মার্কিন নির্বাচনের ১২০ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষ এবার ভোট দিয়েছে। এই ভোটদান হলো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি মানুষের আস্থার পরিচায়ক। মোট ১৬ কোটি মানুষ এবার নির্বাচনে ভোট দিয়েছে। নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর মনে হচ্ছে, ক্ষমতা পরিবর্তনের তাগিদে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়েছে। এই নির্বাচনে জো বাইডেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের থেকে ৪০ লাখেরও বেশি ভোট পেয়েছেন। এতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের নেতা এবং আগামী চার বছর দেশটি শাসন করার বৈধ অধিকারপ্রাপ্ত হয়েছেন। শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে যদি প্রেসিডেন্সি পদ নির্ধারিত হতো, তাহলে বাইডেনকে আগামী টার্মের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প সমীহ করতে বাধ্য হতেন। একের পর এক অভিযোগ উত্থাপন করেও ট্রাম্প যখন সুবিধা করতে পারছেন না, তাই তিনি সব শেষে দাবি করেছেন, ‘ডমিনিয়ন’ নামের যে সফটওয়্যার কম্পানির মাধ্যমে বেশ কিছু অঙ্গরাজ্যে ভোটগ্রহণ করা হয়েছে, সেসব জায়গায়ই জালিয়াতি হয়েছে। যদিও নির্বাচনের আগে ট্রাম্প ও কোনো প্রযুক্তি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। ক্ষমতা হস্তান্তরকে বিলম্বিত অথবা হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য যেসব এলোমেলো, শিশুসুলভ বিষয়ের অবতারণা করছেন ট্রাম্প, তা কোনোভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বক্তব্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে না।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রথা অনুযায়ী, ফেডারেল সরকারের ‘জেনারেল সার্ভিস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’-এর আনুষ্ঠানিকভাবে সব ফলাফল পাওয়ার পর নতুন প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা গ্রহণের প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করার কথা। একই সঙ্গে প্রশাসনে নতুন লোক নিয়োগসহ অন্যান্য কাজের জন্য ফেডারেল অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার কথা। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সব সময়ই নির্বাচনের ফলাফল পরিষ্কার হওয়ার পর থেকেই এমন হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে থাকে। তবে এবার তার ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে প্রতিদিন অবহিত করার কাজও শুরু হয়নি। সংবিধান অনুযায়ী, ২০ জানুয়ারি নতুন প্রশাসনের ক্ষমতা গ্রহণের কথা। বাইডেনের পক্ষ থেকে ‘ট্রানজিশন’ নিয়ে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে জানানো হলেও এ ক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসন কোনো সহযোগিতা করছে না। প্রস্তুতির জন্য বাইডেন কোনো ফেডারেল অর্থ বরাদ্দও পাচ্ছেন না। এবারের এই পরিস্থিতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব অস্থিরতা ও ব্যতিক্রমী পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
এই যে অচলাবস্থা, ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য নিত্যনতুন অভিযোগ উত্থাপন, এটা যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি সারা বিশ্বের মানুষের যে সমীহ তাকে দ্রুত নিম্নপর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে আসছে, তা নিশ্চয় রিপাবলিকান দলের শীর্ষ নেতা এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প উপলব্ধি করতে পারছেন। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, রিপাবলিকান দলের মূল নেতারা ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিপক্ষে এখনো প্রকাশ্য অবস্থান নেননি। অনেকেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সময়ক্ষেপণকে সমর্থন দিচ্ছেন। এ কারণে ক্ষমতার পালাবদলের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাইডেন শিবিরকে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য এখনো কোনো সহযোগিতা করা হচ্ছে না। এই পরিস্থিত সত্যিকার অর্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের ইতিহাসে কালিমা লেপন করতে যাচ্ছে এবং এই কালিমা অনেকটা অনপনেয়। এই কালিমা যে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগ পর্যন্ত আরো গাঢ় হবে, এ ব্যাপারেও সুস্পষ্ট আভাস পাওয়া যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকসমাজ, সংবাদমাধ্যম এই অস্থিরতা, অচলাবস্থা, বিশৃঙ্খলা আগামী ২০ জানুয়ারি ক্ষমতা হস্তান্তরের আগ পর্যন্ত চলতে থাকবে বলে অনুমান করে। কারণ ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত ডোনাল্ড ট্রাম্পের মার্কিন প্রেসিডেন্সির ওপর কর্তৃত্ব বজায় থাকবে এবং একই সঙ্গে রিপাবলিকান দলের ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ বহাল থাকবে। এই নিয়ন্ত্রণ তিনি ক্ষমতা হস্তান্তরের আগ পর্যন্ত অস্থিরতা তৈরির কাজে ব্যবহার করতে পারেন বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনে পরাজয় মানতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অস্বীকৃতির দিকে যখন সারা বিশ্বের দৃষ্টি ঠিক সেই সময়ে জাতিসংঘে ১১০টি দেশের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে জাতিসংঘ ফোরামে যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার পরিস্থিতির পর্যালোচনায় অনেক অস্বস্তিকর ও অনভিপ্রেত প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে। এই ফোরামে জাতিসংঘের স্বাধীন বিশেষজ্ঞরা কথিত সন্ত্রাসবিরোধী বৈশ্বিক লড়াইয়ের সময়ে মানবাধিকার ও মানবিক আইনগুলো লঙ্ঘনের প্রশ্নে দায়মুক্তির অবসান ঘটানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
মানবাধিকার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কণ্ঠ সবচেয়ে সরব এবং এই ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাও বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত। বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার নিয়ে দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তর প্রতিবছর প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার রক্ষায় নেতৃস্থানীয় দেশ হিসেবে ভূমিকা পালন করতে চায়। সেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বর্ণ, ধর্ম এবং নারী-পুরুষভেদে বৈষম্য-বিদ্বেষ সৃষ্টিকারী বক্তব্য প্রচার, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, সহিংসতা ও অভিবাসীদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণের অবসান ঘটানোর পাশাপাশি বিচারব্যবস্থায় সংস্কার নিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে বিভক্তি ও সামাজিক অস্থিরতা বহু বছর থেকে তিলে তিলে বেড়ে উঠলেও আমরা সাম্প্রতিক নির্বাচনী প্রচারে বর্ণবাদ, অভিবাসী, ধর্ম, বর্ণ প্রসঙ্গ আলোচনায় বুঝতে পারি যে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ও বহুত্ববাদের সৌন্দর্য যুক্তরাষ্ট্রে অনেকাংশেই ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে চার বছরের দায়িত্ব পালনকালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তাঁর সরকার দেশে ও বিদেশে এমন কিছু নীতি অনুসরণ করেছে, যা গণতন্ত্র, উদারপন্থা ও বহুত্ববাদের আদর্শের পক্ষে ক্ষতিকর। বহু জাতি-ধর্ম-বর্ণের সমন্বয়ে গঠিত মার্কিন সমাজে উগ্র জাতীয়তাবাদ তথা শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বের সংকীর্ণ রাজনীতি যুক্তরাষ্ট্রের বহুত্ববাদী সমাজকে বিভক্ত করেছে। এই বিভক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈচিত্র্যের মধ্যে সোন্দর্য অনুসন্ধানের শত বছরের যে মহৎ প্রচেষ্টা তাকে যে পেছন দিকে ঠেলে দিয়েছে তা বলাই বাহুল্য।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অসহিষ্ণু ও উগ্র আচরণের দ্বারা তাঁর এমন একটি ভাবমূর্তি জনগণের সামনে উপস্থাপিত হয়েছে, ট্রাম্পের নেতৃত্বের প্রতি শ্বেতাঙ্গ, অশ্বেতাঙ্গ, অভিবাসী কোনো পক্ষই পূর্ণ আস্থা রাখতে পারেননি। পক্ষান্তরে জো বাইডেনকে শুরুতে অনেকেই সপ্রতিভ মনে না করলেও ট্রাম্পের বিপরীতমুখী ব্যক্তিত্ব দ্বারা নির্বাচনে মানুষের আস্থা অর্জন তাঁর জন্য খুব সহজ হয়ে যায়। বাইডেনের বিজয় অবশ্যই ডেমোক্রেটিক পার্টির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ও নির্বাচনী কৌশলের বিজয়; কিন্তু এ বিজয়কে তাঁর চারিত্রিক সততার, জবাবদিহির, সময়ানুগ প্রতিশ্রুতি প্রদানের এবং মানুষের প্রতি অবজ্ঞার বিপরীতে সহানুভূতি প্রদর্শনের বিজয় বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। বাইডেন-হ্যারিস জুটির প্রতি মানুষের আস্থা হলো বৈচিত্র্য, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির প্রতি আস্থার মতো।
সবার প্রত্যাশা, যুক্তরাষ্ট্রে যখন চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে, অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে ওঠা কঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে, করোনা মহামারিতে প্রতিদিন যেখানে এক লাখেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, এ রকম সময়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর ক্ষমতাকালের শেষ পর্যায়ে রাষ্ট্রনায়কোচিত ভূমিকা পালন করার জন্য গলফ ক্লাবের মাঠ থেকে ফেরত আসবেন। অবজ্ঞা প্রদর্শন করে একের পর এক টুইট প্রদান করা বন্ধ করে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়াকে সাবলীল করার প্রয়োজনীয় কাজে মনোযোগী হবেন। সারা বিশ্বের মানুষ প্রত্যাশা করে, যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান সরকার ওয়াশিংটন ডিসির রাজপথে ক্ষমতায় পুনর্বহাল হওয়ার জন্য লোক জমায়েত না করে গণতন্ত্রের পতাকা ও বৈচিত্র্যের সৌন্দর্যকে মহিমান্বিত করার পথে এগিয়ে যাবেন। প্রযুক্তির জাদুকরী উন্নয়ন, শিল্প উন্নয়ন, পণ্য ও সেবা খাতে সহযোগিতা পৃথিবীর দেশগুলোকে এত কাছাকাছি নিয়ে এসেছে যে একটি গ্রামের অধিবাসীরা যেমন এককালে পারস্পরিক সহযোগিতা নিয়ে বেঁচে থাকত, পৃথিবীর দেশগুলোকেও এখন একইভাবে পারস্পরিক সহযোগিতা নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি এই মুহূর্তে যে দুটি খাত থেকে শক্তি সঞ্চয় করছে, সে দুটি খাতের সংকোচন ও প্রসারণের সঙ্গে আমেরিকার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের রসায়নের সংকোচন ও প্রসারণ ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছে। আমরা চাই গণতন্ত্রের মূল বাণী বহন করে আব্রাহাম লিংকন, মার্টিন লুথার কিংয়ের যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার অগ্রবর্তী ও নির্ভরশীল দেশ হিসেবে আমাদের সামনে দাঁড়াক। আমরা মানবিক, উদার, সহমর্মী যুক্তরাষ্ট্র দেখার প্রত্যাশায় আছি।
লেখক : উন্নয়ন গবেষক ও কলামিস্ট
Leave a Reply