হলমার্ক গ্রুপ কর্তৃক সোনালী ব্যাংকের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার ঋণ দুর্নীতির ১১ মামলার বিচার শেষ হবে কবে? এর উত্তর জানা নেই। আট বছর আগে করা এসব মামলার বিচারকাজ পাঁচ বছর আগে শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত কোনো মামলাই রায়ের পর্যায়ে পৌঁছেনি। আসামি ও সাক্ষীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় এবং একই আদালতে অন্যান্য মামলার বিচার কার্যক্রম চলায় মামলাগুলোর বিচারিক কার্যক্রম এগোচ্ছে না, মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এই ১১ মামলার বিচার কবে শেষ হতে পারে, সে সম্পর্কেও ধারনা করতে পারছেন না তারা।
এদিকে কারাগারে নারীসঙ্গের অভিযোগে অভিযুক্ত হলমার্কের জেনারেল ম্যানেজার তুষার আহমেদই শুধু নন, এ গ্রুপের চেয়ারম্যান, এমডিসহ অন্য কর্মকর্তাদের দেখে বোঝার উপায় নেই তারা আসামি। জানা গেছে, কারাগারে তারা বেশ আরাম আয়েশেই আছেন। আর যখন আদালতে যান হাজিরা দিতে, তারা যে আসামি, দেখে তা বোঝার উপায় নেই। বরং মনে হয় ভিভিআইপি।
আমাদের সময়ের অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১২ সাল থেকে বন্দি হলমার্কের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা কারাগার থেকে আদালতে আসা-যাওয়া করেন মাইক্রোবাসে; পথে পরানো হয় না হাতকড়া; দাঁড়াতে হয় না কাঠগড়ায়। গতকাল রবিবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে হলমার্ক গ্রুপের ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি) তানভীর মাহমুদকে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত ভবনের পঞ্চমতলায় ঢাকার এক নম্বর বিশেষ জজ আদালতে স্ট্রেচারে করে ওঠানো হয়।
পুলিশ সদস্যরা সেই স্ট্রেচার ঠেলে ঠেলে আদালত কক্ষের ভেতর পর্যন্ত তাকে পৌঁছে দেন। আদালত কক্ষে প্রবেশের পর দেখা গেল, কারও সাহায্য ছাড়াই স্ট্রেচার থেকে উঠে আদালতে আইনজীবীদের বসার বেঞ্চিতে বসেন তানভীর। পরিপাটি বেশবাস, দুই হাতের ৮ আঙুলে হীরা ও স্বর্ণের ১০টি আংটি।
আগে থেকেই মামলাগুলোর ২ নম্বর আসামি হলমার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান তানভীরের স্ত্রী জেসমিন ইসলাম একই বেঞ্চিতে ছেলেসহ বসা ছিলেন। তারও কিছু সময় আগে তানভীরের ভায়রা কারাগারে নারীসঙ্গের অভিযোগে অভিযুক্ত তুষারসহ অন্য আসামিদের একই আদালতে হাজির করা হয়। তুষারের বেশবাসও বেশ লেফাফাদুরস্ত। দেখে বোঝার উপায় নেই যে, তিনি কোনো মামলার আসামি। বিচারক এজলাসে ওঠার আগে তাকে কখনো আদালতে আইনজীবীদের বসার পেছনের বেঞ্চিতে আবার কখনো সামনের বেঞ্চিতে বসতে দেখা গেল।
বিচারক ১১টা ৪৫ মিনিটে এজলাসে ওঠেন। তিনি এজলাসে ওঠার পর বেঞ্চিতে বসা জেসমিনকে দেখা গেল দাঁড়িয়ে সম্মান জানাতে। তবে তার পাশেই তানভীর দাঁড়াননি, ঠায় বসে ছিলেন। ছেলেকে দুজনের মাঝখানে বসিয়ে আদালত চলা অবস্থায় সারাক্ষণই নিজেদের মধ্যে কথা বলতে দেখা গেল তানভীর ও জেসমিনকে।
আদালতের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা পাওয়া সম্পর্কে একটি মামলায় দুদকের প্রসিকিউটর মীর আহম্মেদ আব্দুস সালাম বলেন, প্রিজনভ্যানের পরিবর্তে মাইক্রোবাসে আনা-নেওয়ার বিষয়ে আদালতের আদেশ আছে, যা মহানগর দায়রা জজ আদালত ২০১৩ সালের দিকে অসুস্থতার জন্য দিয়েছিলেন। এখনো ওই আদেশ বহাল আছে। তাই তাদের মাইক্রোবাসে আনা-নেওয়া হয়। আর কাঠগড়ায় না দাঁড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, অসুস্থতার কথা বলে আইনজীবী তাদের বসার অনুমতি নেন।
এদিকে আসামি তানভীর ইসলাম ও তার স্ত্রী জেসমিন ইসলামসহ অন্য আসামিদের মধ্যে এমন কোনো লক্ষণ দেখা গেল না যাতে মনে হতে পারে তারা কোনো প্রকারের অসুস্থ। এ সম্পর্কে মহানগর দায়রা জজ আদালতের ওসি (হাজত) মাইনুল ইসলাম বলেন, আদালতের আদেশ যত দিন থাকবে, তত দিন আসামিরা সেভাবেই আসবে। এখানে আমাদের কিছু করার নেই।
মামলাগুলোর নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, মামলাগুলোর মধ্যে একটিতে সর্বোচ্চ ৪৬ সাক্ষীর সাক্ষ্য সম্পন্ন হয়েছে। অন্য মামলাগুলোয় ১৯ থেকে ২৬ জন করে সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। মামলাগুলোর মধ্যে অস্তিত্বহীন ম্যাক্স স্পিনিং মিলসের নামে প্রায় ৫২৬ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া একটি মামলার চার্জশিটে ৮১ জন সাক্ষী। এ মামলায় আদালত ৪৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন করেছেন। মামলাগুলোর চার্জশিটে ৭১ থেকে ৮১ জন করে সাক্ষী রয়েছে।
এ সম্পর্কে দুদকের প্রসিকিউটর বলেন, যে আদালতে মামলাগুলোর বিচার চলছে, সে আদালত শুধু এসব মামলার বিচারই করেন না। অন্যান্য মামলার বিচারও করেন। তাই মামলাগুলোর সাক্ষ্যগ্রহণের দিনও এক থেকে দুই মাস পর পর হয়। কিছু মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও আছে। আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত নিষ্পত্তির। তবে প্রথম দিকে আসামি পক্ষের বিভিন্ন অজুহাতের কারণে বিচার বিলম্বিত হয়েছিল। এখন দ্রুত করার চেষ্টা চলছে।
হলমার্কের ১১ মামলায় আসামি ২৫ জন। প্রতিষ্ঠানটির এমডি তানভীর মাহমুদ, জেনারেল ম্যানেজার তুষার আহমেদ, সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের জিএম মীর মহিদুর রহমান, উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) মো. সফিজউদ্দিন আহমেদ, ডিএমডি মাইনুল হক (বর্তমানে ওএসডি) ও এজিএম মো. কামরুল হোসেন খান (সাময়িক বরখাস্ত) কারাগারে রয়েছেন। আর জামিনে রয়েছেন হলমার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম, ব্যাংকের দুই উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) শেখ আলতাফ হোসেন (সাময়িক বরখাস্ত) এবং সাভারের হেমায়েতপুরের তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জামালউদ্দিন সরকার।
হলমার্কের মামলায় পলাতক আসামিদের মধ্যে রয়েছে- গ্রুপটির সহযোগী প্রতিষ্ঠান অ্যাপারেল এন্টারপ্রাইজের মালিক শহিদুল ইসলাম, স্টার স্পিনিং মিলসের মালিক আবদুল বাছির, টি অ্যান্ড ব্রাদার্সের পরিচালক তসলিম হাসান, ম্যাক্স স্পিনিং মিলসের মালিক মীর জাকারিয়া, সেঞ্চুরি ইন্টারন্যাশনালের মালিক মো. জিয়াউর রহমান, আনোয়ারা স্পিনিং মিলসের মালিক মো. জাহাঙ্গীর আলম, প্যারাগন গ্রুপের এমডি সাইফুল ইসলাম রাজা, নকশী নিটের এমডি মো. আবদুল মালেক, সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের জিএম ননী গোপাল নাথ (বর্তমানে ওএসডি), প্রধান কার্যালয়ের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন কবির, এজিএম এজাজ আহম্মেদ, সহকারী উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. সাইফুল হাসান, নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল মতিন ও সোনালী ব্যাংক ধানমন্ডি শাখার বর্তমান জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুন্নেসা মেরি।
২০১২ সালের ৪ অক্টোবর রাজধানীর রমনা থানায় হলমার্কের তানভীর মাহমুদসহ ২৭ জনের বিরুদ্ধে ১১টি মামলা করে দুদক। ২০১৩ সালের ১৫ সেপ্টম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়। পরে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জগঠনের মাধ্যমে বিচার শুরু করেন আদালত।
Leave a Reply