বইপ্রেমী মানুষের আবেগ ও অনুভূতির জায়গা অমর একুশে গ্রন্থমেলা। বহুল প্রত্যাশিত এই মিলনমেলা শুরু হতে আর বাকি মাত্র ৪ দিন। তাই মেলার দুই প্রাঙ্গণ- সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে চলছে স্টল নির্মাণের ধুম। মেলা সামনে রেখে নিজের বইটি হাতে নিয়ে দেখা, নতুন বইয়ের ঘ্রাণ অনুভব করা ও মানুষের সান্নিধ্য পাওয়ার আবেগ যেমন লেখক-প্রকাশকদের মধ্যে কাজ করছে, তেমনই বৈরী আবহাওয়া অর্থাৎ ঝড়বৃষ্টির মৌসুমের কথা মাথায় রেখে আর্থিক ক্ষতিসহ নানা শঙ্কাও কাজ করছে তাদের মনে।
অমর একুশে গ্রন্থমেলার বয়স অনেক হয়ে গেলেও এবার অনেকগুলো ‘প্রথম’ আলোচনায় আসছে। প্রথমবারের মতো মার্চ-এপ্রিলে বইমেলা হতে যাচ্ছে। করোনা ভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে ১ ফেব্রুয়ারির পরিবর্তে এবার বইমেলা শুরু হবে ১৮ মার্চ। চলবে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত। এ রকম মহামারীর মধ্যে বইমেলা আয়োজনও এই প্রথম। ফলে আনন্দ-উদ্বেগের মিশ্র অনুভূতি নিয়েই চলছে মেলার প্রস্তুতি। সংক্রমণের আশঙ্কায় বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ প্রথমে বইমেলা আয়োজন না করার চিন্তা করেছিল। এতে নাখোশ প্রকাশকদের দেনদরবার করেই সরকারকে আয়োজনে রাজি করাতে হয়েছে। তীব্র গরম আর ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নেওয়াটাও হবে এক নতুন অভিজ্ঞতা।
অন্যদিকে, আর্থিক ক্ষতির শঙ্কায় বেশ কিছু প্রকাশক এবার বইমেলায় অংশ নিচ্ছেন না। করোনাকালেও ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস ও ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখে লাখো মানুষের সমাগম হতে পারে মেলায়। সেখানে স্বাস্থ্যবিধি কতটুকু রক্ষা হবে তা নিয়েও শঙ্কা কাজ করছে অনেকের মধ্যে। তারপরও স্টল নির্মাণের ধুম চলছে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।
এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জনমনের শঙ্কার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা বাংলা একাডেমি করতে পারবে কিনা এ নিয়েও চলছে আলোচনা। থাকছে প্রশ্নও। এ বিষয়ে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ বলেন, করোনা নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনেই বইমেলা হবে। মাস্ক পরা ছাড়া কেউ মেলা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে পারবেন না। বিষয়টি নজরদারিতে আমাদের ভ্রাম্যমাণ টিম থাকবে। মেলার প্রতিটি প্রবেশপথে স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা রাখা হবে। এর পাশাপাশি ঝড়বৃষ্টি থেকে বাঁচতে চারটি আশ্রয়কেন্দ্রও থাকছে।
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেন, যদি এসব মোকাবিলা করতে না পারতাম তা নহলে মেলার আয়োজন করতাম না। তবে মেলা আমরা একা করছি না। মেলায় যুক্ত আছেন আপনারা (সাংবাদিকরা), আছেন প্রকাশকরা। সেই সঙ্গে জনসাধারণের অংশগ্রহণও মেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সবাই যদি সবার জায়গা থেকে সচেতন থাকি তা হলে মেলার কার্যক্রম সুন্দরভাবে পরিচালিত হবে বলে আমি মনে করি। তিনি আরও বলেন, মেলা চলাকালীন বৈরী আবহওয়ার সম্মুখীন হলে দর্শনার্থীরা যেন আশ্রয় নিতে পারে সেজন্য আমরা চারটি আশ্রয়কেন্দ্র করছি। বৃষ্টি বা ঝড় না থাকলে আশ্রয়কেন্দ্রগুলো মোড়ক উন্মোচন ও লেখক আড্ডার স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হবে বলে জানান তিনি।
দেশের অন্যতম প্রকাশনা সংস্থা আগামী প্রকাশনীর কর্ণধার ওসমান গণি বলেন, যেহেতু ঝড়বৃষ্টির সময় এখন, তাই মেলাটি এক মাস ধরে করার প্রয়োজন ছিল না। ব্যক্তিগতভাবে আমি আশাবাদী মানুষ। তারপরও মেলা সার্বিক বিবেচনায় সফল হবে কিনা এটা নিয়ে ভাবছি।
জানা গেছে, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, সূচিপত্র, শ্রাবণ, ট্রু প্রকাশনীসহ বেশ কিছু প্রকাশনা সংস্থা মেলায় অংশ নিচ্ছে না। ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশের অন্যতম স্বত্বাধিকারী কবি আদিত্য অন্তর বলেন, কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে ঝুঁকি নিয়ে মেলায় অংশ নেব না- এটা আমরা নভেম্বরেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আর মার্চ-এপ্রিল তো ঝড় হওয়ার আশঙ্কা আছে। ফলে এ রকম বৈরী পরিবেশে আমরা মেলায় আসতে চাচ্ছি না। এ ছাড়া অন্য কোনো কারণ নেই।
শ্রাবণ প্রকাশনীর কর্ণধার লেখক-ছড়াকার রবীন আহসান বলেন, কলকাতায় যে মেলা হয় তার নাম কলকাতা বইমেলা। জার্মানিতে হয় ফ্রাঙ্কফুট বইমেলা। অর্থাৎ পৃথিবীর অন্যত্র যেসব মেলা হয় তা ওইসব এলাকার নাম অনুসারে। কিন্তু আমাদের মেলাটার চরিত্র ভিন্ন। আমাদের মেলার নাম অমর একুশে গ্রন্থমেলা। এটি শুধু ফেব্রুয়ারিতেই প্রাসঙ্গিক। কোনোভাবেই এই মেলা ফেব্রুয়ারির আগে-পরে হতে পারে না। তা ছাড়া করোনায় আমাদের বেশ কজন লেখক-প্রকাশক মারা গেলেন। এখনো করোনা চলছে। ফলে স্বাস্থ্যবিধি মানা নিয়ে উদ্বেগ তো আছেই। অন্যদিকে বৈরী পরিবেশে মেলা কতটুকু সফল হবে তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
করোনার সংক্রমণ রোধে ভিড় এড়াতে এবার বইমেলা প্রাঙ্গণের পরিসর প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে। গত বছর বইমেলা হয়েছিল সাড়ে সাত লাখ বর্গফুট জায়গাজুড়ে। এবার প্রায় ১৫ লাখ বর্গফুট এলাকাজুড়ে মেলা অনুষ্ঠিত হবে। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন (আইইবি) অংশে নতুন একটি প্রবেশপথ থাকবে। মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অংশ ঘুরে দেখা যায়, এর পূর্বদিকের অংশে আরও অনেকখানি জায়গাজুড়ে স্টল নির্মাণের কাজ চলছে। কাঠামো নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ক্রমেই দৃশ্যমান হতে যাচ্ছে একেকটি স্টল।
বাংলা একাডেমির একটি সূত্র জানায়, এবারের মেলায় ৫৭০টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেবে। সব মিলিয়ে মেলায় স্টলের ইউনিট দাঁড়াবে আট শতাধিক। প্যাভিলিয়ন থাকবে ৩৪টি। সবগুলো প্যাভিলিয়ন এক জায়গায় নির্মাণ করা হচ্ছে।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এবারের বইমেলার থিম ‘হে স্বাধীনতা’। গত কয়েকবারের মতো এবারও মেলার সার্বিক ডিজাইন করেছেন নির্মাতা-স্থপতি এনামুল করিম নির্ঝর। তিনি এবারের থিম ও মেলার ডিজাইন নিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, স্বাধীনতা আমাদের, এ দেশের মানুষের। সেই সর্বজনীন অনুভূতিই এবারের থিম। এটা যেহেতু চিন্তার মেলা, মননের মেলা- সেহেতু স্বাধীনতা স্তম্ভটিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা স্তম্ভ ও পাঁচটি দশককে পাঁচটি আঙ্গিকে উপস্থাপন করা হবে মেলায়। মানুষ যেন সেখানে এসে নিজেই স্বাধীনতাকে উপলব্ধি করে নেয়।
তিনি আরও বলেন, এবার বাস্তবতা অন্যরকম। মেলা এবার ফেব্রুয়ারি নয়, মার্চে হচ্ছে। গরম থাকবে, ঝড়বৃষ্টি হতে পারে। আছে করোনার ভয়। এই বিয়গুলোর সঙ্গে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। তাই এবার অলংকরণের চেয়ে ডিজাইনে মনোযোগ দিয়েছি। কারণ এবার ব্যবস্থাপনা অনেক গুরুত্বপূর্ণ, কাঠামো অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বৃষ্টি হলে মানুষ যেন ছাউনি পায়। ব্যবস্থাপনাগুলো কীভাবে হবে সেটা চিন্তা করে ডিজাইন করা হয়েছে। মানুষ যেন স্বাচ্ছন্দ্যে মেলায় ঘুরতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখা হয়েছে। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন (আইইবি) অংশ দিয়ে মেলায় প্রবেশ করা যাবে। রাখা হয়েছে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থাও।
Leave a Reply