বিশ্বের ক্ষমতাধর ১০০ নারীর ২০২০ সালের তালিকা যুক্তরাষ্ট্রের ফোবর্স সাময়িকী গত ৮ ডিসেম্বর প্রকাশ করেছে। তাতে টানা দশম বারের মতো শীর্ষে রয়েছেন জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল। ব্যবসা, মানবসেবা, গণমাধ্যম ও রাজনীতিতে সেসব নারী নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রেখেছেন তাদের নিয়ে প্রস্তুত করা হয়েছে এই তালিকা। বিশ্বের ক্ষমতাধর ১০০ নারীর মধ্যে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ৩৯তম স্থান দেয়ায় ফোবর্সকে ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি তাঁকেও অভিনন্দন জানাচ্ছি। অবস্থান ১০ ধাপ পিছিয়ে যাওয়ার জন্য ভোটাররা আশাহত হয়েছেন। ফোবর্সের তালিকায় উল্লেখ করা হয় যে, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনি দীর্ঘ সময় ধরে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে আছেন। বর্তমানে চতুর্থ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। চতুর্থ দফা ক্ষমতায় আসার ক্ষেত্রে তার দল আওয়ামী লীগ সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮ আসনে (প্রকৃত সংখ্যা ২৯২) জয় পায়। এ নিয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো তিনি প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি খাদ্যনিরাপত্তা, শিক্ষায় প্রবেশাধিকার ও স্বাস্থ্যসেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দিচ্ছেন। বাংলাদেশে একটি দৃঢ় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।’ (প্রথম আলো)।
মানবসেবায় কৃতিত্বকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হলে তার অবস্থান ২৯তমতেই অটুট থাকত বলে দেশের জনগণ মনে করে। হয়তো মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত ১২ লাখ রোহিঙ্গা যদি মুসলমান না হয়ে অন্য কোনো ধর্মাবলম্বী হতেন, তাহলে ক্ষমতাধর ১০০ নারীর তালিকায় তার অবস্থান এক নম্বরে থাকত এবং তিনি শান্তির জন্যও নোবেল পুরস্কার পেতেন বলে জনগণ মনে করে। রাজনীতি, ক্ষমতায় থাকার রেকর্ড ও দৃঢ় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তার যে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার বিষয় বিবেচনা করা হয়েছে তাতে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারা একমত কি? গত এক বছরে বিশ্বের ১০ জন নারী আমাদের প্রধানমন্ত্রীর তুলনায় বেশি কৃতিত্ব প্রদর্শন করায়, না তার এক বছরের কর্মকাণ্ডের নিরিখে নতুন তালিকা, তা ফোবর্সের প্রতিবেদন পড়ে বোঝার কোনো উপায় নেই।
আওয়ামী লীগ ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ‘ভাঙ্গাচোরা’ বিএনপির কাছে পরাজিত হয়ে ১৯৯৬ সাল থেকে যে চারটি নির্বাচনে জয়ী হয়েছে তার দু’টিতে জয়ের জন্য যা করেছিল এবং বাকি দু’টিতে ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করে কিভাবে বিশ্বরেকর্ড স্থাপন করেছে এবং তাতে জনগণ ও ভোটারদের কী ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, তা দেখা যাক।
১৯৯১ সালের নির্বাচনকে সূক্ষ্ম কারচুপির বলে আখ্যায়িত করে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয় নিশ্চিত করতে ১৯৯৪ সালের মার্চ থেকে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সব দলকে জোটবদ্ধ করে সংসদ বর্জনপূর্বক হরতাল শুরু করে দিলে আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ মীমাংসার জন্য কমনওয়েলথের মহাসচিব তার দূত হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক গভর্নর জেনারেল স্যার স্টিফেনকে ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন। তিনি এসে মাসব্যাপী আলাপ-আলোচনা করে দুই বড় দল থেকে পাঁচজন করে ১০ সদস্যের মন্ত্রিসভা নিয়ে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর অধীনে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের প্রস্তাব দিলে সেটা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ, জাপা, জামায়াত, ওয়ার্কার্স পার্টি ও বিডিপির ১৪৭ জন এমপি ১৯৯৪ সালে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে হাইকোর্টে রিট করার মাধ্যমে পদত্যাগপত্র গ্রহণে স্পিকারকে বাধ্য করে ১৭৩ দিন হরতাল পালনের পর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিদ্রোহ ঘোষণা করায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মতো, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে জয়ী বেগম জিয়ার সরকারের পতন ঘটিয়ে ৩০/০৩/১৯৯৬ বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করে ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনের আগেই নিজেদের জয় নিশ্চিত করা হয়েছিল। কোয়ালিশন সরকার গঠন করে ২১ বছর পর ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছিল।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে জনগণ আওয়ামী লীগকে জয়ী করলে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনে জয়ের ও ক্ষমতায় থাকার যে বিশ্ব রেকর্ড স্থাপিত হতো তা ইন্দোনেশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট সুহার্তো, মালদ্বীপের মামুন আবদুল গাইয়ুম, মিসরের হোসনি মোবারক ও উত্তর কোরিয়ার কিম জং উনের রেকর্ডকে ছাড়িয়ে যেত। ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করতে না পারায় ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে বিএনপির মহাসচিবসহ ৩৫-৪০ জন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও প্রভাবশালী এমপি ১০০ থেকে ২০০০ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিলেন। ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করলে তারা নির্বাচিত হতেন। আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল চেয়ে করা রিটের নিষ্পত্তি করতে না পারায়, ২০০১ সালের নির্বাচনকালীন সরকারে তাদের নিয়োগকৃত প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান প্রধান উপদেষ্টা ও তাদের নিয়োগকৃত সাবেক সিএসপি আবু সাঈদ সিইসি থাকলেও নির্বাচনটা ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের মতো হওয়ায় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জাপা পরাজিত হয়েছিল। নির্বাচনে ‘স্থূল’ কারচুপির অভিযোগ এনে ফলাফল বাতিলের জন্য রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। তিনি এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করায় তাকে ও প্রধান উপদেষ্টা এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার- এই তিনজন বেঈমান বলে আখ্যায়িত করে তাদের ১৭৩ দিন হরতালের আন্দোলনের ফসল তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের বীজ বপন করেছিল আওয়ামী লীগ ও জাপা এবং একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী, সুশীলসমাজ তাতে সমর্থন যুগিয়েছিলেন।
২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি প্রস্তাবিত নবম সংসদ নির্বাচনে ১৪ দলের ১৬০টি থেকে ১৭০টি আসনে জয় নিশ্চিত থাকলে সম্ভবত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের জন্য প্রয়োজনীয় ২০০টি আসনে জয় নিশ্চিত করতে শেষ তারিখে সব মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেয়ায় বেগম জিয়ার সাতটি আসনসহ ৩০টি আসনে সরকার পক্ষ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন (২০১৪ সালের মতো ১৫৪টি নয়)। ওই নির্বাচনকে একতরফা আখ্যায়িত করে, রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন ক্ষমতায় থাকলে চারদলীয় জোট পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসবে এই ভয় দেখিয়ে ওই এলিট গোষ্ঠীসহ আওয়ামী লীগের পক্ষে মেরুকরণ ঘটিয়ে বাইরের গোপন সমর্থনে সেনাপ্রধান ও নবম ডিভিশনের জিওসি ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দুই বছরের জন্য ক্ষমতাসীন হন ভারতের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী পরে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির পরামর্শ মোতাবেক মঈন ২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ১৪ দলকে ২৬৫টি আসন নিশ্চিত করার পর মঈনকে বিডিআর বিদ্রোহের দায় কাঁধে নিয়ে বিদায় নিতে হয়।
১৯৯৬-০১ শাসনামলে ১৯৯৪ সালে আন্দোলনের সহযোগী আইনজীবীদের ২০ জনকে হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। ২০০৯-১০ সালে তাদের মধ্য থেকে চারজনকে আপিল বিভাগে পদোন্নতি দিয়ে, বিএনপি সরকারের বিচারপতিদের চাকরিকাল দুই বছর বৃদ্ধির সুযোগ গ্রহণ করে বিচারপতি খাইরুল হককে ১০ মাসের জন্য প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হয়েছিল। তিনি অবসরে যাওয়ার ১০ দিন আগে কাস্টিং ভোটের ৪-৩ সংখ্যাগরিষ্ঠতার রায়ে ১১/০৫/২০১১ তারিখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিধান অবৈধ ঘোষণা করেন। ১০ বছরের জন্য আইন কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছেন তিনি, যার মেয়াদ ২০২৩ সাল পর্যন্ত। পক্ষে রায় দানকারী বাকি তিনজনও পর্যায়ক্রমে প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন, যার সর্বশেষ জন ছিলেন পদত্যাগকারী প্রধান বিচারপতি সিনহা। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার বৈধ বলে রায়দানকারী তিনজনের কেউ প্রধান বিচারপতি হননি। ওই রায় অনুযায়ী ৩০/০৬/২০১১ তারিখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের মাধ্যমে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সফল করতে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ঢাকায় এসে প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপ করে জনগণের ভোটাধিকারহারা হওয়ার নির্বাচনের ‘উদ্বোধন করেছিলেন’।
ভারতের কোনো রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর নাই। এ কারণে পশ্চিমবঙ্গের বিধান সভার নির্বাচনে ১৯৭৭ সাল থেকে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন কোনো দল জয়ী হতে পারেনি। বাংলাদেশে এটা সম্ভব হয়েছিল অনেকের প্রতিবাদ না জানানোর কারণে। আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ২৪ বছর সংগ্রাম এবং ১৯৭১ সালে ৯ মাসব্যাপী সশস্ত্র যুদ্ধ করে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন বাংলাদেশ করেছিলাম কি ‘খবরদারির নির্বাচন’ দেখতে? ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকা পড়শিকে গোপনে সহায়তা করতে হয়েছিল। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় তারা প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। কারণ এর প্রতিবাদ ভোটের বাক্সে ফেলার কোনো সুযোগ ছিল না।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের আহ্বানে সরকারি কর্মচারীরা বিদ্রোহ করার কারণে এবং ২০০৭ সালে ১১ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সেনাপ্রধান ও তার সহযোগী দু’টি দলকে যথাক্রমে ক্ষমতায় ও বিরোধী দলের আসনে বসিয়ে দেয়ায় প্রজাতন্ত্রের সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ দল বিশেষের কর্মকর্তা-কর্মচারীতে রূপান্তরিত হয় প্রশাসন, পুলিশ, পোলিং অফিসার ও পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিস্টরা। সিন্ডিকেট ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জিরো আওয়ারে ভোটের বাক্সে অভিযান চালানোর কারণে ২৯২টি আসন দখল করা সম্ভব হওয়ায় ১৯৭৩ সালের প্রথম সংসদ নির্বাচনে ২৯২ আসন পাওয়া দলটি ৪৫ বছর পর ‘হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার’ করতে সক্ষম হয়। ১৪-১৫% ভোট পেয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশনদ্বয়ের মেয়রদ্বয় নির্বাচিত হওয়ায় এবং মাত্র ৫% থেকে ১০% ভোটে ঢাকা শহরে এমপি নির্বাচিত হওয়া সিরাজগঞ্জ ও যশোরের উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ৬১-৬২% হওয়ায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার খুশি।
আওয়ামী লীগ চারবার ক্ষমতায় এলেও তার একটি নির্বাচনও ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বা ২০০১ সালের পয়লা অক্টোবরের নির্বাচনের মতো ছিল না। প্রথম দুইটি নির্বাচনে সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সরকারকে হটিয়ে নির্বাচনের আগেই জয় নিশ্চিত করা হয়েছিল। নির্বাচনে ভোট দেয়ার জন্য জনগণ ১৯৮৩ সাল থেকে আন্দোলন করে ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী সরকারকে হটিয়েছিল। আবার ১৯৯৪ সাল থেকে আন্দোলন করে ১৯৯৬ সালে সরকারের পতন ঘটিয়েছিল। জনগণ ২০০৬-০৭ সালে আন্দোলন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পতন ঘটিয়েছিল।
এই সব আন্দোলনের মাধ্যমে যে সাফল্য অর্জিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা ৩০/০৬/২০১১ তারিখে সংবিধানের সংশোধনীর মাধ্যমে নস্যাৎ করে দিয়ে জনগণকে ভোটাধিকারহারা করায় তা পুনরুজ্জীবিত করা তাদের নৈতিক দায়িত্ব নয় কি? এর জন্য জনগণকে ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিদার দলের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হবে কেন? আগামী নির্বাচন ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির মতো না হলেও অন্তত ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের অথবা ২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের মতো হোক। সে সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী এখনই ঘোষণা করলে জনগণ তার কৃতিত্বের অংশীদার বলে নিজেদের মনে করবে।
Leave a Reply