রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে ওয়ার্কিং কমিটির দীর্ঘ প্রতীক্ষিত বৈঠক মিয়ানমারের পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে স্থগিত হয়ে গেছে।
ইউএনবিকে ফোনে এক কূটনীতিক বলেন, ‘হ্যাঁ, মিয়ানমারের বর্তমান অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির কারণে এটি স্থগিত হয়ে গেছে।’
তিনি জানান, মিয়ানমারে নতুন অন্তর্বর্তী সরকার পুরোপুরি সচল হওয়ার পরই ডিজি-পর্যায়ের আলোচনার নতুন তারিখ নির্ধারণ করা হবে।
বৈঠকটি আজ বৃহস্পতিবার হওয়ার কথা ছিল।
বুধবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন জানান, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের পরিকল্পনা নিয়ে বাংলাদেশ আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী।
তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ১৯৭৮ এবং ১৯৯২ সালে মিয়ানমার সামরিক সরকারের অধীনে নিজ নাগরিকদের ফিরিয়ে নিয়েছিল। ‘আমরা প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে চাই। প্রক্রিয়াটি অব্যাহত রাখা উচিত যেমন আমরা ১৯৭৮ এবং ১৯৯২ সালে প্রত্যাবাসন দেখেছি- এবার কেন নয়? এটি মিয়ানমারের জন্য একটি সুযোগ। তাদের এই সুবিধা নেয়া উচিত।’
এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সব যোগাযোগের চ্যানেল বন্ধ হওয়ায় তারা এই মুহূর্তে মিয়ানমারের অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে যোগাযোগ করতে পারছেন না।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে যৌথ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক ভার্চুয়ালি হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, তিনি এখনো এ বিষয়ে নিশ্চিত নন। ‘কর্মকর্তারা এটি নিয়ে কাজ করছেন।’
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সম্প্রতি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে দিয়ে দেশের নিয়ন্ত্রণ নেয়। এ ঘটনায় প্রতিবেশী দেশটিতে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং সাংবিধানিক ব্যবস্থা বহাল থাকবে এবং দেশটির সাথে ঢাকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে বাংলাদেশ।
সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ‘আমরা মিয়ানমারের সাথে পারস্পরিক সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে অবিচল রয়েছি এবং বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছা, নিরাপদ এবং স্থায়ী প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের সাথে কাজ করে যাচ্ছি। আমরা আশা করি যে এই প্রক্রিয়াগুলো অব্যাহত থাকবে।’
বাংলাদেশ দৃঢ়ভাবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও তার বিকাশে বিশ্বাসী উল্লেখ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং সাংবিধানিক ব্যবস্থা সমুন্নত থাকবে বলে আশা ব্যক্ত করেছে।
বাংলাদেশ মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের নিন্দা করেছে কী না এমন প্রশ্নের জবাবে ড. মোমেন বলেন, সামরিক বাহিনী কয়েক দশক ধরে মিয়ানমারে শাসন করছে এবং অনেক দেশ কেবল নিন্দা করেই তাদের কাজ শেষ করে। ‘আমরা বলেছি আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী এবং আমাদের বার্তা দৃঢ়ভাবে পৌঁছে দেয়া হয়েছে।’
বাংলাদেশ মিয়ানমারে নতুন সরকারকে স্বাগত জানিয়েছে কী না এমন প্রশ্নের জবাবে মোমেন বলেন, ‘আমরা তাদের স্বাগত জানাইনি তবে আমরা তাদের পরামর্শ দিয়েছি তারা যেন তাদের দেশে গণতান্ত্রিক নীতি ফিরিয়ে আনে।’
তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অং সান সু চির মুক্তি দাবি করিনি। বরং রোহিঙ্গারাও হয়ত দাবি করবেন সুচিকেও কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঠানো হোক।’
ড. মোমেন বলেন, মিয়ানমারে যখন একটি নির্বাচিত এবং গণতান্ত্রিক সরকার ছিল তখন রোহিঙ্গাদের ওপর নির্মম নির্যাতন করা হয়েছিল এবং কেউ তা মেনে নিতে পারে না।
জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে চীনের ভূমিকার বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ জাতিসঙ্ঘসহ সব দেশে যোগাযোগ করেছে এবং বিষয়টি আন্তর্জাতিক আদালতে গেছে।
তিনি বলেন, সবাই মুখে কথা দিয়েছে তবে চীন এগিয়ে এসেছিল। ‘আমরা চীনের নীতিতে হস্তক্ষেপ করতে পারি না, আমরা চীনের ওপর আমাদের আস্থা রেখেছি।’
ড. মোমেন বলেন, কিছু দেশ মিয়ানমারের পরিবর্তিত পরিস্থিতির মধ্যে আরো রোহিঙ্গা আসতে পারে বলে আশঙ্কা করছে কিন্তু বাংলাদেশ তার সীমান্তকে সুরক্ষিত রেখেছে। ‘অতীতে আমাদের জনগণ রোহিঙ্গাদের স্বাগত জানিয়েছিল। এখন, তারা আর স্বাগত জানানোর মানসিকতায় নেই।’
মঙ্গলবার পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, বাংলাদেশ এখনো মিয়ানমারের সামরিক নেতৃত্বাধীন নতুন সরকারের সাথে কথা না বললেও চীন সরকার মিয়ানমারের মধ্যে আলোচনার মধ্যস্থতা করায় চীনের সাথে যোগাযোগ করছে।
তিনি বলেন, তারা মহাপরিচালক পর্যায়ের পূর্ব নির্ধারিত যৌথ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকের বিষয়ে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে মতামত পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন।
মাসুদ মোমেন জানান, মিয়ানমারের সাথে ৪ ফেব্রুয়ারি তাদের আলোচনার অগ্রাধিকার ছিল এবং চীন এ বিষয়ে খোঁজ-খবর নিচ্ছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মিয়ানমারের সাথে ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক করতে এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্পর্কিত অবশিষ্ট সম্মত রোডম্যাপটি অনুসরণ করতে চায়। ‘আমরা এটি চীনা পক্ষকে জানিয়েছি।’
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের মিয়ানমার সফরকে উল্লেখ করে এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, কূটনীতি প্রত্যেকে এবং প্রতিটি পর্যায়ের সাথে অব্যাহত থাকতে পারে।
তিনি বলেন, মিয়ানমারে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলে বাংলাদেশ তাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করবে।
এর আগে বাংলাদেশের সাথে ২০১৭ সালে সম্পাদিত দ্বিপক্ষীয় চুক্তির ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করতে মিয়ানমার অঙ্গীকারাবদ্ধ বলে দেশটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, যাচাই বাছাইয়ের জন্য আট লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গার একটি তালিকা মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করেছে বাংলাদেশ।
‘কিন্তু মিয়ানমার মাত্র ৪২ হাজার মানুষের তথ্য যাচাই করেছে। এ বিষয়ে তাদের গুরুত্বের অভাব রয়েছে,’ বলেন তিনি।
ড. মোমেন বলেন, বাংলাদেশ যথাযথভাবে তার দায়িত্ব পালন করলেও মিয়ানমার তা করছে না।
তবে প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। কারণ ১৯৭৮ এবং ১৯৯২ সালে নিজ নাগরিকদের ফিরিয়ে নিয়েছিল মিয়ানমার।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন : ‘আস্থার অভাব’
প্রায় তিন বছর আগে মিয়ামারের সেনারা রোহিঙ্গাদের টার্গেট করে ‘হত্যা ও ধর্ষণ’ চালিয়েছিল এবং রোহিঙ্গা গ্রামগুলো পুড়িয়ে দিয়েছিল। জাতিসঙ্ঘ, রিফিউজি ইন্টারন্যাশনাল, ইউনাটেড স্টেটস হলোকাস্ট মেমোরিয়াল মিউজিয়াম, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর এবং আরো অনেকেই এ বিষয়টি দেখিয়েছে।
সে সময় আট লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা ‘সহিংস গণহত্যা’ থেকে বাঁচতে পালিয়ে এসেছিল এবং বাংলাদেশ এখন প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে জায়গা দিয়েছে।
রোহিঙ্গা সঙ্কটের স্থায়ী সমাধানের জন্য বাংলাদেশ একাধিক উপায়ে- দ্বিপক্ষীয়, বহুপক্ষীয়, ত্রিপক্ষীয় এবং বিচার ব্যবস্থা মাধ্যমে চেষ্টা করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর প্রত্যাবাসন চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। ২০১৮ সালের ১৬ জানুায়ারি ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ সম্পর্কিত একটি চুক্তিতেও স্বাক্ষর করে ঢাকা-নেপিদো, যা রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে সহায়ক হবে বলে মনে করা হয়েছিল।
মিয়ানমার সরকারের প্রতি রোহিঙ্গাদের আস্থার অভাবের কারণে ২০১৮ সালের নভেম্বরে এবং ২০১৯ সালের আগস্টে দুইবার প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
সূত্র : ইউএনবি
Leave a Reply