আমরা সাধারণত মানুষের জীবনে দু’টি জগতের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানি। প্রথমত, ইহকাল তথা দুনিয়ার জগৎ ও পরকাল তথা মৃত্যুর পরের জগৎ। তবে আধুনিক যুগে ভার্চুয়াল জগৎ নামে তৃতীয় একটি জগৎ তৈরি হয়েছে। বর্তমান বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষ ভার্চুয়াল জগতের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ভার্চুয়াল জগতের প্রভাবে ইহকাল ও পরকাল এই দুই জগৎকে আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি। ভার্চুয়াল জগৎ আমাদের জীবনযাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্র গ্রাস করে নিয়েছে। আমাদের প্রতি দিনের শুরু থেকে শেষ এই ভার্চুয়াল জগৎ ঘিরে আবর্তিত হয়। আধুনিক প্রযুক্তি আমাদের কাজগুলো যেমন সহজ করে দিয়েছে, তেমনি পারিবারিক দায়িত্ব, সামাজিক দায়বদ্ধতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, সম্প্রীতি, ভালোবাসাকে কেমন জানি ফ্যাকাসে করে দিয়েছে।
ভার্চুয়াল ল্যাটিন শব্দ যা ভার্চু থেকে এসেছে। ভার্চুয়াল শব্দের বাংলা আভিধানিক অর্থ ‘কার্যসিদ্ধ’ বা ‘কার্যকর ক্ষমতাসম্পন্ন’। ভার্চুয়াল বলতে বোঝায় এমন কিছু যা অনুভবে আছে কিন্তু বাস্তবে নেই। ‘ফলত বটে, কিন্তু বাহ্যত নয় এমন’, বলা যায়, এটি এমন কিছু যার বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই। ভার্চুয়াল জগৎ হচ্ছে এমন এক জগৎ যেখানে মানুষে মানুষে সংযোগ ঘটে কম্পিউটার, মোবাইল তথা যন্ত্রের সহযোগিতায়। মূলত ইন্টারনেটভিত্তিক জগৎকে ভার্চুয়াল জগৎ বলা হয়। ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড বা ভার্চুয়াল জগৎ পরিভাষাটি প্রথমবার ব্যবহার করেন উইলিয়াম গিবসন। তিনি হচ্ছেন সায়েন্স ফিকশনের বিখ্যাত লেখক। মানুষে মানুষে যে যোগাযোগ ও লেনদেন তা বাস্তব জগতের বিপরীতে বিশ্বজনীন এবং এখানে একজন ব্যক্তি পরিচয় গোপন রাখতে পারে। এই জগতের নির্দিষ্ট সীমা-পরিসীমা নেই। রাত-দিনের কোনো বিভাজন নেই। সময়ের কোনো নির্দিষ্টতা নেই। ভার্চুয়াল জগতের সুবাদে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যোগাযোগ স্থাপন হচ্ছে নিমিষেই; যা অতীতে অকল্পনীয় ছিল। ভার্চুয়াল জগতের কল্যাণে তা সহজ ও সম্ভব হয়েছে। এ জগৎ মানুষের অনেক কাজ যেমন সহজ করেছে, তেমনি কিছু সঙ্কট সৃষ্টি করেছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যেমগুলো মানুষের বাস্তব জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। ইন্টারনেট নির্ভরতার কারণে আচার-আচরণ, অভ্যাস, চলাফেরায় এসেছে পরিবর্তন। এ জগতে অবাধে চলাফেরার সুবাদে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতাও বেড়েছে। বিশেষ করে একে অপরের নামে কুৎসা রটনা করার যেন উর্বর ভূমিতে পরিণত হয়েছে ভার্চুয়াল জগতের সামাজিক মাধ্যমগুলো। ভার্চুয়াল জগতে বিচরণের নিয়মনীতি না থাকায় শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই হয়রানির শিকার হচ্ছে। প্রতিনিয়ত সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে অগণিত নারী। অনেকেই অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার মতো ভুল পথ বেছে নিচ্ছে। ভার্চুয়াল জগতে অবাধে চলাফেরা অনেক সময় নতুন প্রজন্মকে নৈতিকতা ও মূল্যবোধহীন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলছে; যা সমাজের জন্য অশনি সঙ্কেত।
ভার্চুয়াল জগতের মানুষ বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। এ জগতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব বয়সী মানুষের বিচরণ। ইদানীং ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে কথিত ধর্ম প্রচারক ও কিছু নাস্তিকের পদচারণা বেড়েছে। সেই সাথে কিছু বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ পবিত্র ধর্মকে অপবিত্র করছে। তারা কোনো অশ্লীল ভিডিও বা লেখা নিয়ে কমেন্ট করে ধর্ম প্রচারের চেষ্টা করছে। আবার কিছু লোক আছে যারা এন্টি ইসলাম তথা ধর্মবিদ্বেষী। এদের কাজ বিভিন্ন উসকানিমূলক পোস্ট বা কমেন্ট করা। কিছু মানুষ আছে, যারা শুধু কমেন্ট বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করে। অধিকার আদায়ের কোনো আন্দোলনে সংগ্রামে রাজপথে তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। একধরনের কথিত বাম প্রগতিশীল লোকজন এই জগতে পাওয়া যায়, যারা আগের দলের মতোই পোস্ট ও কমেন্টে বিপ্লব সাধনে ব্যস্ত। পরিস্থিতি দেখে এমন মনে হয়, যেন তারা ভার্চুয়াল জগতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেই ছাড়বে। এই জগতে পাবেন কিছু বুদ্ধিজীবী, সুশীলসমাজ যারা ইহজগতের চেয়ে ভার্চুয়াল জগৎকে সুশীল করার দায়িত্ব নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন। আপনি আরো পাবেন কথিত ফেসবুক ঈমানদার, ইউটিউব ধর্মপ্রচারক, কমেন্ট জিহাদি, কবিসাহিত্যিক, গায়ক, নায়ক, প্রেমিক, প্রতারকসহ বিভিন্ন রঙ-বেরঙের মানুষ।
ভার্চুয়াল জগতের অন্যতম আকর্ষণ হলো নারী। এ জগতে নারীদের বিচরণ বিপুল হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিছু নারী অর্থের লোভে এ জগতের মাধ্যমে বিভিন্ন অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছে, যা সত্যি আশঙ্কাজনক। যুবসমাজকে ধ্বংস করার জন্য ওয়েব সিরিজ, টিকটক, ভিগো এবং নাম না জানা আরো নানা সাইটে নারীদের নগ্ন বা অর্ধনগ্ন হয়ে শরীর প্রদর্শনীর প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। ভার্চুয়াল জগতে নারীদের ভোগের বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। যার কুফল হিসাবে নারীর প্রতি অসদাচরণ, সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ভার্চুয়াল জগতের গুজব দুনিয়ার জগতে কী পরিমাণ প্রভাব ফেলে তা আমাদের সবার জানা। কে বা কারা যেন কোথা থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘোষণা করল, দেশে লবণের সঙ্কট দেখা দেবে। অমনি তথ্যের সত্যতা যাচাই না করেই শুরু হলো মূর্খ জনতার লবণ কেনার হিড়িক। এটি একটি ছোট্ট উদাহরণমাত্র। এ রকম হাজারো গুজবের ইতিহাস আছে আমাদের দেশের। গুজব রটানোর অন্যতম প্লাটফর্মে পরিণত হয়েছে এই তৃতীয় জগৎ। ভার্চুয়াল জগতের কারণে আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক স্বাভাবিক সম্পর্কগুলোর মধ্যে চির ধরেছে। একটা সময় পাড়া-গাওয়ের সব বয়সী বন্ধুরা মিলে একসাথে আড্ডা দিত। সেই সময়গুলো ছিল পরস্পরের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধ, ভালোবাসা, মায়ামমতায় ভরপুর। কথিত আধুনিকতার ছোঁয়ায় সেই অটুট বন্ধন প্রায় ছিন্ন হওয়ার পথে। এখন একসাথে পাঁচজন বন্ধু থাকলে কেউ কারো সাথে কথা বলে না। সবাই নিজ নিজ মোবাইল ফোনে তৃতীয় জগতে ডুব দিয়ে থাকে; যে কারণে বন্ধুত্বের সম্পর্কগুলো আগের মতো অটুট নেই। খুবই ঠুনকো ঝুটঝামেলায় বন্ধুত্বের মতো পবিত্র সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
তবে এত হতাশার গল্পের মধ্যেও ভার্চুয়াল জগৎ এক অপার সম্ভাবনার নাম, যদি সঠিক কাজে এ জগৎটির ব্যবহার করা যায়। ভার্চুয়াল জগতের মাধ্যমে কেউ যেন বিপথগামী না হয় সে বিষয়ে পরিবারকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
ভার্চুয়াল জগতের বাইরেও আপনার সন্তান কী কী করছে, কার সাথে মিশছে সেই বিষয়ে খোঁজখবর রাখতে হবে। সবার আগে আমাদের শিক্ষিত সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। এই জগতের ভালো-মন্দ দিকগুলো সবার মধ্যে প্রচার করতে হবে। ভার্চুয়াল জগৎ হোক অপরাধ, প্রতারকমুক্ত এবং এই জগতের কল্যাণে মানুষ সর্বদা উপকৃত হোক- সেটিই সবার প্রত্যাশা।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়,
Leave a Reply