২০২০ সালে করোনার প্রাদুর্ভাবের পর থেকে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা যে ভালো নেই, চারপাশে তাকালে সহজেই তা চোখে পড়ে। এটি বুঝতে অর্থনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। সাধারণ মানুষ নিজেদের যাপিত জীবনে তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। বছর দেড়েক ধরে শহর এবং গ্রামাঞ্চলের জনমিতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিবেশের ওপর করোনার অভিঘাত যে দৃশ্যমান পরিবর্তন এনেছে, সেটি এখন স্পষ্ট। সাম্প্রতিক সময়ের যেকোনো জরিপ কিংবা গবেষণার তথ্য-উপাত্তও সেই সাক্ষ্য বহন করছে।
একাধিক গবেষণার ফল, কোভিড-১৯ মহামারীতে গত বছরের এপ্রিল-অক্টোবর সময়কালে অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতায় স্বল্প আয় ও অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত ব্যক্তিরা চাকরি ও উপার্জনের সুযোগ হারিয়েছেন। সেই ধারাবাহিকতায় গত বুধবার প্রকাশিত এক গবেষণার ফল অনুযায়ী, এই সময়ে ৭৭ শতাংশ পরিবারে গড় মাসিক আয় কমেছে। ৩৪ শতাংশ পরিবারের কেউ না কেউ চাকরি অথবা আয়ের সক্ষমতা হারিয়েছেন। দৈনন্দিন খরচ মেটাতে পরিবারগুলো সঞ্চয় ও ধারদেনার ওপর নির্ভরশীল ছিল। ফলে পরিবারগুলোর গড় মাসিক সঞ্চয় ৬২ ভাগ কমে গেছে। ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৩১ শতাংশ।
করোনাকালে বিবিধ পরিস্থিতির শিকার হয়ে যারা দেশের বাইরে থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন, তাদের জীবনযাত্রায় সামগ্রিক প্রভাবের ওপর ওই গবেষণায় বিশেষভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়। তিনটি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে গবেষণাটি পরিচালনা করে। প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে আরো দেখা যায়, জরিপে অংশ নেয়া পরিবারগুলোর ৬১ শতাংশেরই অন্তত একজন সদস্য করোনাকালে চাকরি বা উপার্জনের সুযোগ হারিয়েছেন। আবার বিদেশফেরত বা অভ্যন্তরীণ অভিবাসী যারা গ্রামাঞ্চল বা মফস্বল শহরে ফিরে এসেছেন তাদের প্রায় ৭৭ শতাংশ মনে করেন কাজ বা চাকরি খুঁজে পাওয়া তাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। প্রায় ২৫ শতাংশ ফেরত আসা আন্তর্জাতিক অভিবাসী তাদের অভিবাসন ঋণ পরিশোধ নিয়ে উদ্বিগ্ন। শতকরা ৪৪ ভাগ জানিয়েছেন, তারা কোনো উপার্জনমূলক কাজ পাননি। তাদের মধ্যে কিছু পরিবার সঞ্চয় ভাঙিয়ে বা বিভিন্ন সম্পদ ভাড়া বা বন্ধক দিয়ে খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন। জরিপ করা পরিবারগুলোতে মহামারী চলাকালীন গড়ে মাসিক প্রবাসী আয় ৫৮ শতাংশ কমেছে।
কয়েক মাস আগের আরেক জরিপের ফল, দেশে করোনার কারণে নতুন করে দুই কোটি ৪৫ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমায় চলে এসেছে। সাথে আগের আরো দুই কোটি ৪২ লাখ মানুষ যোগ করলে এই সময়ে দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটি।
যদিও সরকারি তরফ থেকে প্রতিনিয়ত দাবি করা হয়, দেশে ব্যাপক উন্নয়নের কারণে আমাদের অর্থনীতি মজবুত ভিত পেয়েছে। তা সত্ত্বেও এ কথা বলা অসঙ্গত নয় যে, উন্নয়নের সেই সুফল নাগরিক সাধারণের সবার জীবনে সমভাবে অর্থবহ হয়নি। বাস্তবে আমাদের বর্ধিষ্ণু অর্থনীতির সুবিধাভোগী মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি, বাকি সবাই সুবিধাবঞ্চিত। মূলত দেশের বেশির ভাগ মানুষ অর্থাৎ আমজনতা এ থেকে খুব যে উপকৃত হচ্ছেন, সে কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না। বরং রূঢ় বাস্তবতা হলো, দেশে দিন দিন ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বাড়ছে। সাধারণের জীবন এখন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।
সবার মতো আমরাও মনে করি, প্রান্তিক এ জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক নাজুক অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সামাজিক সুরক্ষা দিতে হবে, এ ব্যাপারে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। সেজন্য সরকারের নেয়া সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনতে হবে তাদের। এজন্য এখনই যথাযথ জরিপ করা জরুরি।
Leave a Reply