দুই দফা রিমান্ড শেষে নায়িকা শামসুন্নাহার স্মৃতি ওরফে পরীমনি ও তার ম্যানেজারের জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। অন্যদিকে একই রিমান্ড শেষে প্রযোজক রাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার নজরুল ইসলাম রাজ ও তার ম্যানেজার সবুজ আলীরও জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। গতকাল শুক্রবার ঢাকা মহানগর হাকিম ধীমানচন্দ্র ম-ল এ আদেশ দেন।
এদিকে নায়িকা পরীমনিকে গাজীপুরের কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেওয়া হয়েছে। শুক্রবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে প্রিজনভ্যানে করে তাকে কারাগারে নেওয়া হয়। কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলসুপার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আবদুল জলিল বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
কারাসূত্র জানায়, নায়িকা পরীমণিকে কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারের কোয়ারেন্টিন সেন্টারে (রজনীগন্ধা ভবন) রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যেহেতু তিনি ডিভিশনপ্রাপ্ত হননি তাই কোয়ারেন্টিন সময় পার হওয়ার পর তাকে অন্য বিচারধীন সাধারণ বন্দির সঙ্গেই রাখা হবে।
গতকাল শুক্রবার বেলা পৌনে ১২টার দিকে পরিমনি ও তার ম্যানেজার আশরাফুল ইসলাম দিপু এবং রাজ ও তার ম্যানেজারকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে হাজির করা হয়। বেলা ৩টা পর্যন্ত তাদের সিএমএম আদালতের হাজতখানায় রাখার পর আদালতের কাঠগড়ায় ওঠানো হয়।
এদিন পরীমনি ও তার ম্যানেজারের জন্য নতুনভাবে রিমান্ড আবেদন ছিল না। তবে আসামিরা জামিন পেলে তদন্ত বিঘিœত হবে এবং আসামিরা পলাতক হতে পারেন উল্লেখ করে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে কারাগারে আটক রাখা আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক গোলাম মোস্তফা। আবেদনে তিনি আরও উল্লেখ করেন, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে মামলার বিষয়ে আসামিরা বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত দিয়েছেন। মামলার তদন্তের স্বার্থে তা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। মামলার অভিযোগের সঙ্গে তার জড়িত থাকার ব্যাপারে পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। তদন্ত অব্যাহত আছে। মামলার তদন্ত সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তাকে জেলহাজতে আটকে রাখা একান্ত প্রয়োজন।’
তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনের শুনানিকালে পরিমনির জন্য আইনজীবী নীলাঞ্জনা রিফাত সৌরভী ও মজিবুর রহমান আদালতে জামিন আবেদন করে বলেন, পরীমনি ‘ভারটিগো’ এবং ‘প্যানিক অ্যাটাক’-এর রোগী। তিনি দীর্ঘ সময় পুলিশ কাস্টডিতে (হেফাজতে) অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে বিপর্যস্ত ও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি একজন প্রথম সারির চিত্রনায়িকা। ‘ফোর্বস ম্যাগাজিন’ ডিজিটাল তারকা হিসেবে বিশ্বের ১০০ জনের মধ্যে তার নাম রয়েছে। যা বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের জন্য গৌরবজনক। আসামি পরীমনি জেলহাজতে আটক থাকলে চলচ্চিত্রের অঙ্গনের অপূরণীয় ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তা ছাড়া বিভিন্ন কোম্পানি ও চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সঙ্গে পরীমনির শুটিং সংক্রান্ত যে চুক্তি হয়েছে তা ভঙ্গেরও সম্ভাবনা রয়েছে। সম্প্রতি ‘প্রীতিলতা’ নামক একটি সরকারি সিনেমার জন্য ফটোশুট অলরেডি করা হয়েছে। এতদিন রিমান্ডে থাকলেও মামলা সংক্রান্ত জিজ্ঞাসাবাদে কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উদঘাটিত হয়নি। জরুরি চিকিৎসার স্বার্থে তাকে জামিনে মুক্তি দেওয়া আবশ্যক।
রাষ্ট্রপক্ষে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আবদুল্লাহ আবু তদন্ত কর্মকর্তার বক্তব্য তুলে ধরে জামিনের বিরোধিতা করেন। শুনানিতে আবদুল্লাহ আবু বলেন, নায়িকা তো আরও আছে, তাদের বাসায় তো মদ পাওয়া যায়নি। তাদের তো পুলিশ ধরেনি। তাকে কেন গ্রেপ্তার করা হয়েছে? তার বাসায় মদ ছিল, সে জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে গ্রেপ্তার করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে যখন গ্রেপ্তার করতে যায় তখন তিনি আধা ঘণ্টা পর্যন্ত দরজা খোলেননি। এ সময় তার বাসায় থাকা মদের বোতল থেকে মদ ফেলে দিয়ে বোতল খালি করেন। বাসার যে খালি বোতল আছে সেগুলোতে মদ ছিল। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে আদালত জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে পরীমনি ও তার ম্যানেজারকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
পরীমনির জামিন আবেদন নামঞ্জুর হলে আইনজীবী পরীমনিকে কারাগারে ডিভিশন প্রদানের আদেশ চেয়ে একটি আবেদন করে বলেন, তিনি একজন আন্তর্জাতিকমানের নায়িকা। ফোর্বস ম্যাগাজিনে তার নাম এসেছে। সামাজিক অবস্থান বিবেচনায় তাকে কারাগারে ডিভিশনের আদেশ প্রদানের আবেদন জানাচ্ছি।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষে আইনজীবী আবদুল্লাহ আবু বলেন, ডিভিশনের বিষয়টি কারাবিধিতে আছে, কারা কর্তৃপক্ষ কারাবিধি দেখে ব্যবস্থা নিতে পারে। এর পর বিচারক পরিমনির আইনজীবীর কাছে ডিভিশনের বিধান জানতে চান। আইনজীবী বলেন, পরিমনির সামাজিক অবস্থান বিবেচনায় ডিভিশন পারেন। এর পর বিচারক কারাবিধি অনুযায়ী ডিভিশনের বিষয়ে কারা কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দেবেন বলে জানান।
অন্যদিকে রাজ ও তার ম্যানেজারও রিমান্ডে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। যা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তাই মামলার তদন্ত সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তাদের জেলহাজতে আটকে রাখা একান্ত প্রয়োজন।
এ সময় রাজের পক্ষের আইনজীবী এসএম আখতারুজ্জামান হিমেল জামিন চেয়ে শুনানি করেন। অন্যদিকে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আবদুল্লাহ আবু জামিনের বিরোধিতা করেন। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে তাদের জামিন নামঞ্জুর করে আসামিদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
এর আগে গত ৫ আগস্ট পরীমনি ও রাজ এবং তাদের ম্যানেজারদের মাদক মামলায় চার দিন করে ও গত ১০ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় দুই দিন করে রিমান্ডে পাঠান আদালত। তবে গত ১০ আগস্ট আদালত রাজ তার ম্যানেজারের পর্নোগ্রাফি আইনের মামলায় ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তাদের মাদক মামলায় রিমান্ড শেষ হলেও পর্নোগ্রাফি আইনের মামলায় তাদের রিমান্ড এখনো বাকি রয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ৪ আগস্ট বিকাল ৪টার পর পরই বনানীর ১২ নম্বর রোডের পরীমনির বাসায় অভিযান পরিচালনা করে র্যাব। এ সময় ওই বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দামি মদ, মদের বোতলসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্য জব্দ করা হয়। এ ঘটনায় র্যাব ১-এর কর্মকর্তা মো. মজিবর রহমান মাদক আইনে একটি মামলা করেন।
একইদিন রাত ৯টার অভিযানে বনানীর ৭ নম্বর রোডের বাসা থেকে নজরুল ইসলামকে আটক করে র্যাব। তার বাসা থেকেও বিপুল পরিমাণ মাদক জব্দ করা হয়। ওই ঘটনায়ও মাদক আইনে একটি মামলা করা হয়।
পরীমনির মামলায় বলা হয়, পরীমনি এসব মাদকদ্রব্য কবির নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে সংগ্রহ করে বাসায় রাখতেন। মামলায় কবিরের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা উল্লেখ নেই। একই মামলায় আবার র্যাব দাবি করেছে, চিত্রনায়িকা পরীমনিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়, তিনি প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজের কাছ থেকে মাদক সংগ্রহ করতেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের যে ধারায় পরীমনির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে পারলে তার সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদ- হতে পারে।
উল্লেখ্য, গত জুনে রাজধানীর আশুলিয়ায় অবস্থিত বোট ক্লাবের ঘটনায় আলোচনায় আসেন নায়িকা পরীমনি। আশুলিয়ার এ ক্লাবে গভীর রাতে তাকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ আনেন ব্যবসায়ী নাসির ইউ মাহমুদের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে গত ১৪ জুন তিনি ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় নাসির ইউ মাহমুদ ও তার সহযোগী পরিমনির বন্ধু তুহিন সিদ্দিকী অমি গ্রেপ্তার হন এবং সম্প্রতি নাসির উদ্দিন আহমেদ জামিন পেয়েছেন।
এদিকে মাদকসহ গ্রেপ্তার মডেল মরিয়ম আক্তার মৌকে মাদক আইনের মামলায় তৃতীয় দফার দুই দিনের রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর হাকিম আবু সাঈদ এ আসামির জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর এ আদেশ দেন।
এর আগে মৌকে আদালতে হাজির করে তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক প্রবীণ কুমার ঘোষ কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন। শুনানিকালে আসামি পক্ষে ঢাকা বার সভাপতি আবদুল বাতেন জামিনের আবেদন করেন। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে আদালত জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
গত ১ আগস্ট রাতে মৌয়ের মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের বাসায় অভিযান চালিয়ে মদ, ইয়াবাসহ তাকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। পরদিন আদালত তার তিন দিন, গত ৬ আগস্ট আরও তিন দিন এবং সর্বশেষ গত ১০ আগস্ট আরও ২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
মামলায় বলা হয়, জিজ্ঞাসাবাদে মৌ জানায় ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে মাদক সংগ্রহ করতেন তিনি। বাসায় নাচ ও গানের আসর বসিয়ে লোকজন ডেকে এনে অর্থের বিনিময়ে তাদের কাছে মদ, ইয়াবাসহ অন্যান্য নেশাজাতীয় দ্রব্য বিক্রি করে মৌ। আরও ২-৩ জন তার সঙ্গে জড়িত বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানায়।
মৌ একজন নারী মাদক ব্যবসায়ী। সে তার ফ্ল্যাটে সহযোগী মাদক ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের নাইট পার্টির কথা বলে ডেকে এনে মাদক বিক্রি করে যুব সমাজকে ধ্বংসের পথে ধাবিত করছে।
Leave a Reply