ক্রমেই বাড়ছে ভোজ্যতেলের দাম। বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, গত এক বছরে প্রতি লিটার তেলের দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত, যা গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর মধ্যেই আসছে পবিত্র রমজান মাস। তখন তেলের চাহিদা আরও বেড়ে যাবে। তাই বাজার স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন একটি প্রতিবেদন তৈরি করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। এতে ৫ দফা সুপারিশ পেশ করা হয়েছে।
গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে দেশে বাড়তে শুরু করে ভোজ্যতেলের দাম। এখন খুচরা বাজারে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল খোলা ১১২-১১৮ টাকায় এবং পাঁচ লিটারের ক্যান ৬০০-৬৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আমদানিকারক ও মিলমালিকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিনের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশে এর প্রভাব পড়েছে। আগামী এপ্রিলে শুরু হচ্ছে পবিত্র রমজান, যখন আড়াই থেকে তিন লাখ টন তেলের বাড়তি চাহিদা থাকবে। তাই তেলের বাজার স্বাভাবিক রাখতে আমদানি শুল্ক তিন স্তর থেকে এক স্তরে নামিয়ে আনার কথা ভাবছে সরকার। এ লক্ষ্যে ভোজ্যতেল আমদানির ভ্যাট কমানোর প্রস্তাব দিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআরকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তরফে চিঠি দেওয়া হবে বলে জানা গেছে।
সূত্রমতে, ভোজ্যতেলের বাজার স্থিতিশীল করতে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন যে ৫ দফা সুপারিশ পেশ করেছে সেগুলো হলো- ভোজ্যতেলের আমদানি, উৎপাদন, বিপণন ও বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা সহজ করতে কন্ট্রোল অ্যাসেনশিয়াল কমোডিটিস অ্যাক্ট ১৯৫৬-এর অধীনে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক নিয়োগ আদেশ ২০১১ জারি করেছে সরকার। আদেশে ভোজ্যতেলের উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থা পদ্ধতিসমূহ উল্লেখ করা হয়েছে, যা অনুসরণ করা হলে ভোজ্যতেলের সাপ্লাই চেন অধিকতর কার্যকর করা সম্ভব। মিলমালিকদের উৎপাদন ক্ষমতার অতিরিক্ত সাপ্লাই অর্ডার (এসও) ইস্যু না করার কারণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। ভোজ্যতেল বাজারজাতকরণে শতভাগ কনজ্যুমার প্যাকের ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে করপোরেট ক্রেতার জন্য ১০-১৫ লিটারের টিন এবং কম ক্রয়ক্ষমতাসম্পন্ন ক্রেতার জন্য ২৫০-৫০০ মিলি লিটারের পাউস প্যাকের প্রবর্তন করে ভোজ্যতেল বাজারজাত করা যেতে পারে। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের ইস্যুকৃত এসও যে এলাকায় ভোজ্যতেল বিক্রির জন্য ইস্যু করে, সে এলাকা ব্যতীত অন্য এলাকায় যেন সরবরাহ না করা হয়- সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে। মিল গেট কর্তৃক নির্ধারিত মূল্য যেন অন্তত ১০ দিন স্থিতিশীল থাকে, সে বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।
ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, খোলা ভোজ্যতেল সরবরাহের ক্ষেত্রে তেল পরিশোধনকারী মিলসমূহ সরবরাহ আদেশে প্রদত্ত মেয়াদ ১৫ দিন উল্লেখ থাকলেও তা তিন থেকে চার মাস পর্যন্ত গ্রহণ করায় ভিন্ন ভিন্ন মূল্যে এসও বাজারে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। মিলসমূহ তাদের উৎপাদন ক্ষমতার অধিক পরিমাণ সরবরাহ আদেশ ইস্যু করে থাকে, যা মূল্যবৃদ্ধির সময় ভোজ্যতেল সরবরাহের ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করে। এর ফলে দাম বেড়ে যায়।
মিল কর্তৃক সরবরাহকৃত এসও হাত বদলের সুযোগ থাকলেও সেকেন্ডারি বাজারে অতিমুনাফা ও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির শঙ্কা থাকে। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা থাকলে মিলসমূহ পূর্বে ইস্যুকৃত ‘এসও’র মাধ্যমে ভোজ্যতেলের সরবরাহ কমিয়ে নতুন ‘এসও’র মাধ্যমে পণ্য সরবরাহ পরিমাণ বৃদ্ধি করে। এতে করে বাজারে ভোজ্যতেলের মূল্য বেড়ে যায়।
জানা গেছে, গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ভোজ্যতেল আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ছিল। এ ছাড়া উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি প্রদত্ত ছিল। কিন্তু ২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট, আমদানি পর্যায়ে ৫ শতাংশ হারে অগ্রিম কর, উৎপাদন ও মূল্য সংযোজনের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট এবং ব্যবসায়ী পর্যায়ে মূল্য সংযোজনের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট অথবা বিক্রয় মূল্যের ওপর ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট ধার্য করা হয়। ব্যবসায়ীরা ইতোমধ্যে ভ্যাট এক স্তরে নামিয়ে আনার জন্য আবেদন করেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও এনবিআরে একই প্রস্তাব দিতে যাচ্ছে। তদুপরি রমজান মাস সামনে রেখে ভোজ্যতেলের আমদানি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে সরকার।
Leave a Reply