আপনাদের নাকি একটা সুশৃঙ্খল সমাজব্যবস্থা আছে। কথা সত্য?
দেখো, শিক্ষার্থীরা সব সময়ই আমার দিকে কঠিন চোখে তাকায়। দোষ দিয়ে লাভ নেই। পুরো রসায়ন বিষয়টাই অনেকের কাছে রসকষহীন। কারণ বইটি কঠিন কঠিন শব্দে ঠাসা। অথচ রসায়ন অতি সহজ। আমাদের মানে পরমাণুদের ইলেকট্রন ক্রয়-বিক্রয়, বিয়েশাদি, ব্যবসা-বাণিজ্য এগুলোই রসায়ন। আমাদের সমাজব্যবস্থাটা জানলে রসায়ন হয়ে যাবে ডাল-ভাত। এই যে তোমরা কঠিন কঠিন সব শব্দ বলো—ক্যাটায়ন, অ্যানায়ন, রি-অ্যাকশন—এগুলো আমাদের সমাজে বলে ধনীর আয়ন, ঋণীর আয়ন এবং বিয়েশাদি ও ব্যবসা-বাণিজ্য। আমাদেরও আছে নিজস্ব ধর্ম, আচার-ব্যবহার এবং বন্ধন।
বলছেন কী! ক্যাটায়ন-অ্যানায়নকে আপনার ভাষায় বুঝিয়ে বলবেন?
তোমাদের সমাজে যেমন টাকা বড় বস্তু, আমাদের কাছে সেটা হলো ইলেকট্রন। এটাই আমাদের অর্থনীতির মূল শক্তি। আমাদের বিয়ে, ব্যবসা-বাণিজ্য সবই চলে এই ইলেকট্রন দিয়ে। সমাজে যারা ইলেকট্রন দেয়নি বা নেয়নি, তারা হলো নিরপেক্ষ চার্জযুক্ত পরমাণু। এদের ইলেকট্রন ও প্রোটন সংখ্যা সমান। এদের চার্জ শূন্য; কিন্তু যে পরমাণু ইলেকট্রন দিয়ে দেয় কিংবা নিয়ে নেয়, তাকে বলা হয় আয়ন। তোমরা রসায়ন বইয়ে দেখবে ধনাত্মক আয়ন বা ক্যাটায়ন এবং ঋণাত্মক আয়ন বা অ্যানায়নের কথা বলা আছে। পরমাণু সমাজে পরমাণু ইলেকট্রন দান করার পর পরিণত হয় ধনাত্মক আয়ন বা ক্যাটায়ন। আর যদি ইলেকট্রন গ্রহণ করে তবে ঋণাত্মক আয়ন বা অ্যানায়ন হয়। সোডিয়ামের কথাই বলি। প্রত্যেক পরমাণুতেই তার পারমাণবিক সংখ্যার সমান সংখ্যক প্রোটন ও ইলেকট্রন থাকে। সোডিয়ামের পারমাণবিক সংখ্যা ১১। অর্থাৎ সোডিয়ামে প্রোটন আছে ১১টি, ইলেকট্রনও ১১টি। তাই পরমাণু অবস্থায় সোডিয়ামের চার্জ হবে শূন্য, কারণ প্রোটন সংখ্যা ও ইলেকট্রন সংখ্যা যোগ করলে মোট চার্জ শূন্য হয়
[১১+(-১১)=০]। ইলেকট্রনের চার্জ ঋণাত্মক বলে আমরা এর চার্জকে ১১ ধরেছি। এখন যদি সোডিয়াম পরমাণুটি একটি ইলেকট্রন দান করে দেয় তবে একটি ইলেকট্রন কমে তার ঋণাত্মক চার্জ হবে ১০। এখন এর মোট চার্জ হবে ১১+(-১০) বা +১। এ জন্যই সোডিয়ামের আয়নের সংকেত Na+। এই ধনাত্মক বা প্লাস চিহ্ন দিয়ে ধনাত্মক আয়ন বোঝায়। রসায়নের ভাষায় এটিই ক্যাটায়ন বা পজিটিভ আয়ন বা ধনাত্মক আয়ন। ধনীর অর্থ দেওয়ার ক্ষমতা আছে। আর ঋণীর আছে নেওয়ার। সোডিয়ামের ইলেকট্রন দেওয়ার ক্ষমতা আছে। তাই এটি আমাদের সমাজে ধনী আয়ন। আবার এমন কিছু পরমাণু আছে, যারা ইলেকট্রন গ্রহণ করে। যেমন ক্লোরিন। একটি নিরপেক্ষ ক্লোরিন পরমাণুর ইলেকট্রন ও প্রোটন সংখ্যা সমান। এতে দুই ধরনের কণাই আছে ১৭টি করে। ফলে নিরপেক্ষ অবস্থায় এর চার্জ ০। কিন্তু ক্লোরিন যখন ১টি ইলেকট্রন নেয়, তখন এর মোট চার্জ হয় ১৭+(-১৮)= -১। ইলেকট্রন নিয়ে ঋণগ্রস্ত হয় ক্লোরিন। তাই একে আমি বলি ঋণীর আয়ন। এ জন্য ক্লোরিন অ্যানায়নকে Cl- লেখা হয়। আমাদের সমাজে কে ক্যাটায়ন এবং কে অ্যানায়ন তা সহজেই বুঝে ফেলা যায়। ক্যাটায়ন ও অ্যানায়নরা তাদের সঙ্গে চিহ্ন নিয়ে ঘোরে। আবার চার্জ সংখ্যা থেকে বুঝতে পারি কয়টি ইলেকট্রন গৃহীত বা ত্যাগ করা হয়েছে।
আপনাদের বিয়ের ব্যাপারেও ইলেকট্রনের ভূমিকা আছে বললেন।
যারা বিয়ে করেনি তাদের তোমরা অবিবাহিত বলো। আমরা বলি নিরপেক্ষ। কারণ এসব পরমাণু এখনো কারো সঙ্গে ইলেকট্রন দেওয়া-নেওয়া করেনি; কিন্তু ধরো সোডিয়াম মশাই ক্লোরিন বেগমকে বিয়ে করতে যাবে। তোমরা জানো যে সোডিয়াম পরমাণুতে তার সবচেয়ে কাছাকাছি নিষ্ক্রিয় গ্যাস নিয়নের চেয়ে একটি ইলেকট্রন বেশি আছে। এই দুনিয়ার সব পরমাণুই আলসে ঘরানার। তারা সবাই চায় নিষ্ক্রিয় গ্যাসের মতো স্থিতিশীল হতে। রসায়নের জগতে সবচেয়ে স্থিতিশীল বিন্যাস হলো নিষ্ক্রিয় গ্যাসের ইলেকট্রনবিন্যাস। নিষ্ক্রিয় গ্যাস তথা হিলিয়াম, নিয়ন, আর্গন, ক্রিপ্টন, জেনন ও রেডন—এরা এতই নিষ্ক্রিয় যে কারো সঙ্গে সাতেপাঁচে নেই। মানে বিক্রিয়া করে না। তাই নিষ্ক্রিয় গ্যাসের ইলেকট্রনবিন্যাস অর্জন করে সুস্থিত হওয়ার জন্য সোডিয়ামের মন উথালপাথাল করে। সে তার বাড়তি একটি ইলেকট্রন কাউকে দিয়ে দিতে পারলেই শান্তি পায়। আবার ক্লোরিন বেগমের কথা যদি চিন্তা করো, তবে দেখবে যে তার ইলেকট্রন সংখ্যা ১৭। তার কাছাকাছি নিষ্ক্রিয় গ্যাসে আর্গনের ইলেকট্রনবিন্যাস অর্জনের জন্য ক্লোরিনের দরকার একটি মাত্র ইলেকট্রন। তার মানে সোডিয়াম যদি একটি ইলেকট্রন দিতে পারে আর ক্লোরিন যদি সেটা নিতে পারে তবে দুজনই খুশি। এ জন্যই তাদের দুজনের এত মিল। রাসায়নিক বন্ধন হতে কোনো সমস্যাই হয় না। সোডিয়াম আর ক্লোরিন মিলে তৈরি হয় সোডিয়াম ক্লোরাইড বা খাবার লবণ।
ব্যবসা-বাণিজ্যের কথাও বলেছিলেন। সেটা কিভাবে?
আমরা শেয়ার ব্যবসা পছন্দ করি। ধরো, এক হাইড্রোজেন ভাই আরেক হাইড্রোজেন ভাইয়ের সঙ্গে ব্যবসা করবে। আগেই বলেছি পরমাণুরা স্থিতিশীল হতে চায়। সারা দিন উড়নচণ্ডীর মতো ঘুরতে কে চায় বলো? তো স্বাভাবিকভাবেই হাইড্রোজেন ভাইয়েরাও শুধু শুধু তাদের ইলেকট্রন নিয়ে না ঘুরে সেগুলোকে লাভজনক কাজে বিনিয়োগ করবে বলে ঠিক করে। তাই দুই হাইড্রোজেন পরমাণু চায় তাদের সবচেয়ে কাছাকাছি নিষ্ক্রিয় গ্যাস হিলিয়ামের ইলেকট্রনবিন্যাস অর্জন করতে। হাইড্রোজেনের ইলেকট্রন সংখ্যা ১ আর হিলিয়ামের ২। এখন প্রত্যেক হাইড্রোজেন ভাইকে হিলিয়ামের মতো স্থিতিশীল হওয়ার জন্য দরকার আরেকটি মাত্র ইলেকট্রন। যেহেতু তাদের প্রত্যেকের একটি করে ইলেকট্রন আছে, তাই তারা দুজন বুদ্ধি করে ঠিক করে তাদের একের ইলেকট্রন অন্যজন নিজের মনে করে ব্যবহার করতে পারবে। তার মানে প্রত্যেক হাইড্রোজেন ভাইয়েরই দুটি করে ইলেকট্রন হলো। কারণ এক ভাইয়ের ইলেকট্রনের ওপর আরেক ভাইয়ের সম্পূর্ণ দাবি আছে। এভাবেই দুই হাইড্রোজেন ভাইয়ের ইলেকট্রন শেয়ারে হয়ে যায় হাইড্রোজেন গ্যাস। এটিও এক প্রকারের রাসায়নিক বন্ধন।
শুনে মনে হচ্ছে আপনারা বেশ ভালো দাতা-গ্রহীতা, দম্পতি, এমনকি ব্যবসায়ী!
আমরা প্রকৃতপক্ষেই অনেক ভালো দাতা-গ্রহীতা। তবে এর আবার প্রকারভেদ আছে। ব্যবসাও হয় নানা রকমের। যার কারণে আমাদের বন্ধনগুলো ভিন্ন ভিন্ন। বইয়ের ভাষায় তোমরা বলো আয়নিক বন্ধন, সমযোজী বন্ধন, সন্নিবেশ সমযোজী বন্ধন, হাইড্রোজেন বন্ধন, ভ্যান্ডার ওয়ালস বন্ধন ইত্যাদি। আমাদের মধ্যে আছে ধাতব ধর্ম, অধাতব ধর্ম, সমযোজী ধর্ম, আয়নিক ধর্ম।
এসব বন্ধন আর ধর্ম সম্পর্কে জানাবেন?
না, আজ আর না। খিদে পেয়েছে। একটা বিয়ের দাওয়াত পড়েছে। আমাকে আবার প্রভাবক হিসেবে থাকতে হবে। এসব বিষয়ে পরের পর্বে আবার আলাপ হবে। আপাতত একটা টিপস দিই—রসায়ন বইটি পড়ার সময় সব কিছু কল্পনা করে নেবে, বিশেষ করে বিক্রিয়াগুলো। কারণ মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলে গেছেন ‘কল্পনা জ্ঞানের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ’।
একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, উৎপাদন ও বিপণন বিষয়ের নমুনা প্রশ্ন ও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা
Leave a Reply