টানা বন্দী জীবনের আজ ২ বছর পার করছেন বিএনপির প্রধান কাণ্ডারি বেগম খালেদা জিয়া। মূল নেত্রীর মুক্তির প্রশ্নে এখন অনেকটাই ক‚লকিনারাহীন বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। আইনি প্রক্রিয়ায় বেগম জিয়ার মুক্তি অনিশ্চিত। রাজপথেও নেই শক্ত আন্দোলন। নেতাকর্মীদের জিজ্ঞাসা, তাহলে তার এই কারাবাস কি আরো দীর্ঘায়িত হবে? নাকি কোনো না কোনো পথে তার মুক্তি প্রক্রিয়ার দ্বার হঠাৎ করে খুলে যাবে। জানা গেছে, বেগম জিয়ার মুক্তি নিয়ে নানা পক্ষের তৎপরতা থেমে নেই। পর্দার অন্তরালে আলোচনা চলছেই, আছে দৌড়ঝাঁপ। কেউ কেউ বলছেন, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই মুক্তি পেতে পারেন খালেদা জিয়া। সে ক্ষেত্রে দুই পক্ষকেই (সরকার ও বিএনপি) একটি ‘উইন উইন’ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে।
গত দুই বছরে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা ‘গুঞ্জন’ ছিল। সর্বশেষ গুঞ্জন উঠে হাসপাতালে সেজবোন সেলিমা ইসলাম অসুস্থ খালেদা জিয়াকে দেখে আসার পর। তার মুক্তির বিষয়ে সর্বশেষ জামিন আবেদন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ফুল বেঞ্চ শুনানি করে খারিজ করে দিলে আইনি পথে মুক্তির পথ বন্ধ হয়ে যায়। এরপরই গত ২৪ জানুয়ারি বিএসএমএমইউতে খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করে সেলিমা ইসলাম বলেছিলেন, তার বোনের মুক্তির বিষয়ে নতুন করে আবেদন করতে পারেন। কিন্তু এ ব্যাপারে এখনো পর্যন্ত কোনো উদ্যোগের খবর পাওয়া যায়নি। গুঞ্জন আছে, খালেদা জিয়ার যেরকম শারীরিক অবস্থা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হতে পারে। অনেক নেতাকর্মী এরকম প্রত্যাশা নিয়ে সময় গুণছে যদি সত্যি হয় এই ‘গুঞ্জন’।
বিভিন্ন সূত্রের খবর অনুযায়ী, আইনি প্রক্রিয়ায় মুক্তি অনিশ্চিত হয়ে গেলেও পর্দার অন্তরালের তৎপরতা থেমে নেই। রাজনৈতিক পক্ষগুলোর বাইরেও একটি পক্ষ এ বিষয়ে সক্রিয় রয়েছেন। ওই পক্ষটি উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে বিদেশ পাঠাতে পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিপত্তি হচ্ছেÑ বেগম জিয়া প্যারোলে মুক্তি নিতে কোনোভাবেই রাজি নন। তার সাথে সাক্ষাৎকালে পরিবারের সদস্যরা প্যারোলের বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে, তিনি তা একাধিকবার সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন। প্যারোলের পরিবর্তে কি হতে পারে? একটি বিশেষ আবেদনের কথা এ ক্ষেত্রে শোনা যাচ্ছে। যার মাধ্যমে বেগম জিয়ার সাজা স্থগিত করে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হতে পারে। এই প্রক্রিয়া কিছু দূর এগিয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্র দাবি করেছে। একটি সূত্রের দাবি অনুযায়ী বেগম জিয়ার মুক্তি ইস্যুতে সম্প্রতি সরকারের শীর্ষপর্যায়ের এক নেতা সংশ্লিষ্ট একজনের সাথে সাক্ষাৎ করে কথা বলেছেন। বেগম জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বাইরে পাঠানোর বিষয়ে ওই সাক্ষাতে কথা হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, সরকারের মূল ফোকাস মুজিববর্ষ উদযাপন। এই বর্ষে নতুন কোনো রাজনৈতিক ঝামেলা তারা চাচ্ছেন না। সেই কারণে কোনো কোনো পক্ষ বেগম জিয়াকে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়াই শ্রেয় মনে করছে। যদিও সরকারের ভেতরে বেগম জিয়ার বিষয়ে কট্টরপন্থাও রয়েছে। তারা এ বিষয়ে নূ্যূনতম কোনো ‘ছাড়’ দিতে রাজি নয়।
বেগম জিয়ার আইনজীবীরা বলছেন, ফৌজদারি কার্যবিধি ৪০১(১) ধারায় সাজা স্থগিত করে খালেদা জিয়া বা যেকোনো নাগরিকের দণ্ড স্থগিত করে জামিন দেয়ার এখতিয়ার সরকারের রয়েছে। সরকার ইচ্ছা করলে এই ধারায় যেকোনো দণ্ডিতের সাজা স্থগিত করে তাকে মুক্তি দিতে পারে। এটা তাদের মানবিক দায়িত্ব।
খালেদা জিয়ার অন্যতম প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন আইনগত প্রক্রিয়ায় কিভাবে খালেদা জিয়ার কারামুক্তি হতে পারে সে বিষয়ে বলেন, আইনি প্রক্রিয়ায় যেখানে দেশে গণতন্ত্র নেই সেখানে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন হয়। তিনি বলেন, আমি প্রথম থেকে বলে আসছি ম্যাডামকে (খালেদা জিয়াকে) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে জেলে নেয়া হয়েছে এবং রাজনৈতিকভাবেই যদি বিএনপি মাঠ উত্তপ্ত করে সরকারকে বাধ্য করতে না পারে তা হলে ম্যাডামের মুক্তি সম্ভব হবে না।
খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ৪০১(১) ধারায় বেগম জিয়ার মুক্তির সুযোগ রয়েছে। সরকার ইচ্ছা করলে যেকোনো দণ্ডিতের সাজা স্থগিত করে তাকে মুক্তি দিতে পারে। এটা সরকারের একক দায়িত্ব এখানে কারো কোনো আবেদন করতে হয় না। আমি আশাকরি মানবিক দায়িত্ব সরকার পালন করবেন। তার সাজা স্থগিত থাকবে, বহাল থাকবে। তিনি যখন সুস্থ হয়ে আসবেন তখন সাজার বিষয়টি আসবে। তা যদি না করেন, এই মুহূর্তে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাকে বের করতে হবে বলে আমি মনে করি।
এ বিষয়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেন, সর্বোচ্চ আদালতে তার জামিন আবেদন খারিজ হওয়ার পর আমরা নতুন করে জামিন আবেদন করার চিন্তা করছি। এ ব্যাপারে আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের সময় আছে, নতুন করে জামিন আবেদন করব। বিএনপির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধি ৪০১(১) ধারায় সরকার যেকোনো সময় খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে পারেন।
২০১৮ সালের আজকের দিনে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজা হওয়ার পর খুব দ্রæত সময়ের মধ্যেই তিনি জামিনে বের হয়ে আসবেন বলে ধারণা করা হলেও তা হয়নি। বরং সাজা আরো বেড়েছে। তার মুক্তির জন্য দলও কার্যকর কোনো আন্দোলন করতে পারেনি। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে খালেদা জিয়াকে বন্দী করে রাখা হয়েছে দলের নেতারা এমন বক্তব্য দেয়ার মধ্যেই প্রতিবাদ সীমাবদ্ধ রেখেছেন। সাদামাটা আন্দোলন, সমঝেতার গুঞ্জন এবং আইনি সব প্রক্রিয়ায় জামিনের চেষ্টা সফল না হওয়ায় বিএনপি নেত্রীর মুক্তি একরকম অনিশ্চিত। সঙ্গত কারণে নেতাকর্মী ও সমর্থকরা হতাশ। এই হতাশা কাটাতে এবং শীর্ষ নেত্রীর মুক্তি নিশ্চিত করতে আন্দোলনই একমাত্র পথ বলে মনে করছে মাঠপর্যায়ের নেতারা। কারাবন্দীর দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে কর্মসূচিও দিয়েছে বিএনপি। সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী পুরান ঢাকার ‘নির্জন’ কারাগারে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে উচ্চ আদালতের নির্দেশে গত বছরের ১ এপ্রিল চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে কেবিন বøকে, যেখানে এখনো তিনি চিকিৎসাধীন আছেন।
খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আজ শনিবার দুপুরে নয়া পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সমাবেশের কর্মসূচি রয়েছে বিএনপির। বিএনপিকে নিয়ে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টও আজ সকাল ১১টায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে প্রতিবাদ সভা করবে। শীর্ষ নেত্রীর কারাবন্দীর বিষয়ে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, খালেদা জিয়াকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে বিচার ব্যবস্থাকে করায়ত্ত করে মিথ্যা ও বানোয়াট মামলায় সাজা দেয়া হয়েছে। এখন তাকে তার সাংবিধানিক যে প্রাপ্য জামিন পাওয়া সেটাও দেয়া হচ্ছে না। বার বার আদালতে গিয়েও কি হয়েছে তা সবাই জানেন, দেখছেন। তিনি বলেন, দেশনেত্রীর মুক্তির জন্য বিএনপি আন্দোলনের মধ্যে আছে।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে থাকা মামলা : খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে পাঁচটি দুর্নীতির মামলাসহ রয়েছে ৩১টি মামলা। দুর্নীতির পাঁচটি মামলা হচ্ছে, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা, নাইকো মামলা, গ্যাটকো মামলা, বড় পুকুরিয়া কয়লা খনি মামলা। এসব মামলা ২০০৭ সালের তৎকালীন ১/১১ এর সেনা সমর্থিত সরকারের আমলে দায়ের করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন। এ ছাড়াও রয়েছে আরো ৩১টি মামলা। এগুলো হচ্ছে- নাশকতা সৃষ্টি, মানহানি, রাষ্ট্রদ্রোহ সংক্রান্ত মামলা। খালেদা জিয়া তার ৩৮ বছরের রাজনৈতিক জীবনে মামলায় সাজা নিয়ে এবারের টানা কারাবাস প্রথম হলেও আরো একবার প্রায় এক বছর তিনি কারাবন্দী ছিলেন। ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তৎকালীন সেনা সমর্থিত তত্ত¡াবধায়ক সরকারের আমলে সংসদ ভবন এলাকায় বিশেষ কারাগারে ছিলেন তিনি। এ ছাড়া আশির দশকে এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৩, ১৯৮৪ ও ১৯৮৭ সালের খালেদা জিয়াকে পুলিশ সেনানিবাসে শহীদ মইনুল সড়কের বাসায় গৃহবন্দী করে রেখেছিল। ১৯৮৭ সালে পূর্বাণী হোটেলে দলীয় নেতাদের সাথে বৈঠক থেকে প্রথম খালেদা জিয়াকে ব্যাপক পুলিশ ঘেরাও করে তাকে আটক করেছিল।
নির্জন নিঃশব্দ ফিরোজা : খালেদা জিয়ার বাসভবনের নাম ফিরোজা। ভাড়া করা এই বাসাটি গুলশান এভিনিউর ৭৯ নম্বর সড়কের প্রথম বাড়িটি। ২০১৮ সালে ৭ ফেব্রæয়ারিতেও নেতাকর্মীতে সরগরম ছিল বাসার সামনের সড়ক। গতকাল শুক্রবার সকালে গিয়ে দেখা যায়, একেবারেই নির্জন, নিঃশব্দ একটি বাসা। প্রধান ফটক বন্ধ। চার নিরাপত্তা কর্মী পালাক্রমে পাহারা দেয় এই শূন্য বাড়িটি। বাসায় গত দুই বছর ধরে কেউই থাকেন না। বাসার সামনে ছোট একটা সবুজ অঙ্গন আছে সেটাও ঠিক আগের মতো রয়েছে, সবুজ প্রাঙ্গণে গাছের শুকনো পাতা পড়ে আছে। দোতলা বাসার সবগুলো দরজা-জানালা বন্ধ। একজন নিরাপত্তা কর্মী জানান, এখন এই বাসায় কেউই থাকেন না। বলতে গেলে একেবারেই শূন্য। জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে ম্যাডামের ছোট ছেলে মরহুম কোকো স্যারের স্ত্রী সিঁথি আপাসহ (শর্মিলা রহমান সিঁথি) তার দুই মেয়ে এসেছিলেন বিদেশ থেকে, এই বাসায় ছিলেন ১২ দিন। গত ৫ ফেব্রæয়ারি তারা চলে গেছে বিদেশে। ওই নিরাপত্তা কর্মী আরো জানান, এই বাসভবনের গ্যাস লাইন ও টেলিফোন লাইন বন্ধ বহুদিন ধরে।
Leave a Reply