরে আর্থিক খাতে ভালো কিছুর শুরু হতে পারে।
বিদায়ী বছরে দেশে সাধারণ মানুষের অন্যতম সঙ্কট ছিল ব্যক্তিগত নিরাপত্তা। সরকারি বাহিনীগুলোর নামে মানুষকে তুলে নিয়ে যাওয়ার মতো ভয়াবহ ঘটনা এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের কোনো একটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নামে নাগরিকদের তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। স্বজনেরা যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তাদের খোঁজ চাইতে যান, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তার কোনো হদিস দিতে পারেনি। স্বজন হারানো মানুষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পেছনে ঘুরে ঘুরে দীর্ঘদিন আপনজনদের না পেয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। নিখোঁজদের কারো কারো লাশ পাওয়া গেলেও অধিকাংশই হারিয়ে গেছেন চিরতরে। দেশে একটি ভীতিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। নাগরিক জীবনের মর্যাদা এতটা ঠুনকো হওয়ার পরও সরকার এসব ব্যাপারে তদন্ত করে রহস্যজনক গুম খুনের সুরাহা করতে আগ্রহী হয়নি। নতুন বছরে সরকার সেই নীতির পরিবর্তন করলে নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা ও মানবাধিকার কিছুটা হলেও নিশ্চিত হতে পারে।
মন্দ-ভালো উভয় প্রবণতা মানুষের স্বভাবজাত। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা এতে ভারসাম্য আনতে পারে। রাষ্ট্র যদি শুভকাজের পৃষ্ঠপোষকতা করে; সে দেশে নিয়মশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়। অরাজকতা কমে আসে। যদি রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে মন্দের আশকারা দেয়া হয়, ঘটে এর ঠিক বিপরীত। আর সীমা অতিক্রম করলে দেখা দেয় চরম বিশৃঙ্খলা। ক্ষমতার উৎস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বড়রা ছোটদের কোণঠাসা করে ফেলে। এ পরিস্থিতিকে বলা হয় মাৎস্যন্যায়। আমাদের দেশের বর্তমান পরস্থিতি অনেকটাই এ পর্যায়ে নেমে এসেছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সবার মতো আমাদের প্রত্যাশা, নতুন বছরের প্রথম দিন থেকেই সবার জীবনে শুভসূচনা হোক। অধঃপাতের যে সীমায় আমরা এসে পৌঁছেছি; এখান থেকে শুরু হোক ভালোর দিকে যাত্রা। আশা করা যায় সংশ্লিষ্টদের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হবে। বিগত এক যুগে আমরা যে অনিয়মের চর্চা করেছি- এ বছরে শুরু হবে নিয়ম ও শৃঙ্খলার চর্চা।
Leave a Reply