কয়েক দিন আগে সাউথ এশিয়া স্টাডিজ (এসএএস) নামের একটি সংগঠনের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু সচরাচর আলোচনা হয় না, এমন একটি বিষয়, ‘কৌশলগত সার্বভৌমত্ব’-এর প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অবস্থান নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। আমার মতে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অবস্থান কৌশলগত সার্বভৌমত্বের নয়, বরং কৌশলগত স্বকীয়তার প্রেক্ষাপটে আলোচনা হওয়া উচিত ছিল। সেই প্রসঙ্গ এ লেখায় তুলে ধরতে চাইছি। কৌশলগত সার্বভৌমত্ব নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে, যে জোটে সদস্যরাষ্ট্রগুলো অংশীদারত্বের সার্বভৌমত্বে রয়েছে। কাজেই দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে উপমহাদেশের অবস্থান নিরূপণ করতে কৌশলগত স্বকীয়তার প্রেক্ষাপটই প্রযোজ্য।
দুটি তত্ত্বের সংজ্ঞা প্রায় কাছাকাছি। কৌশলগত স্বকীয়তার ব্যাখ্যা হচ্ছে একটি রাষ্ট্রের কৌশলগত পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার একক ক্ষমতা। অর্থনৈতিক, সামরিক কৌশল ও পররাষ্ট্রসংক্রান্ত বিষয়, যেগুলো রাষ্ট্রব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা। এগুলো সবই থাকে যখন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব একক কোনো চুক্তি বা অন্য কোনো বন্ধনে আবদ্ধ না হয়। যেকোনো সামরিক বা প্রতিরক্ষা জোটের সদস্য হওয়ার অর্থ আমার বিবেচনায়, একাধারে অংশীদারি সার্বভৌমত্বে প্রবেশের সম্ভাবনা, তেমনি কৌশলগত স্বকীয়তা হারানো।
শুধু নিরাপত্তার দিক থেকেই নয়, অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণেও পাকিস্তান অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বকীয়তা হারিয়েছে। চীনের বিশাল লগ্নি, বিশেষ করে প্রায় ৬৫ বিলিয়ন ইউএস ডলারের চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের বিনিয়োগ পাকিস্তানকে চীনের ঋণের মধ্যে আটকে ফেলেছে।
এর ভিন্ন দিকটি হচ্ছে, স্বকীয়তা বজায় রেখে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান অথবা সহায়ক প্রতিষ্ঠানগুলোর তৃতীয় পক্ষের সহযোগিতায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বজায় রাখা। এর অর্থ দাঁড়ায় যে সহযোগিতা গ্রহণেও যেমন রাষ্ট্রের সক্ষমতা ও স্বকীয়তা থাকবে, তেমনি চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনেও থাকবে স্বকীয়তা। সংক্ষিপ্তভাবে আলোচিত তত্ত্বের আঙ্গিকে উপমহাদেশের প্রধান দেশগুলোর কৌশলগত স্বকীয়তার অবস্থান নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করতে চাই।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তি ও ভারত-পাকিস্তান আলাদা রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর ঔপনিবেশিক শক্তির অবর্তমানে সদ্য স্বাধীন দেশ হিসেবে ভারতের তুলনায় পাকিস্তান অনেকটাই দুর্বল রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রা শুরু করে। শুরু থেকেই কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তান-ভারতের বিবাদের মুখে পাকিস্তানের সামরিক ও বৈদেশিক নীতি একদিকে পশ্চিমামুখী এবং অভ্যন্তরীণ নীতি কাশ্মীরকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছিল। ক্রমেই পাকিস্তান প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে মার্কিনঘেঁষা হতে থাকে, এমনকি সোভিয়েতবিরোধী ঘাঁটিও তৈরি হয়। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান-মার্কিন প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তির মাধ্যমে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ঘাঁটি তৈরি করে। ১৯৫৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সরকার পেশোয়ার বিমানঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্রকে লিজ দেয়। ১৯৬০ সালে সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সিআইএ পরিচালিত ইউ-২ মিশন বিফল হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর পাকিস্তানের নির্ভরশীলতা প্রকাশিত হয়। তারপর সিয়াটো এবং সেন্টোর মতো দুই নিরাপত্তা সংগঠনের সদস্য হওয়ায় রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান কৌশলগত স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলে। ১৯৭১ সালের পর বিষয়টি আরও জটিল হয়ে ওঠে। বিশেষ করে ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান দখল করার পর থেকে আজ পর্যন্ত মার্কিনদের চাপের মুখে পাকিস্তান।
শুধু নিরাপত্তার দিক থেকেই নয়, অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণেও পাকিস্তান অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বকীয়তা হারিয়েছে। চীনের বিশাল লগ্নি, বিশেষ করে প্রায় ৬৫ বিলিয়ন ইউএস ডলারের চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের বিনিয়োগ পাকিস্তানকে চীনের ঋণের মধ্যে আটকে ফেলেছে। পাকিস্তানের অর্থনীতির এমন অবস্থা যে সৌদি আরবের দুই বিলিয়ন ডলার ফেরত দেওয়ার সামর্থ্যও হারিয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে চীন ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের পক্ষে কৌশলগত স্বকীয়তা বজায় রাখা খুবই কঠিন।
বিগত প্রায় এক দশক ধরে ভারত তার পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষানীতিতে পরিবর্তন আনতে ক্রমেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রমুখী হতে শুরু করে। বর্তমানে ট্রাম্প প্রশাসনের সময়ে মার্কিন-চীন অর্থনৈতিক ও কৌশলগত ক্ষেত্রে টানাপোড়েনের মধ্যেই ভারত চীনের বিপরীতে মার্কিনদের প্রতি ঝুঁকে পড়ে।
অপর দিকে স্বাধীনতার পর থেকেই ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু এবং তাঁর সরকার কৌশলগত স্বাধীনতা ও কৌশলগত স্বকীয়তা সযত্নে ধরে রাখেন। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ঔপনিবেশিক শাসন–পরবর্তী দুই পরাশক্তির, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বলয় থেকে দূরে থেকে ১৯৫৫ সালে বান্দুর সম্মেলনে জোটনিরপেক্ষ নীতি প্রণয়ন করেন। উদ্দেশ্য, ভারতকে পরাশক্তির বলয় থেকে দূরে রাখা এবং কৌশলগত স্বকীয়তা অটুট রাখা। অবশেষে ১৯৬১ সালে বেলগ্রেডে জোটনিরপেক্ষ গোষ্ঠী তৈরি হয়। ওই জোটের নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, মিসরের প্রেসিডেন্ট গামাল আবদুল নাসের, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুকর্ণ, ঘানার প্রেসিডেন্ট নকরুমা এবং যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট জোসেফ টিটো। সেই থেকে ভারত স্বকীয়তা বজায় রাখে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। এমনকি ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সমরাস্ত্রে সহযোগিতা চাইলেও কোনো ধরনের চুক্তিতে যেতে চায়নি ভারত।
নেহরু-পরবর্তী ভারত ক্রমেই সেই নীতি বিসর্জন দেওয়া শুরু করে, বিশেষ করে প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ‘ইন্দো-সোভিয়েত ট্রিটি অব ফ্রেন্ডশিপ অ্যান্ড কো-অপারেশন’ চুক্তি করে, যা মূলত সামরিক কৌশলগত চুক্তি। এর মাধ্যমে ভারত প্রতিরক্ষা খাতে এবং অনেকাংশে পররাষ্ট্রনীতিতে আগের নীতি হারিয়ে ফেলে। স্মরণযোগ্য, এ চুক্তি তিনবার নবায়ন হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর উত্তরাধিকারসূত্রে রাশিয়ার সঙ্গে বহাল থাকে ২০১১ পর্যন্ত।
বিগত প্রায় এক দশক ধরে ভারত তার পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষানীতিতে পরিবর্তন আনতে ক্রমেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রমুখী হতে শুরু করে। বর্তমানে ট্রাম্প প্রশাসনের সময়ে মার্কিন-চীন অর্থনৈতিক ও কৌশলগত ক্ষেত্রে টানাপোড়েনের মধ্যেই ভারত চীনের বিপরীতে মার্কিনদের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। প্রথমে মার্কিন নৌবাহিনীর সঙ্গে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরে ‘মালাবার’ নামের নৌমহড়া শুরু করে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের সঙ্গে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (আইপিএস) যুক্ত হয়েছে। এ জোট স্পষ্টতই সামরিক জোট এবং এর প্রধান উদ্দেশ্য ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব খর্ব ও প্রয়োজনে সামরিকভাবে মোকাবিলা করা।
চীন-ভারত চলমান বিরোধের কারণে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তিত হয়ে নিরাপত্তাভিত্তিক হয়েছে। একই সঙ্গে ভারত এ অঞ্চলে, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন প্রভাব এবং এ অঞ্চলের দেশগুলোকে আইপিএসের আওতায় আনার চেষ্টা করে যাচ্ছে। হালে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ভারত পুরোনো পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তন করে বর্তমানে নিরাপত্তাভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করবে। এর সোজাসাপ্টা মানে দাঁড়ায়, ভারত নেহরুর কৌশলগত স্বকীয়তার নীতি থেকে সরে এসেছে। ভারতের অভ্যন্তরীণ সামরিক ও পররাষ্ট্রনীতিতে নিরাপত্তা এবং আইপিএসের প্রভাব বাড়ছে।
জনসংখ্যার দিক দিয়ে উপমহাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম দেশ বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার ৫০ বছরের দিকে এগোচ্ছে। এ সময়ে বাংলাদেশের অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাটি হলো পদ্মা নদীর ওপরে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সেতুর কাঠামোর একটি পর্যায়ের সমাপ্তি। আশা করা যায়, ২০২১ সালের মধ্যে চলাচলের উপযোগী হবে। স্মরণযোগ্য যে এ উদ্যোগ ২০১০ সালে শুরু হলে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগে অর্থায়ন না করার ঘোষণা দিয়েছিল। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার নিজস্ব অর্থায়নে এত বড় অবকাঠামো তৈরির ঘোষণা দেয়। তারপর চীনের আর্থিক লগ্নি ও কারিগরি সহযোগিতায় সেতুটি তৈরির মূল কাজ শেষ হয়। এ সাফল্যের পেছনে আমার মতে, বাংলাদেশে কৌশলগত স্বকীয়তা কাজ করেছে। সে কারণেই প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংককে বাদ দিয়ে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন। বলা যায়, ১৯৯৬ সাল থেকে বাংলাদেশ তার স্বকীয়তা বজায় রেখেছে, যা ইদানীং বাংলাদেশের ভারসাম্যযুক্ত পররাষ্ট্রনীতিতে প্রতিফলিত হচ্ছে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক, প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র স্বকীয় নীতি গ্রহণে যে সক্ষমতা ও স্বকীয়তা অর্জন করেছে, তা উপমহাদেশের অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় উদাহরণ বলা যেতে পারে।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে ভারতের সঙ্গে ২৫ বছরের যে মৈত্রী চুক্তি করে, সেখানে সামরিক সহযোগিতার কথা ছিল, যা স্বাধীন বাংলাদেশের সামরিক ও পররাষ্ট্রনীতির স্বকীয়তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল না। মেয়াদ শেষ হওয়ার পর কোনো সরকারই তা নবায়ন করেনি। ইতিমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে আইপিএসএ যোগ দেওয়ার বা সমর্থনের অনুরোধ জানানো হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্র ও তথ্যে প্রকাশ। এ আহ্বানে বাংলাদেশ সাড়া দিয়েছে বা দেবে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক, প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র স্বকীয় নীতি গ্রহণে যে সক্ষমতা ও স্বকীয়তা অর্জন করেছে, তা উপমহাদেশের অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় উদাহরণ বলা যেতে পারে। নিজস্ব উদ্যোগে পদ্মা সেতু নির্মাণের যে সাহসী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা সম্ভব হয়েছে কৌশলগত স্বকীয়তা অর্জনের কারণে। এ উপমহাদেশের তথা দক্ষিণ এশিয়ার সর্বকনিষ্ঠ দেশের এ অগ্রগতির পেছনে রয়েছে বাংলাদেশের কৌশলগত স্বকীয়তা অর্জন ও রক্ষা করায়। পদ্মা সেতু এর একটি উদাহরণ মাত্র।
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)
Leave a Reply