নববর্ষের প্রথম দিন অর্থাৎ ১ জানুয়ারির যুগান্তর নতুন বছরে বড় দুই দলের রাজনৈতিক পরিকল্পনা নিয়ে রিপোর্ট করেছে। দেশবাসীও চাচ্ছে একটি সুস্থ রাজনৈতিক ধারা প্রত্যাবর্তন। অবশ্য অনেকেই হয়তো ‘প্রত্যাবর্তন’ শব্দটি গ্রহণ করতে চাইবেন না। এক সময় চলমান ছিল এমনটি হলে প্রত্যাবর্তন শব্দটির যথার্থতা থাকত। কোন সময়ে এ দেশের রাজনীতি সুস্থ ধারায় চলেছে তা বোধকরি দু’এক প্রজন্মের মানুষ মনে করতে পারবে না।
মোক্ষ লাভের জন্য রাজনীতির মাঠ দখলের প্রবণতা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথে হাঁটতে দেয়নি কোনো দলকে। তাই রাজনৈতিক দলগুলো সুস্থ-সাংস্কৃতিক ধারা প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। তবুও তো প্রত্যাশা থাকে। মানুষ চাইবেই নতুন বছরে রাজনৈতিক দলগুলো ঘুরে দাঁড়াক। জনকল্যাণমুখী রাজনীতির পথে হাঁটুক। গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করুক। বিবদমান দলগুলো পারস্পরিক দোষারোপের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভিত্তি রচনা করুক। যেখানে চলনে-বলনে স্নিগ্ধ রুচির পরিচয় থাকে।
আওয়ামী লীগ সরকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়তায় ও ঐকান্তিকতায় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এবং অবকাঠামো উন্নয়নে দেশকে অনেকটা এগিয়ে নিয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ কি যুক্তিগ্রাহ্য পথে রাজনীতিকে এগিয়ে নিতে পেরেছে? বিরোধী রাজনীতির পথ চলাকে নিষ্কণ্টক করতে পেরেছে? বড় দল ও দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা দল হিসেবে এটি অবশ্যই আওয়ামী লীগের দায়িত্ব ছিল। অন্যদিকে বিএনপি রাজনীতির মাঠে বিভ্রান্ত দশা কাটাতে পারেনি। নেতৃত্বের দুর্বলতা ও অদূরদর্শিতা এবং সরকার ও সরকারি দলের তাপচাপের কারণে ক্রমে দুর্বল দলে পরিণত হয়েছে।
ঐতিহ্যহীন এ দলটি দেশজুড়ে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সমর্থক তৈরি করতে পেরেছে ঠিকই; কিন্তু দলঅন্তপ্রাণ কর্মী তৈরি করতে পারেনি। তাই সংকটে তেমনভাবে মাঠে নামানো যাচ্ছে না অনেককেই। এমন বাস্তবতায় তৃণমূল থেকে সাংগঠনিক শক্তি অর্জন কঠিন। বিএনপির রাজনীতির মাঠে এগিয়ে যাওয়া এজন্য সহজ নয়। একটি ভীষণ কুয়াশাচ্ছন্ন পথ তৈরি হয়ে আছে। তাছাড়া দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকেও বিএনপি লোভী ও অদক্ষ নেতানেত্রীদের কারণে সুনামের চেয়ে দুর্নাম কুড়িয়েছে বেশি।
পাশাপাশি বলা যায়, দীর্ঘদিন ক্ষমতাবিচ্ছিন্ন থাকায় দিশেহারা বিএনপি বারবার সন্ত্রাস-ষড়যন্ত্রের পথে ক্ষমতায় ফিরতে চেয়েছে; যা বুমেরাং হয়েছে দলটির জন্য। এসব কারণে আজ আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক ভুলের পরও বিএনপি রাজনৈতিক সুবিধা নিতে পারছে না। কারণ সব কিছুর পরও সাধারণ মানুষ অর্থনৈতিক অগ্রগতির সুফল হাতে হাতে পাচ্ছে। এসবের সঙ্গে বিএনপি আমলের তুলনা করলে বিএনপিকে আলোতে আনা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে না পারলে বিএনপি নেতৃত্বের গৎবাঁধা বক্তব্য সাধারণ মানুষের ওপর তেমন প্রভাব ফেলবে না।
আওয়ামী লীগেরও রাজনৈতিক সংকট কম ছিল না। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের শেষ দিকটিতে দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি অস্থির করে তুলেছিল আওয়ামী লীগ শাসন কাঠামোকে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় জরুরি অবস্থা জারি দলটির জন্য কোনো সুখকর পরিপ্রেক্ষিত রচনা করতে পারেনি। গণমানুষের সঙ্গে এই প্রথম কিছুটা দূরত্ব তৈরি হতে থাকে আওয়ামী লীগের। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের বিলোপ ঘটিয়ে একদলীয় বাকশালের আত্মপ্রকাশ ঘটে। বাকশালের ভেতর সাময়িক আত্মগোপন করে আওয়ামী লীগ।
বাকশাল গঠন নিয়ে নানা বিতর্ক আছে, আছে নানা অভিযোগ। আমি সময়ের প্রয়োজনে বাকশাল গঠনকে ইতিবাচকভাবে দেখার চেষ্টা করেছি। যদিও শাসন ব্যর্থতা একে পূর্ণ হতে দেয়নি। ইউরোপের ইতিহাস থেকে উদাহরণ নেওয়া যেতে পারে। দেশের বিপর্যস্ত প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক কাঠামো এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে চাইছিল, তখন বোধকরি আঠার শতকে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলের রাজারা দেশের অস্থিরতার লাগাম টেনে ধরার জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘এনলাইটেন্ড ডেসপটিজম’ (বুদ্ধিদীপ্ত স্বৈরাচার) বা ‘বেনেভোলেন্ট ডেসপটিজম’ (কল্যাণকামী স্বৈরাচার বা একনায়কতন্ত্র)।
নানা দল-মতের চিন্তার স্বাধীনতা যখন সুবিধাবাদ আর নৈরাজ্যকে উসকে দিচ্ছিল, তখন অনন্যোপায় রাজারা শক্ত হাতে স্বৈরাচারী শাসন প্রবর্তন করেছিলেন। কোনো মানবিক দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেননি। ফলে দেশ আবার অন্ধকার থেকে আলোতে চলে আসে। অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত হয়। শিক্ষা-সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে সাড়ম্বরে। প্রশাসন আবার একটি শক্ত ভিত পেয়ে যায়। স্বৈরাচার হয়েও তাই বিশ্বনন্দিত হয়েছেন রাশিয়ার দ্বিতীয় ক্যাথরিন, প্রুশিয়ার দ্বিতীয় ফ্রেডারিক, পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় জেসেফ, স্পেনের তৃতীয় চার্লস, ফ্রান্সের প্রথম নেপোলিয়ন প্রমুখ।
কিন্তু আমাদের দেশে নীতিনির্ধারকদের দুর্বলতার সুযোগে রাজনৈতিক ঘুণপোকা এ উদ্যোগটিকে সুবিধাবাদের বলয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে নিষ্প্রাণ করে দেয়। তাই ইউরোপের বুদ্ধিদীপ্ত স্বৈরাচার জনপ্রিয়তা পেলেও বাকশাল নিজের ভেতর আত্মগোপনকারী আওয়ামী লীগকে অনেকটাই জনবিচ্ছিন্ন করে দেয়। আর অন্ধকারে ঘাপটি মেরে থাকা শক্তি লুফে নেয় এ সুবিধাটিই। এ সূত্রেই ইতিহাসের জঘন্যতম ঘটনাটি ঘটে। সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু।
যারা বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল তারা নিশ্চয়ই মেধাবী! বলা ভালো ‘ইভিল জিনিয়াস’। ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগকে পঙ্গু করার জন্য বঙ্গবন্ধু-উত্তর আওয়ামী-মেধা নিঃশেষ করার জন্য ‘সাফল্যের সাথে’ জেলহত্যা সম্পন্ন করেছিল। এবার রাজনীতির মাঠে ছুড়ে ফেলে দেয় প্রায় রাজনৈতিক পঙ্গু আওয়ামী লীগকে।
পঁচাত্তর-পরবর্তী আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের রাজনৈতিক অদক্ষতা স্পষ্ট হতে থাকে। দেশ তখন নানা মত-পথে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি, ডান-বাম মধ্যপন্থা ইত্যাদি ইস্যু তো আছেই- এ ছাড়া ছাত্র-শিক্ষক, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিসেবী সব সামাজিক শক্তিও বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। আর এর মোকাবিলার কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দূরদর্শী চিন্তা করতে পারেনি সে সময়ের আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব।
এ ব্যর্থতার সুবিধা পুরোটাই নিতে পেরেছিলেন জিয়াউর রহমান। জাতীয়তাবাদী স্লোগানে নানা মত-পথের মানুষকে নিয়ে বিএনপির জন্ম দিলেন তিনি। আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা যে শূন্য মাঠ তৈরি করে দিয়েছিল, সেখানে জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা কর্মসূচি ভালো ফল দেয়। বিএনপির মতো একটি ভুঁইফোড় দল দ্রুত জনপ্রিয়তা পাওয়ার পেছনে রাষ্ট্রীয় সুবিধা থাকার পরও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ব্যর্থতা যে অনেকাংশে দায়ী ছিল তা কি বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কখনো স্বীকার করেন?
গত শতকের আশির দশকে ভাঙনের মুখ থেকে দল বাঁচাতে শেখ হাসিনাকে নেতৃত্বে নিয়ে আসা হয়। এ পর্বেই আওয়ামী লীগ তার মূল আদর্শ থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে। দীর্ঘ ঐতিহ্য বহন করা একটি গণতন্ত্রী দল গণতান্ত্রিক ধারণা দলীয় আচরণ থেকে নির্বাসন দিয়ে তা শুধু বক্তৃতার ভাষায় জিইয়ে রেখেছিল। বিএনপির উত্থান এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এর বাড়বাড়ন্ত কিছুটা যেন দিশেহারা করে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মধ্য দিয়ে এ ঐতিহ্যবাহী দল নিজেকে সুগঠিত করার বদলে ক্ষমতায় পৌঁছার প্রতিযোগিতায় যেন ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণ আওয়ামী লীগের হতাশা যেন আরও বাড়িয়ে দেয়। রাষ্ট্র সুবিধার ছত্রছায়ায় এরশাদের জাতীয় পার্টিও ফুলেফেঁপে ওঠে। দুটো ভুঁইফোড় দলকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবিলা করা আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী দলের জন্য কঠিন ছিল না; কিন্তু নেতৃত্বের অদূরদর্শিতা দলের রাজনৈতিক ভিতকে ক্রমেই দুর্বল করে দিচ্ছিল। তৃণমূল থেকে সাংগঠনিক দিকটিকে দৃঢ় করার তেমন যোগ্য পদক্ষেপ নিতে পারেনি অনেকটা সময় পর্যন্ত।
তারপরও দলনেত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে একটু একটু ঘুরে দাঁড়াতে থাকে আওয়ামী লীগ। বিএনপি নেতৃত্ব সবল ও সৎ হতে পারলে আওয়ামী লীগকে কোণঠাসা করতে পারত। কিন্তু সে পারঙ্গমতা তারা দেখাতে পারেনি। বরং ভুল নেতৃত্বের কারণে ক্রমে দলটিই রাজনীতির মাঠে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ইতিহাস আবর্তনের ধারাকে যদি মানতে হয় তবে বিএনপির আদর্শ, জন্মলগ্ন থেকে বেড়ে ওঠা এবং বর্তমানের অবধারিত পরিণতিকে তো কণ্ঠের জোরে থামানো যাবে না। বরঞ্চ যুক্তিবুদ্ধিতেই দলটির ডুবন্ত অবস্থার বাস্তবতা মানতে হবে।
সুবিধাবাদী অপরিণামদর্শীদের হাতে বিএনপি কতটা অন্ধকারের পথে হাঁটবে তা আশঙ্কার বিষয় বটে। তবে মানতে হবে বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থান দেশজুড়ে ছড়িয়ে আছে। যদিও পরিচর্যার অভাবে এখন নড়বড়ে। দুর্নীতিবাজ নেতানেত্রীরা দলের সম্মানের ওপর বড় রকমের আঘাত হেনেছে ঠিকই; কিন্তু নিবেদিতপ্রাণ দলপ্রেমিক সমর্থক ও কর্মীদের পরিচর্যায় সে আঘাত কাটিয়ে ওঠাও খুব কঠিন হবে না। তবে অন্ধত্ব নিয়ে সুবিধাবাদী দুর্নীতিবাজ নেতা তোষণ নয়- বরঞ্চ এদের প্রতি ঘৃণা ছুড়ে দিয়ে খুঁজে বের করতে হবে পরিশুদ্ধ নেতৃত্ব। এত বড় দলে এ খুঁজে পাওয়ার কাজটি খুব কঠিন হবে না বলে আমাদের বিশ্বাস।
বিএনপি নতুন বছরজুড়ে যেসব কর্মসূচি চালিয়ে যাবে বলে ভাবছে তা সুচিন্তিত হওয়া উচিত। এতকাল জামায়াত পরামর্শ ও লন্ডন প্রেসক্রিপশনে কাজের চেয়ে যে অকাজ বেশি হয়েছে তা বিবেচনায় আনতে হবে। আওয়ামী লীগের মতো পোড়খাওয়া দলের রাজনীতিকদের মোকাবিলার জন্য সুস্থধারার রাজনৈতিক কৌশল প্রয়োজন। এ বাস্তবতায় না ফিরতে পারলে বিএনপি দ্রুত সাফল্যের পথ খুঁজে পাবে বলে মনে হয় না। এনালগ যুগে বিদেশি শক্তির সহযোগিতায় আর ষড়যন্ত্রে গণেশ উল্টে দেওয়া সম্ভব ছিল; কিন্তু এ ডিজিটাল যুগে তা সম্ভব বলে মনে হয় না। তবে আমরা চাই, দেশের স্বার্থে বিএনপি আত্মশুদ্ধ হয়ে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দলে পরিণত হোক।
আওয়ামী লীগেরও উচিত হবে বর্তমানের সুবিধাজনক অবস্থানের সুবাদে আদর্শিকভাবে দলকে সুগঠিত করা। শাসনক্ষমতায় থেকে এ দলটি যথেষ্ট সাফল্য দেখিয়েছে। নতুন বছরের পরিকল্পনায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সরকার যদি প্রকৃত অর্থে সুশাসনের পথে হাঁটতে পারে, তবে নেতাদের মাঠ দখলের মতো অগণতান্ত্রিক চিন্তা করতে হবে না।
নতুন বছরে আমরা চাই দুই বড় দলই নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথে হেঁটে দেশের রাজনীতির আকাশকে পরিচ্ছন্ন রাখুক। রাজনৈতিক সক্ষমতা ও শক্তিতে একটি ভারসাম্য আসুক। তাহলেই দেশ চারদিকে সোনালি আলো দেখতে পাবে।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Leave a Reply