মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর ততোধিক কঠিন পরীক্ষার প্রস্তুতি। নাম তার ‘ভর্তি পরীক্ষা’। সকাল–সন্ধ্যা কোচিং সেন্টারে প্রশ্নব্যাংক মুখস্থ করা আর মডেল টেস্ট। মেডিকেল, প্রকৌশল, বিশ্ববিদ্যালয় নানা প্রকার ও প্রকরণের কোচিং। তারপর প্রাণপণ ভর্তিযুদ্ধ। আজ ঢাকা, কাল খুলনা, তো পরশু চট্টগ্রাম, আবার পরের দিন সিলেট।
বুয়েট, চুয়েট, রুয়েট ও কুয়েট ঘুরে একটায় পাওয়া গেল অবশেষে, কিন্তু পছন্দের বিষয় নয়। পছন্দের বিষয়ে অন্য এক জায়গায় অপেক্ষমাণ তালিকায় নাম এসেছে। এ হচ্ছে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর দেশের ৭০–৮০ শতাংশ ছাত্রছাত্রীর ভোগান্তির কাহিনি। মাঝখানে কোচিং ব্যবসা এবং বাস-ট্রেন-লঞ্চ-বিমানে লাগাতার ছোটাছুটি। একসময় জানা যায় প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং ভর্তি–বাণিজ্যের কাহিনি।
বিষয়ভিত্তিক সঠিক শিক্ষার্থী বাছাই এর জন্য বর্তমান পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা কোনোভাবেই সহায়ক প্রমাণিত হয়নি। যে শিক্ষার্থী পদার্থবিজ্ঞান পড়তে চেয়েছে, এ অপদার্থ ভর্তি পরীক্ষার চক্করে পড়ে তার নাম পরিসংখ্যানে। রসায়নশাস্ত্র পড়া যার শখ, পরীক্ষাব্যবস্থার জটিল রসায়ন তাকে ধরিয়ে দিল বনবিজ্ঞান। অর্থনীতি বা ধনবিজ্ঞান পড়ার অদম্য আগ্রহী শিক্ষার্থীর নাম পাওয়া গেল নৃবিজ্ঞানের অপেক্ষমাণ তালিকায়।
এত দক্ষযজ্ঞ করে যে উচ্চশিক্ষালয়ে ভর্তির যাচাই-বাছাই, সেখানে সর্বক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষার গুণগত মান কি আমরা নিশ্চিত করতে পেরেছি? বিষয়ভিত্তিক সঠিক শিক্ষার্থী বাছাই এর জন্য বর্তমান পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা কোনোভাবেই সহায়ক প্রমাণিত হয়নি। যে শিক্ষার্থী পদার্থবিজ্ঞান পড়তে চেয়েছে, এ অপদার্থ ভর্তি পরীক্ষার চক্করে পড়ে তার নাম পরিসংখ্যানে। রসায়নশাস্ত্র পড়া যার শখ, পরীক্ষাব্যবস্থার জটিল রসায়ন তাকে ধরিয়ে দিল বনবিজ্ঞান। অর্থনীতি বা ধনবিজ্ঞান পড়ার অদম্য আগ্রহী শিক্ষার্থীর নাম পাওয়া গেল নৃবিজ্ঞানের অপেক্ষমাণ তালিকায়।
আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক মান বিবেচনায় হাজারের বাইরে। হাজারের ভেতর যারা ৫০০–এর মধ্যে অবস্থান করে, তাদের স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ভর্তি বা বাছাইপদ্ধতি দেখলে দেখা যাবে তারা কেউ ভর্তির ক্ষেত্রে এ রকম কোনো যান্ত্রিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে না। আবেদনকারীর পরীক্ষার ট্রান্সক্রিপ্ট এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সহশিক্ষায় বিশেষ কোনো দক্ষতা থাকলে তা–ও বিবেচনায় নিয়ে ভর্তি কাজ সম্পন্ন করে থাকে। ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা সর্বত্র এ নীতি কমবেশি হয়। আমরা আমাদের কোনো গণ–পরীক্ষার ফলাফলকে কেন গ্রাহ্যের মধ্যে নেব না?
একজন শিক্ষার্থীর বিগত সময়ের সব পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলকে মূল্যায়ন করে বাছাইয়ের প্রাথমিক পর্বটি সেরে চূড়ান্ত বাছাইয়ে একটি সাক্ষাৎকার, যা অনলাইন বা সেলফোনেও করা যেতে পারে। ভর্তি দুটি পৃথক পর্বে উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফল পাওয়ার এক মাসের মধ্যে সমাপ্ত হবে। প্রথম পর্ব মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের প্রাপ্ত পয়েন্টভিত্তিক ৮০ শতাংশ আসন। দ্বিতীয় পর্বে বাকি আসনের জন্য একটি পরীক্ষা সংশ্লিষ্ট বিভাগ কর্তৃক আয়োজন করে বাকি ২০ শতাংশ আসন পূরণ করবে। আবেদনকারীদের মধ্যে যারা ফলাফলভিত্তিক বাছাইয়ে মনোনীত হয়নি, তারাই শুধু এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগ সরাসরি তাদের নিজ নিজ বিভাগের জন্য শিক্ষার্থী বাছাই করবে। বিশ্ববিদ্যালয় সবার জন্য একটি সাধারণ নিয়ম করে দেবে। বিভাগের কিছু স্বাধীন ক্ষমতাও থাকবে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের ন্যূনতম পয়েন্ট পাওয়া শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফল প্রকাশের পাঁচ–সাত দিনের মধ্যে পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, ইনস্টিটিউটের পছন্দনীয় বিষয়ে যথাযথ কাগজপত্রসহ অনলাইনে আবেদন করবে। বিভাগ কাগজপত্র মূল্যায়ন করে বিভাগের ৮০ শতাংশ আসন এ আবেদন থেকে পূরণ করে দরখাস্ত প্রাপ্তির শেষ দিন থেকে ৫ দিনের মাথায় ফলাফল জানিয়ে দেবে। ফলাফল জানার ১০ দিনের মধ্যে শিক্ষার্থীকে অবশ্যই ভর্তি হতে হবে। দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একই নিয়ম অনুসৃত হতে হবে। বাকি ২০ শতাংশ আসন একটি উন্মুক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে বাছাই করা যেতে পারে। কারণ, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে অনেক ভালো ছাত্রও কোনো কারণে খারাপ ফলাফল করতে পারে।
সঠিক প্রস্তুতি ও নিয়ত ঠিক করে ২০২২-২৩ সাল থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষাবিহীন ভর্তিব্যবস্থা চালু হোক। এখানে একটি বিষয় জোরের সঙ্গে বলতে চাই, ভর্তিব্যবস্থায় প্রচলিত সব কোটা রহিত করতে হবে। নতুবা এ ব্যবস্থার সুফল পাওয়া যাবে না
ভর্তি ব্যবস্থাপনা ও তার আনুষঙ্গিক ব্যয় এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দায় ও দায়িত্ব। ভর্তির একটি ন্যূনতম ফি নেওয়া যায়, কিন্তু ভর্তি পরীক্ষার কোনো ফি প্রাতিষ্ঠানিক বা ব্যক্তি আয়ের ফাঁদ হতে পারে না। মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষকতার গুণ ও মান বৃদ্ধির প্রশ্নটি এড়িয়ে উচ্চশিক্ষায় কঠিন ভর্তি পরীক্ষা সঠিক মেধা ও সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির শিক্ষার্থী বাছাইয়ে কোনো সাহায্য করবে না। সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ৪০ বছরের অভিজ্ঞতায় এটি ভালোভাবে বুঝেছি। সঠিক প্রস্তুতি ও নিয়ত ঠিক করে ২০২২-২৩ সাল থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষাবিহীন ভর্তিব্যবস্থা চালু হোক। এখানে একটি বিষয় জোরের সঙ্গে বলতে চাই, ভর্তিব্যবস্থায় প্রচলিত সব কোটা রহিত করতে হবে। নতুবা এ ব্যবস্থার সুফল পাওয়া যাবে না।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একই নিয়মে ভর্তির কাজ পরিচালনা করবে। সব কটিতে না হলেও কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চাপ থাকবে, আবার কিছু বিশ্ববিদ্যালয় খুব বেশি আবেদন পাবে না। তারা সবাই উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিভাগওয়ারি আবেদন গ্রহণ করবে। তবে বিভাগওয়ারি প্রাথমিক বাছাইয়ের ফলাফল প্রকাশ করবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক পর্বের ভর্তি ফলাফল প্রকাশের এক সপ্তাহ পর। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শূন্য আসনের ভর্তি পরীক্ষা নেবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় পর্বের ফলাফল প্রকাশের এক সপ্তাহ পর। এভাবে যদি ভর্তিব্যবস্থা পুনর্গঠিত হয়, তাহলে দেশজুড়ে যে ভর্তি বিড়ম্বনা, তা বহুলাংশে হ্রাস পাবে। ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী তাদের পছন্দনীয় বিষয়ে পড়তে পারবে। দেশে ভর্তি–বাণিজ্য, কোচিং–বাণিজ্য, ভর্তি–আতঙ্ক ও নানামুখী ভোগান্তি কমবে। প্রচলিত পদ্ধতির ভেতর ঘুরপাক খেলে সমস্যার সমাধান হবে না। সে জন্য প্রচলিত প্রথা-পদ্ধতির বাইরে যেতে হবে। বিষয়টি সবাইকে ভেবে দেখতে অনুরোধ করি।
ড. তোফায়েল আহমেদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক। দুটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও একটিতে উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন।
Leave a Reply