কক্সবাজারে স্বামী-সন্তানকে জিম্মি করে পর্যটককে গণধর্ষণের অভিযোগে যে মামলা হয়েছে, তা তদন্ত করতে গিয়ে নানা রকমের তথ্য সামনে আসছে। পুলিশ বলছে, গত বুধবার সকালে নয়, স্বামী-সন্তানসহ ওই নারী কক্সবাজার এসেছেন প্রায় তিন মাস আগে। তারা কক্সবাজারের বিভিন্ন হোটেলে ছিলেন। এ ছাড়া মামলার মূল আসামি আশিক তাদের পূর্বপরিচিত।
এদিকে গতকাল রাত ১০টা পর্যন্ত মামলার ৭ আসামির কেউই গ্রেপ্তার হয়নি। পুলিশ ও র্যাব কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আসামিদের ধরতে তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে পর্যটকদের নিরাপত্তাসহ সার্বিক বিষয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে গতকাল জরুরি সভা হয়েছে।
কক্সবাজারে যখন পর্যটকদের জন্য পা ফেলার জায়গা নেই, যখন হাজার হাজার পর্যটক হোটেল থাকার জায়গা পাচ্ছেন না, ঠিক তখন স্বামী-সন্তানকে জিম্মি করে এক পর্যটককে গণধর্ষণের অভিযোগ ওঠায় দেশজুড়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। মামলার এজাহার অনুযায়ী, ওই নারী গত বুধবার সকালে ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে
স্বামী-সন্তানসহ কক্সবাজার বেড়াতে আসেন। তারা ওঠেন শহরের হলিডে মোড়ের একটি হোটেলে। সেখান থেকে বিকালে যান সৈকতের লাবণী পয়েন্টে। সেখানে অপরিচিত এক যুবকের সঙ্গে তার স্বামীর ধাক্কাধাক্কি হয়। সন্ধ্যার পর পর্যটন গলফ মাঠের সামনে থেকে কয়েক যুবক তার ৮ মাসের সন্তান ও স্বামীকে তুলে নিয়ে যায়। আর তিন যুবক আরেকটি অটোরিকশায় ওই নারীকে তুলে নিয়ে গলফ মাঠের পেছনের নির্জন স্থানে নিয়ে ধর্ষণ করে। ধর্ষণের পর ওই নারীকে নেওয়া হয় হোটেল-মোটেল জোনের ‘জিয়া গেস্ট ইন’ নামের একটি হোটেলে। সেখানে তাকে ঘটনা কাউকে না জানানোর হুমকি দেওয়া হয়। এর পর হোটেলকক্ষের দরজা বাইরে থেকে লাগিয়ে দুর্বৃত্তরা চলে যায়।
মামলায় আশিক, বাবু, ইসরাফিল ইসলাম জয়া ও রিয়াজ উদ্দিন ছোটনসহ ৭ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলা তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ যেসব তথ্য পেয়েছে, সেগুলো অনেক ক্ষেত্রেই এজাহারের সঙ্গে মিলছে না। অভিযোগকারী নারী ও তার স্বামীকে পৃথক জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ অনেক ‘গুরুত্বপূর্ণ’ তথ্য পেয়েছে।
সদর মডেল থানার ওসি শেখ মুনীর উল গীয়াস জানান, মামলার সব কাগজ ট্যুরিস্ট পুলিশকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ট্যুরিস্ট পুলিশের ইন্সপেক্টর মোহাম্মদ রুহুল আমিন মামলাটি তদন্ত করছেন।
ট্যুরিস্ট পুলিশের পুলিশ সুপার মো. জিল্লুর রহমান জানিয়েছেন, দু-একদিনের মধ্যেই বিষয়টি পরিষ্কার করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, ‘ধর্ষণের শিকার হওয়া নারী ও তার স্বামীকে পৃথকভাবে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তাদের কাছ থেকে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে, যেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। ওই নারী তিন মাস ধরে কক্সবাজারে অবস্থান করছেন। তারা অনেক হোটেলে ছিলেন। কী কারণে এসব হোটেলে ছিলেন, কক্সবাজারে তাদের আগমনের কারণ, ব্যয়বহুল একটি শহরে কিভাবে কাটিয়েছেন, তাদের সাথে কার কার যোগাযোগ ছিল- এসব বিষয় সামনে রেখে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।’
জিল্লুর রহমান আরও বলেন, ‘কক্সবাজার সদর আদালতে ওই নারীর জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়েছে। যেহেতু ওই নারী ও তার স্বামীর নিরাপত্তার বিষয় রয়েছে, সে কারণে দুজনকে আমাদের হেফাজতে রাখা হয়েছে। ওই নারী কক্সবাজার সদর মডেল থানায় আরও দুবার অভিযোগ করেছেন গত ৩ মাসে।’
ওই নারীর বরাত দিয়ে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান জানিয়েছেন, ‘কক্সবাজার শহরের পর্যটন গলফ মাঠের সামনে থেকে বুধবার রাতে র্যাব তাকে উদ্ধার করে। এর পর কলাতলীর হোটেল-মোটেল জোনের জিয়া গেস্ট ইন নামের রিসোর্টে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কক্সবাজার আসার পর থেকে ওই দম্পতি ৭টি হোটেলে অবস্থান করেছেন। এর মধ্যে লাইটহাউস পাড়ার ‘আরমান কটেজে’ ছিলেন ২ নভেম্বর থেকে ১৫ নভেম্বর। এর পর সন্তানের চিকিৎসার জন্য ঢাকায় যায় ওই দম্পতি। ৫ দিন ফিরে আবার আরমান কটেজে ওঠেন। সেখানে থাকেন ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
ওই হোটেলের ব্যবস্থাপক মো. হাসান বলেন, ‘কিশোরগঞ্জ সদরের ঠিকানা দিয়ে ওই নারী ও তার স্বামী দৈনিক ১ হাজার টাকা ভাড়ায় আমাদের কটেজে অনেক দিন ছিলেন। বেশির ভাগ সময় তার স্বামী সন্তান নিয়ে হোটেলে থাকতেন। আর ওই নারী বাইরে যেতেন।’
৬ ডিসেম্বর ওই দম্পতি আরমান কটেজের উল্টা দিকের দারউল এহেছান কটেজে ওঠেন। পরের দিন তাদের ওই কটেজ ছেড়ে দিতে বলেন মালিক আলি আকবর। তিনি বলেন, ‘৬ ডিসেম্বর রাত ১০টার দিকে হোটেলের সামনে আশিকের সাথে ওই নারীর স্বামীর কথা কাটাকাটি হয়। বিষয়টি আমার নজরে এলে আমি ওই নারীর স্বামীর কাছে জানতে চাই, কী সমস্যা? কিন্তু তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। এ কারণে আমি তাদের আমার হোটেল ছেড়ে দিতে বলি।’
ওই কটেজ ছেড়ে তারা আরেকটি কটেজে ওঠেন। সেখানে ছিলেন ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ওখান থেকে তারা হলিডে মোড়ের সিল্যান্ড হোটেলে ওঠেন ২২ ডিসেম্বর বেলা ৩টায়। ওইদিন সন্ধ্যা ৬টায় ওই নারীকে হোটেলের সামনে থেকে একটি সিএনজি অটোরিকশায় তুলে দেন আশিক। এর পর সেখান থেকে তাকে মোটেল রোডের সৈকত পোস্ট অফিসের ছেনুয়ারের ঝুপড়ি চায়ের দোকানে নিয়ে যায় আশিক।
চায়ের দোকানের মালিক ছেনুয়ারা বেগম বলেন, ‘আশিক এক নারীকে নিয়ে ২২ ডিসেম্বর রাত ৮টার দিকে আমার এখানে আসেন। এর পর ওই নারীকে দিয়ে তার স্বামীকে ফোন করান। সে সময় ওই নারী তার স্বামীকে মুঠোফোনে বলেন, ‘তুমি নাকি আশিক ভাইয়ের সাথে বেয়াদবি করেছ। তুমি এখানে আসো। আমি আছি, আশিক ভাই তোমাকে কিছু করবে না।’ পরে ওই নারীর স্বামী একটি বাচ্চাকে নিয়ে আমার দোকানে আসে। এর পর আশিক কিছুক্ষণ এখানে অবস্থান করেন। তার পর ওই নারীকে মোটরসাইকেলে নিয়ে চলে যান।’ তিনি আরও বলেন, ‘কয়েকদিন আগে আশিক আমার দোকানের খানিকটা দূরে এক কিশোরকে ছুরির ভয় দেখিয়ে টাকাপয়সা লুট করে নেয়।’
অভিযোগকারী নারী বলেন, ‘আশিক সেখানে আমাকে ধর্ষণ না করলেও তার বন্ধুরা ঝুপড়ি চায়ের দোকানের পেছনে নিয়ে আমাকে ধর্ষণ করে। পরে আমার স্বামী ও সন্তানকে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে আমাকে মোটরসাইকেলে করে জিয়া গেস্ট ইনে নিয়ে আসে। মোটরসাইকেল আশিক চালাচ্ছিল; আর কেউ ছিল না।’
এদিকে জিয়া গেস্ট ইনের পরিচালক রায়হান বলেন, ‘আশিক এবং ওই নারী স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে সাবলীলভাবে হোটেল আসেন। এখানে ওই নারী নিজেকে সাথী হিসেবে পরিচয় দেন। পরে একটি কক্ষে ৪০ মিনিট অবস্থান করেন। তার পর আশিক বেরিয়ে যায়। এর পর আমার হোটেল ম্যানেজার গিয়ে ওই নারীর দরজা খুলে দেয়। তার পর তিনি এখান থেকে চলে যান। এর অনেক পরে ওই নারী ও তার স্বামীসহ র্যাব সদস্যরা আমার হোটেলে আসেন এবং আমার ম্যানেজারকে ধরে নিয়ে যান।’
Leave a Reply