বাংলাদেশের উন্নয়ন যেন অনেক দেশের কাছেই রোল মডেল। সেটিকে সামনে রেখে সাজাচ্ছে তাদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। গতকাল সোমবারও কলকাতার সবচেয়ে জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকায় উঠে আসে সেই প্রসঙ্গ।
‘ঠাকুরঘরে’ শিরোনামে উপসম্পাদকীয়তে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রশংসার পাশাপাশি সমালোচনা করা হয়েছে ভারতীয় বিভিন্ন পলিসির। বিভিন্ন খাতের তুলনামূলক পরিসংখ্যান উল্লেখ করে প্রতিবেশী দুই দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের পার্থক্য তুলে ধরা ছাড়াও বাংলাদেশের সঙ্গে সমানতালে এগোতে ভারত সরকারের
কী করা উচিত, তা নিয়েও নিজস্ব মত জানিয়েছে পত্রিকাটি।
উপসম্পাদকীয়ের শুরুতেই ১৯৭২ সালে কলকাতায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের কথা উল্লেখ করা হয়। বলা হয়েছে- নবজাত দেশের নতুন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান যখন ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতার মাটিতে অবতরণ করে বক্তৃতা শুরু করেন, ততক্ষণে সারা মহানগরই কলরোল-উচ্ছ্বসিত ময়দানে পরিণত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু সেদিন কলকাতার বুকে দাঁড়িয়ে শুধু উদাত্ত কণ্ঠে বিজয়বার্তা ঘোষণা করেননি, বিপন্ন এবং নিঃস্ব একটি নবজাত রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাঙালির শুভেচ্ছাও প্রার্থনা করেছিলেন।
নিজ দেশের সঙ্গে তুলনা করে ভারতীয় পত্রিকাটি বলেছে, আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের ২০২০ সালের হিসাব- জনপ্রতি জিডিপির দিক দিয়ে বাংলাদেশ ভারতকে পেছনে ফেলেছে। করোনাপূর্ব সময়েই দুই দেশ এই অবস্থানে এসেছিল। অতঃপর কোভিড-১৯ ভারতীয় অর্থনীতিকে বাংলাদেশের অর্থনীতির চেয়ে বেশি বিপন্ন করেছে। যেহেতু যে কোনো যাত্রারই চরিত্র নির্ধারিত হয় তার সূচনাবিন্দুর ওপর নির্ভর করে : ১৯৭২ সালে ভারত যে অবস্থায় ছিল, নতুন বাংলাদেশ (যাকে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হেনরি কিসিঞ্জার ‘বাসকেট কেস’ বলেছিলেন) যেখানে ছিল, তা মাথায় রাখলেই বোঝা যায়, কে কতটা এগিয়েছে বা পিছিয়েছে। এতে আরও বলা হয়, সেদিনের সদ্যজাত ক্ষুদ্র দেশ এখন মহাগৌরবে উপমহাদেশীয় অঞ্চলের মুখোজ্জ্বল করতে ব্যস্ত। বাংলাদেশের উন্নতি দেখে এই উপমহাদেশের অন্য দেশ- এমনকি তথাকথিত আঞ্চলিক মহাশক্তিরাও আজ ইর্ষান্বিত। ঢাকার বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার এখন ইসলামাবাদের তিনগুণ। পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানকে সুইডেন বানাবেন বললে উপদেষ্টারা বলেন- আগে বাংলাদেশের সমকক্ষ হোন।
বেশ কিছু ক্ষেত্রে ভারতের তুলনায় বাংলাদেশ এগিয়ে যাওয়ায় ভারতীয় প্রশাসনের সমালোচনা করে উপসম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে- আইএমএফের হিসাব আন্তর্জাতিক নজরে আসার সঙ্গে সঙ্গে সক্রিয় ও উদ্বিগ্ন বিজেপি আইটি সেল বোঝাতে শুরু করেছে, কেন বাংলাদেশ ও ভারতের এই তুলনা; আসলে বাস্তবের যথার্থ প্রতিফলন নয়; আইটি সেলের যুক্তিতর্কের ধরনের সঙ্গে পরিচিতরাই বুঝবেন, কী ধরনের মারপ্যাঁচ এই বক্তব্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্প সেক্টরই তাকে করোনা-সংকটে বাঁচিয়েছে, এমন যুক্তিও সেই মারপ্যাঁচে জায়গা পেয়েছে- যদিও বোঝা কঠিন, ভারতকে সেই শিল্পে বা সমস্তরের কোনো শিল্পে মনোনিবেশ করতে কে কবে বাধা দিয়েছিল।
আনন্দবাজারের ভাষ্য- উন্নয়ন বোঝার জন্য জিডিপিই একমাত্র হিসাবের খাতা নয়, মানুষের মৌলিক চাহিদা ও জীবনমানের পরিস্থিতিও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সূচক- এমন কথা অমর্ত্য সেনের মতো অর্থনীতিবিদরা বারবার বলেছেন। দেখিয়েছেন কীভাবে যে ভারত একসময় মানব উন্নয়ন সূচকে উপমহাদেশীয় তালিকার একেবারে ওপরের দিকে ছিল, সে ক্রমেই তালিকার নিচের দিকে জায়গা নিয়েছে। ২০২০ সালের শেষে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের নাগরিকদের গড় আয়ু তিন বছর বেশি, শিশুমৃত্যুর হার ভারতের চেয়ে কম (হাজারে ভারত ২৮, বাংলাদেশে ২৫), সাক্ষরতায় দুই দেশ পাশাপাশি, শহর-জনসংখ্যার হারে বাংলাদেশ ৩৭ শতাংশ ও ভারত ৩৪ শতাংশ এবং নারী কর্মসক্ষমতার দিক দিয়ে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে (ভারত ২০ শতাংশ, বাংলাদেশ ৩৬ শতাংশ)। ফলে কে কোন দিকে অনুপ্রবেশ করবে, এখন সেটিই প্রশ্ন।
বাংলাদেশের সঙ্গে সমানতালে ভারতকে এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে পত্রিকাটি বলেছে- এসব ‘দায়িত্ব’ দিল্লির বর্তমান শাসক দলকেই নিতে হবে, এমনটি নয়। যদিও গত কয়েক বছরে পরিস্থিতি উপর্যুপরি খারাপ হয়েছে। কিন্তু বর্তমান শাসকের ‘ঠাকুরঘরে কে’ ভাবটিই সাক্ষাৎ প্রমাণ, তারা নিজেরাই নিজেদের ‘অপরাধ’র ভাগিদার ভাবে। অথচ বাংলাদেশের সমৃদ্ধির মতো ঘটনাকে আইটি সেলের অপপ্রচারের হাতে ছেড়ে না দিয়ে দিল্লির উচিত ছিলÑ অর্থনীতিবিদ ও সমাজতাত্ত্বিকদের সাহায্য নিয়ে সেই দেশ থেকে কিছু শিক্ষাগ্রহণ করা।
Leave a Reply