সম্প্রতি জাতীয় সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জনপ্রশাসনসচিবের একটি ব্যতিক্রমধর্মী বক্তব্য এসেছে। বক্তব্যটি তিনি দিয়েছেন ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার অফিসে কর্মকর্তাদের একটি অনুষ্ঠানে। এ ধরনের ধরাবাঁধা অনুষ্ঠানে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সাধারণত পোশাকি বক্তব্যই দিয়ে থাকেন। থাকে কিছু উপদেশ ও প্রেরণা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে চলমান নেতিবাচক অনেক বিষয় জনপ্রশাসনসচিব শেখ ইউসুফ হারুন তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন। এ সাহসী সহজ-সরল বক্তব্যে অনেক বার্তা রয়েছে। তাঁর মন্ত্রণালয় বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার নিয়ন্ত্রণ করে। তাই মূলত সেই ক্যাডারের কর্মকর্তাদের কিছু আচরণই উঠে এসেছে সে বক্তব্যে।
হয়তোবা প্রাসঙ্গিক নয় বলে অন্য অনেকের বিষয় বাদ গেছে। আর এ ধরনের একটি সমাবেশে এত কিছু বিস্তারিতভাবে বলা সম্ভবও নয়। বরং যেটুকু বলেছেন, সেটি কম কথা নয়। আর কথাগুলো তিনি বলেছেন স্বীয় অভিজ্ঞতা থেকে। ক্যাডার নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয়ের প্রধান কর্মকর্তা কিংবা দপ্তর সংস্থার প্রধানেরা সাধারণত বলে থাকেন, তাঁদের অধীন কর্মকর্তা সবাই ভালো কাজ করে যাচ্ছেন। ব্যতিক্রম সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলেও অভিযোগ পেলে তদন্ত করা হবে, এ ধরনের জবাব দেন। সহজ-সরল ভাষায় করেন না কোনো স্বীকারোক্তি। প্রকারান্তরে, বিপরীতটা করেছেন জনপ্রশাসনসচিব।
কর্মকর্তাদের একটি অংশ দলবাজিতে লিপ্ত হয়েছেন। ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেন সম্পর্ক। ঊর্ধ্বতন নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তাদের করে রাখেন বশীভূত। ফলে বেপরোয়া হয়ে যান তাঁরা। সীমিত বলয়ের গুটিকয় ব্যক্তিকে আস্থায় রেখে ধরাকে ভাবেন সরা।
এমন যদি সংশ্লিষ্ট সবাই করতেন, তবে সরকারের কাজে জবাবদিহি অধিকতর দৃশ্যমান হতো। আরও বাড়ত ভাবমূর্তি। এটা বলতে হবে, প্রশাসনসহ সব ক্যাডারেই ন্যায়নিষ্ঠ কর্মকর্তার সংখ্যাই বেশি। অথচ অর্থনীতির গ্রেশামস ল-এর মন্দ টাকা ভালো টাকাকে বের করে দেওয়ার তত্ত্বের মতো নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থাদি প্রায়ই চলে যায় মন্দদের হাতেই।
জনপ্রশাসনসচিব বলেছেন, ‘আমরা সরকারি কর্মকর্তা, অকর্মকর্তাসুলভ আচরণ যেন না করি। আমার যে দায়িত্ব, সেটি যেন পালন করি।’ এটাই তো হওয়ার কথা। আর বেশ কিছু ক্ষেত্রে তা হয় না বলেই ক্ষোভ থেকে এ কথাগুলো বলেছেন তিনি। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। এর ভাষা কিংবা ভাব দুর্বোধ্য নয়। মূলত এটি সব কর্মকর্তার উদ্দেশ্যেই বক্তব্য বলে ধরে নিতে হবে। সরকারি কর্মকর্তাদের একটি অংশের অকর্মকর্তাসুলভ আচরণের ব্যাপারটি একেবারে নতুন নয়।
তবে ইদানীং এর মাত্রা বেড়েছে বিভিন্ন কারণে। এর মধ্যে রয়েছে কর্মকর্তাদের একটি অংশ দলবাজিতে লিপ্ত হয়েছেন। ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেন সম্পর্ক। ঊর্ধ্বতন নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তাদের করে রাখেন বশীভূত। ফলে বেপরোয়া হয়ে যান তাঁরা। সীমিত বলয়ের গুটিকয় ব্যক্তিকে আস্থায় রেখে ধরাকে ভাবেন সরা। তাঁরা ভুলে যান তাঁদের বেতন-ভাতা, টেলিফোন ও আবাসন সুবিধাদি সবই জনগণের করের টাকায়। তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করবেন, এমনটা আশা করা হলেও অনেক ক্ষেত্রে ঘটে এর বিপরীতটা। প্রায়ই খবর হন তাঁরাই। আর সেসব খবর যে ইতিবাচক নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পেশাগত জ্ঞান বৃদ্ধিতে কোনো সচেতনতা নেই তাঁদের। মনোযোগী নন অর্পিত দায়িত্ব যথাসময়ে যথাযথভাবে পালনে। অথচ সরকার তাঁদের নিয়োগ দিয়েছে জনগণের চাহিদা মেটাতে। তাই নিয়োগ, বদলি সব আদেশই উল্লেখ থাকে ‘জনস্বার্থের’ কথা। জনপ্রশাসনসচিব তাঁর বক্তব্যে মূলত এ বার্তাটিই দিতে চেয়েছেন।
দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে তিনি বলেন, একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বন্দুক কিনে রাতের বেলায় সেটা জাহির করার জন্য ফায়ার করেন। বিষয়টি গণমাধ্যমে এসেছিল। রাতের সে গুলিবর্ষণের ঘটনা স্থানীয় জনগণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারে। এটুকু উপলব্ধি করে তাঁর পরীক্ষামূলক গুলিবর্ষণের কাজটি দিনের বেলাই করা সংগত ছিল। করে রাখতে পারতেন থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি। একটি উপজেলার প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তার এ ধরনের বাস্তব জ্ঞান থাকা সংগত। এগুলো প্রশিক্ষণ দিয়ে হয় না।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার নিয়েও জনপ্রশাসনসচিব কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তুচ্ছ, গুরুত্বহীন এমনকি নিজের দায়িত্বের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ ফেসবুক পোস্ট দেন অনেক কর্মকর্তা। এসব বিষয় বর্জন করার পক্ষে তিনি দৃঢ় মত পোষণ করেন। তিনি আরও বলেন, টাকাপয়সা লেনদেন হয় এমন পদের কার্যকাল কম হওয়ায় ফেসবুকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেন কোনো কোনো কর্মকর্তা। তাঁরা কিন্তু বিরল নয়। তবে আগে একটু লাজলজ্জা ছিল। এখন তা-ও ঝেড়ে ফেলেছেন।
মাঠপ্রশাসন থেকে ঢাকায় বদলি হয়ে আসার জন্য বিভিন্ন ধরনের অজুহাত তৈরি করেন একেকজন কর্মকর্তা। বিভিন্ন ব্যাচ তাদের মধ্যে সহমর্মিতা বৃদ্ধির জন্য একটি ফোরাম তৈরি করে। সে ধরনেরই একটি জুনিয়র ব্যাচের সভাপতি ঢাকায় বদলি হতে চান তাঁর ব্যাচের পক্ষে কাজ করতে। তবে ফোরামের সম্প্রসারণ হয়েছে, এখন যাঁরা নিয়োগের জন্য অপেক্ষমাণ (৩৭তম বিসিএস), তাঁদের মধ্যেও। তাঁদের সভায় আমন্ত্রিত হয়ে উপস্থিত থাকেন পদস্থ কর্মকর্তারা। মনে হয় ব্যবস্থাটি একটি ট্রেড ইউনিয়নের রূপ পেতে যাচ্ছে। কোনো ব্যাচের কোনো কর্মকর্তার বদলি বা শৃঙ্খলাজনিত বিষয়ে সে ব্যাচের নেতারা ছাড়াও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রভাব ফেলতে চান। দেখা যাচ্ছে তদবিরে রাজনীতিকেরা এখন কর্মকর্তাদের পেছনে চলে যাচ্ছেন।
জনগণের অনুভূতির সঙ্গে তাঁদের অবস্থান বিপরীত মেরুতে। টেলিফোন ধরেন না কেউ কেউ। অথচ তাঁর কাছে কাজ না থাকলে টেলিফোনটি আসত না। অন্যদিকে তাঁদের সহকর্মীরাই ক্ষেত্রবিশেষে দিবা-রাত্র কাজ করে জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলা করছেন।
জনপ্রশাসনসচিবের ভাষ্য অনুযায়ী, গণমাধ্যমে সাক্ষাৎ দিতে গিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন বেশ কিছু কর্মকর্তা। এ বিষয়ে সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার সংশ্লিষ্ট বিধিটির কথাও তিনি আলোচনায় আনেন। পেশাগত জ্ঞানে দৈন্য জনসংযোগে নৈপুণ্যের অভাবে এমনটা হতে পারে। এটা তাঁদের অযোগ্যতা। এ বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের চাকরির রেকর্ডে এবং ভবিষ্যৎ পদোন্নতির সময়ে বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। বিভিন্ন ধরনের অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধির কথাও তিনি গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। বলেছেন বিভাগীয় মামলার সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। কিছুসংখ্যক কর্মকর্তার মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে, এ বিষয়ে কেউ ভিন্নমত পোষণ করবেন না।
বেগমপাড়ায়ও তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় থেকে বলা হয়েছে, পাশাপাশি বড় ধরনের অভিযোগ আছে, বেশ কিছু কর্মকর্তা এখন জনকল্যাণকে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করেন না। জনগণের অনুভূতির সঙ্গে তাঁদের অবস্থান বিপরীত মেরুতে। টেলিফোন ধরেন না কেউ কেউ। অথচ তাঁর কাছে কাজ না থাকলে টেলিফোনটি আসত না। অন্যদিকে তাঁদের সহকর্মীরাই ক্ষেত্রবিশেষে দিবা-রাত্র কাজ করে জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলা করছেন। এমনটি আমরা দেখেছি করোনা সংক্রমণের প্রথম দিকটাতে। এত সব অর্জন কিন্তু এরূপ দু-একটি বিচ্যুতিতেই ম্লান হয়ে যায়। কেউ কেউ গণমাধ্যমকে দোষ দেন। অথচ আমরা তো দেখি সরকারি কর্মকর্তাদের অনেক ভালো কাজের প্রশংসনীয় স্বীকৃতি পাওয়া যায় গণমাধ্যমেই।
উল্লেখ করতে হয়, জনপ্রশাসনসচিব খোলাখুলিভাবে তাঁর তরুণ সহকর্মীদের কতিপয় বর্জনীয় আচরণের বিষয়গুলো উল্লেখ করেছেন। মূলত সদিচ্ছা থেকেই তাঁর এমনতর বক্তব্য এল। সমস্যা চেপে যাওয়া বা রাখঢাক করে বলতেই আমরা এত দিন অভ্যস্ত ছিলাম। ফলে কর্মকর্তাদের অধিকতর বিতর্কিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তিনি তাঁদের সতর্ক করলেন। সবাই না হলেও কেউ কেউ তাঁর এ ধরনের বক্তব্যে আচরণ পাল্টাতে পারেন। আর এভাবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিজেদের পরিচ্ছন্ন রেখে নবীনদের দিকনির্দেশনা দিতে থাকলে ক্রমান্বয়ে কমে আসবে বিচ্যুতি ও ভুলভ্রান্তি।
হাল আমলে সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা ও সুবিধাদি নিকট অতীত থেকে অনেক গুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ অবস্থায় ভালোভাবে জীবনধারণের ব্যবস্থা করা যায়। দরকার হলে আরও বেতন বাড়ানোর জন্য সরকারের কাছে দাবি করা চলে। তবে নিজেদের জনভোগান্তির কারণ হিসেবে রাখা চলবে না। জনপ্রশাসনসচিবের বক্তব্য অনুসারে ‘অকর্মকর্তাসুলভ আচরণ না করলেই’ পরিস্থিতির অনুকূল পরিবর্তন হতে থাকার কথা। সময়োপযোগী সাহসী বক্তব্যের জন্য তাঁকে অভিনন্দন।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
Leave a Reply