মাদারীপুরের স্থানীয় নির্বাচনের এক প্রার্থী সেখানকার পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গাড়িতে তুলে ঢাকায় নিয়ে আসার অভিযোগ তোলার দুদিন পর এখন নিজেই বলছেন, এ নিয়ে আর ‘কথা বলতে চান না তিনি।’
অভিযোগে বলা হয়েছিল, মাদারীপুরের কালকিনিতে আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদের একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী মশিউর রহমানকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সাথে সাক্ষাৎ করাতে গাড়িতে তুলে ঢাকায় নিয়ে আসেন জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুব হাসান।
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুব হাসান এ অভিযোগ অস্বীকার করছেন।
পুলিশের গাড়িতে যাবার পর মশিউর রহমান নিখোঁজ হয়েছেন বলে মাদারীপুরে গুজব ছড়ায় – ব্যাপারটি সংঘর্ষ ও মামলা পর্যন্ত গড়ায়।
অভিযোগটি মশিউর রহমান নিজেই তুলেছিলেন – যা স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এর পর পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের প্রসঙ্গটি আবারও সামনে চলে আসে।
কিন্তু এখন রহমান – যিনি কালকিনি উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি – বলছেন, তিনি ‘এক ধরনের আশঙ্কা থেকে’ বিষয়টি আর পুনরায় উল্লেখ করতে চান না।
কী বলছে এই দুই পক্ষ?
অভিযোগকারী স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী মশিউর রহমানের সাথে যখন টেলিফোনে কথা হচ্ছিল, তখন তিনি পুলিশের বিরুদ্ধে আনা তার অভিযোগ নিয়ে সরাসরি আর কথা বলতে চাননি।
ওই দিনের ঘটনা সম্পর্কে তিনি নিজেই কিছুটা ভিন্ন ভাষায় কথা বলছিলেন।
তিনি বলেন, ‘ওই দিনের ঘটনা নিশ্চয়ই আপনি বিভিন্ন চ্যানেলের মাধ্যমে জেনেছেন। ওইটা পুনরায় বলতে চাচ্ছি না। ১৪ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন। আমি ব্যক্তিগতভাবে নিজে অনুমান করছি যে সরকার দলীয় প্রভাব ভোটার ও আমার ওপর পড়বে। নির্বাচন খুব নিকটে। পুলিশেরা সাহায্য কিন্তু আমারও লাগবে।’
এর আগে স্থানীয় গণমাধ্যমে তারই বরাত দিয়ে খবর বের হয়েছিল যে শনিবার তাকে জেলার পুলিশ সুপার গাড়িতে করে ঢাকায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন।
বিবিসি বাংলাকে তিনি অবশ্য বলেছেন, বর্তমানে সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তাকে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে বলেছেন।
তবে পুলিশের গাড়িতে যাওয়ার ব্যাপারে তিনি কিছুটা ভাষ্য পরিবর্তন করে বলছেন, তিনি নিজে স্বেচ্ছায় গিয়েছিলেন।
তিনি বলেছেন, ‘আমি পুলিশ সুপারের সাথে আইন শৃঙ্খলা বিষয়ে কথা বলতে গিয়েছিলাম। আমি যে কোনভাবেই ঢাকায় গিয়েছি। এর মধ্যে আসলে পুলিশের ভূমিকা ছিল। সেটা আমি অস্বীকার করবো না।’
মশিউর রহমানকে জেলার পুলিশ সুপারের গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর তিনি নিখোঁজ হয়েছেন এমন অভিযোগ ওঠার পর বিষয়টি সংঘর্ষ ও মামলা পর্যন্ত গড়িয়েছে।
গত শনিবার সন্ধ্যায় তার সমর্থকরা থানা ঘেরাও করেছিলেন, সেখানে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুব হাসানের সাথে কথা হলে তিনিও স্বীকার করেন তার গাড়িতে করেই গিয়েছিলেন মশিউর রহমান, তবে স্বেচ্ছায়।
হাসান বলেছেন, ‘তিনি আমাদের কাছে সহযোগিতা চেয়েছিলেন। আমরা তাকে সেই সহযোগিতা করছি। তিনি নিখোঁজ হলে পরিবারের সাথে কিভাবে ফোনে যোগাযোগ করলেন? থানায় যখন তার লোকজন জড়ো হয় তখন ওসির ফোনে সে ফোন করে এবং লাউড স্পিকারে সবাইকে তার কথা শুনাই। এরপর কিন্তু তার লোকজন চলে যায়।’
পুলিশের উপরে রাজনৈতিক প্রভাব?
তবে এখন প্রশ্ন উঠছে স্ব-ইচ্ছায় হলেও পুলিশের গাড়িতে করে তার ঢাকায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের কাছে যাওয়ার কেন দরকার পড়লো? সে প্রসঙ্গে মশিউর রহমান এবং পুলিশ সুপার কারো কাছেই ঠিক পরিষ্কার জবাব মেলেনি।
পুলিশের ভূমিকা এখানে ঠিক কী সেটিও পরিষ্কার নয় তাই সে নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
মানবাধিকার কর্মী নুর খান লিটন বলছেন, ‘বাংলাদেশে পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের অভিযোগ নতুন নয়। ক্ষমতাসীন দল তাদের কাজের জন্য পুলিশকে ব্যবহার করছে। কিন্তু বিষয়টি এমন একটা ভয়াবহ অবস্থায় গেছে যে এখন শুধু নির্বাচনের দিন না, প্রার্থিতা প্রত্যাহারে চাপ দেবার ক্ষেত্রেও পুলিশকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়া হচ্ছে।’
তিনি বলছেন, ‘যখন কাউকে আপনি নিজের স্বার্থে অন্যায়, অবৈধভাবে কাজে লাগান তখন সে স্বাভাবিকভাবেই কিছু সুযোগ সুবিধা আদায় করে নেবে বা কিছু নিয়মবহির্ভূত কাজ করবে।’
সাধারণ সম্পাদক ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য মেলেনি
এ অভিযোগ এবং পুলিশের ভূমিকা আসলে মাদারীপুরে কী ছিল – সে নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের মন্তব্য নেয়ার চেষ্টা করা হয় বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে কিন্তু তাদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে আইন ও বিচার বিষয়ে সংসদীয় কমিটির প্রধান আব্দুল মতিন খসরু বলছেন, বাংলাদেশে গত বেশ কিছু দিন যাবৎ পুলিশ বাহিনীতে সংস্কারের নানা ধরনের চেষ্টা চলছে।
তিনি বলছেন, ‘আমাদের দেশে এই অভিযোগটা আছে যে যারা যখন ক্ষমতায় তখন পুলিশকে তাদের কথা-মতো চলতে হবে। গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধেও মাঝে মাঝে এই অভিযোগ ওঠে।’
‘পুলিশকে দলীয়ভাবে ব্যবহার করলে সেটা বুমেরাং হয়ে উঠতে পারে। ক্ষমতায় না থাকলে তখন এই পুলিশই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়। এজন্য পুলিশকে প্রচলিত আইন ও সংবিধান অনুযায়ী চলার যে শপথ তারা নিয়েছে – সেই অনুযায়ী কাজ করতে দেয়া উচিৎ।’
তবে পুলিশকে রাজনৈতিক কারণে ব্যবহারের অভিযোগ থেকে দুরে থাকতে পারছে না ক্ষমতাসীন দল। পুলিশের বিরুদ্ধেও নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েই যাচ্ছে।
সূত্র : বিবিসি
Leave a Reply